খুন করাটাও যেন একটা কাজ
প্রকাশ | ২৫ মার্চ ২০১৭, ২০:২৭
‘বলেছিলাম বাঁচতে দে, জীবন নষ্ট করিস না...এখন বুঝো?? অনিক, তানজিনা, শিল্পী, রিয়াদ, পলাশ, মাসুদ দেখা হবে মনে রাখিস।’
ওপরের কথাগুলো ফখরুল ইসলাম রবিন তার ফেসবুক স্ট্যাটাসে লিখেছেন। ফখরুলকে কি পাঠক চিনতে পারছেন? ফখরুল হচ্ছেন রাজধানীর সেন্ট্রাল রোডে নিজ বাসার দরজার সামনে নৃশংসভাবে খুন হওয়া ব্যাংক কর্মকর্তা আরিফার সাবেক স্বামী। তার হাতেই আরিফা খুন হয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। ১৬ মার্চ সকালে আরিফা খুন হওয়ার কিছুক্ষণ পর ফেসবুকে এই স্ট্যাটাস দেন ফখরুল। স্ট্যাটাসে অনিক, তানজিনাসহ যে কজনের নাম দিয়েছেন, তাঁরা সবাই আরিফার ভাই, বোন ও আত্মীয়। স্ট্যাটাস পড়ে মনে হচ্ছে, তাদেরও একধরনের প্রচ্ছন্ন হুমকি দিয়েছেন ফখরুল। ফেসবুকে অবশ্য তাঁর নাম হচ্ছে খান ফিরবিন।
আরিফার পরিবারের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, পরিবারের অমতে ফখরুলকে বিয়ে করেন আরিফা। গত বছর তাদের ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়। কিন্তু ফের আরিফার সঙ্গে সংসার করতে চান ফখরুল। এতে আরিফা রাজি হননি। তারপর থেকে তাকে উত্ত্যক্ত করে আসছিলেন ফখরুল। এমনকি খুনের হুমকিও দেন। আরিফা খুন হওয়ায় তাই ধারণা করা হচ্ছে, ফখরুলই খুন করেছেন। আরিফার পরিবার ফখরুলকে আসামি করে মামলা করেছে। তা-ই যদি হয়, তাহলে বোঝাই যাচ্ছে, ফখরুল ঠান্ডা মাথায় খুন করেছেন। আর খুন করার পরও ফখরুলের মাথা ঠান্ডা ছিল। তা না হলে খুন করে যখন খুনি পালানোর জন্য ব্যস্ত থাকে, তখন কিনা তিনি ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিচ্ছেন! সেই স্ট্যাটাসে আবার লাইক পড়েছে ২৯টি। যারা লাইক দিয়েছেন, তারা কি জেনেবুঝে লাইক দিয়েছেন, নাকি পরিচিতজনের স্ট্যাটাসে লাইক দিতে হয়, তাই দিয়েছেন? মনে ধন্দ জাগে। যদি জেনেবুঝে লাইক দিয়ে থাকেন, তাহলে সেটা খুবই উদ্বেগের বিষয়। এর অর্থ কি এই নয় যে ফখরুলের এ অপকর্মের প্রতি তাদের সমর্থন আছে?
সব দেখেশুনে মনে হচ্ছে, খুন করাটা স্বাভাবিক ঘটনায় পরিণত হচ্ছে। আর ১০টা স্বাভাবিক কাজের মতো এটিও একটি কাজ। যে-কেউ চাইলেই যে-কাউকে খুন করতে পারে। আর এতে কেউ কিছু মনে করবে না।
দেশে প্রায় প্রতিদিন মানুষ খুন হচ্ছে। অথচ কারও যেন কোনো বিকার নেই। আমাদের অনুভূতি কি তবে ভোঁতা হয়ে যাচ্ছে? হয়তো তা-ই। পত্রিকার পাতায় প্রতিনিয়ত খুনের খবর প্রকাশিত হচ্ছে। কিন্তু আমরা কয়টা খুনের ঘটনা মনে রাখি?
গত বছরের ২০ মার্চ কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজের ছাত্রী সোহাগী জাহান তনু যখন খুন হলেন, তখন সারা দেশ এই খুনের প্রতিবাদে উত্তাল হলো। প্রায় প্রতিদিন বিক্ষোভ সমাবেশ হলো। মানববন্ধন হলো। কিন্তু কদিন না যেতেই আবার সেই একই অবস্থা। তনুর কথা আমরা প্রায় সবাই ভুলতে বসেছি। তনুর খুনিরা আজ অবধি গ্রেপ্তার হওয়া দূরের কথা, শনাক্ত পর্যন্ত হয়নি। কিন্তু তার জন্য এখন কোনো মানববন্ধন নেই। হয় না কোনো বিক্ষোভ সমাবেশ। নাকি আমরা সবাই বুঝে গিয়েছি যে এসব বিক্ষোভ, সমাবেশ আর মানববন্ধন করে লাভ নেই? কেননা খুনিরা ধরা পড়ে না। ধরা পড়লেও বিচার হয় না। আইনের ফাঁকফোকর গলে বেরিয়ে যাচ্ছে তারা। তনু খুন হওয়ার পর আরও কত নারী-পুরুষ-শিশু খুন হয়েছে। পত্রিকাতেও এসেছে সেসব খুনের খবর। কিন্তু কয়টা খুনের প্রতিবাদে আমরা সোচ্চার হয়েছি? রাষ্ট্রও কেমন যেন নির্বিকার। যেন তার কিছু করার নেই। অনেক ক্ষত্রেই খুনিরা খুন করে পার পাচ্ছে। ধর্ষকেরা ধর্ষণ করার পর সমাজে বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়ায়—এমন নজিরও আমরা দেখি। অপরাধীর সাজা না হলে এসব দৃষ্টান্ত আরও অপরাধ ঘটাতে সহায়তা করে। ভবিষ্যতে আরও অপরাধ ঠেকাতেই অপরাধীর শাস্তি নিশ্চিত করা দরকার।
আরিফা খুন হওয়ার সাত দিন পর ফখরুলকে গ্রেপ্তার করা হয়। আমাদের প্রত্যাশা, অভিযোগ প্রমাণিত হলে আইনের কোনো ফাঁক গলে বেরিয়ে যেতে পারবেন না ফখরুল। সাজা নিশ্চিত করার দৃষ্টান্ত স্থাপন করা হলে তা এ ধরনের খুনের ঘটনা কমাতে নিশ্চিতভাবেই ভূমিকা রাখবে।
লেখক: সাংবাদিক
সূত্র: প্রথম আলো