আজ নীরবতা ভাঙছে, কাল নিশ্চয়ই প্রতিরোধ হবে
প্রকাশ | ১৭ মার্চ ২০১৭, ২২:৪৯
আমার সাম্প্রতিক একটি লেখায় আমি জুঁই এর বিজ্ঞাপনের রেফারেন্স দিয়েছি এবং এই বিজ্ঞাপনকে ইতিবাচক বলেছি বলে অনেকেই জানতে চেয়েছেন কিভাবে এই বিজ্ঞাপন ইতিবাচক হতে পারে? তাদের বলছি, আমি জানি এই বিজ্ঞাপনে নারীকে পারিবারিক নির্যাতন প্রতিরোধের ভূমিকায় দেখানো হয়নি, দেখানো হয়েছে প্রতিকারের ভূমিকায়। অন্য সব বিজ্ঞাপনের মতো এই বিজ্ঞাপনেও নারীর অপমান আর বেদনাকে পুঁজি করে জুঁই এর ব্যবসা আছে তাতে আমার কোন সন্দেহ নেই। তবু আমি এই বিজ্ঞাপনের ইতিবাচক দিকটি ওখানেই দেখি যেখানে এই প্রথম (আমার জানা মতে) কোন বিজ্ঞাপন পারিবারিক নির্যাতনকে রিকগনাইজ করেছে।
গণমাধ্যমে লিঙ্গ বৈষম্য, নারীকে খুন্তি হাতে রান্না করা, বাচ্চার গায়ে র্যাশ উঠেছে বলে নিজেকে ব্যর্থ মা বলে ইঞ্জিনিয়ার নারীর কাঁদতে বসা, টয়লেট পরিষ্কার, স্বামীর কাপড় পরিষ্কার করতে না পেরে মুখের উপর কাপড় ছুঁড়ে দিয়ে চলে যাওয়ায় কাঁদতে কাঁদতে আবার সেই কাপড় পরিষ্কার করে স্বামীকে খুশি করা, স্বামী অন্য নারীতে আসক্ত হয়ে যাচ্ছে বলে নারীর রূপচর্চা করতে লেগে যাওয়া... ইত্যাদি রাবিশ খেয়ে দেখতে দেখতে আমি যখন হাঁপিয়ে উঠছিলাম, তখন জুঁই এর এই বিজ্ঞাপন নারীকে অন্তত প্রতিকারের ভূমিকায় দেখিয়েছে, পারিবারিক নির্যাতন ও সৌন্দর্যের লোভকে তুচ্ছ করে হলেও নারী নিপীড়নের রাজনীতি ও দুর্বলতা নিয়ে কথা বলার সুযোগ করে দিয়েছে।
এটুকুও না আগালে আমরা কিভাবে আশা করতে পারি যে, আগামীতে কোন পণ্য এমন বিজ্ঞাপন বানাবে যেখানে নারী ঘুরে দাঁড়িয়ে পুরুষতন্ত্রের শিরদাঁড়া বরাবর আঘাত হানবে? আজকে যারা বলছেন গোছা গোছা চুল কেটে ফেলাই নারীবাদ নয়, তাদেরকে বিনীত ভাবেই জানাতে চাই, এই গোছা গোছা চুলের পেছনের রাজনীতি, পুরুষতন্ত্রের মর্জি মাফিক নারীর চুলের গোছা ধরে টান দেওয়া, ইচ্ছে হলে চুল টেনে রোমাঞ্চ করা আবার শাস্তি হিসেবে কেটে দেওয়া, এসব মনোসামজিক ব্যাকরণটা বোঝা কিন্তু নারীবাদের জন্য খুব জরুরি, চুল কাটা না কাটাটা জরুরী না হলেও।
এই দেশ ও সমাজের বাস্তবতায় একটি মেয়ে চাইলেই যেখানে ঘর থেকে বের হয়ে আসতে পারে না, পারিবারিক নির্যাতন নিয়ে কথা বলাই যেখানে ট্যাবু, সেখানে বিউটি পার্লারের মতো একটি পাবলিক পরিসরে নিজেকে পারিবারিক নির্যাতনের ভিক্টিম বলে উচ্চারণ করার মতো নীরবতা যে ভাঙছে একটি মেয়ে, নিজের সৌন্দর্যের লোভ জয় করে নিপীড়কের হাত থেকে একটা অস্ত্র অন্তত কমিয়ে দিতে চেয়েছে, এটুকুই আমি স্বীকার করতে চেয়েছি। আজ নীরবতা ভাঙছে, কাল নিশ্চয়ই প্রতিরোধ হবে।
ক্রমবর্ধমান নারী নির্যাতন নিয়ে আমরা যেমন অনেক সোচ্চার, তেমন করেই এটাও বলা দরকার যে, এখনো ঢাকার রাস্তা দিল্লীর রাস্তার চেয়ে বহুগুণ বহুগুণ নিরাপদ। হার্ডওয়ার উন্নয়নের নিচে চাপা পড়ে যাওয়া ছোটখাট সফটওয়ার উন্নয়নের ইতিবাচক দিকগুলো নিয়ে আমরা কথা না বললে কখনো জানা হবে না, ফুটপাত থেকে হকার উচ্ছেদ করাতে মধ্যবিত্ত নাগরিক জীবনের কি পরিমাণ সুবিধা হয়েছে। এখন চাইলেই হকার উচ্ছেদ নিয়ে বিতর্ক তোলাই যায়। কিন্তু ভুক্তভোগী মাত্রই জানে এতে রাজনীতি যতোই থাকুক না কেন লাভবান কিন্তু আমাদের মতো আমজনতা হয়েছি। ইতিবাচক বিষয়গুলো আকারে আয়তনে যতো ছোটই হোক না কেন, তাকে স্বীকার করতে না পারলে লড়াইটা বড়ো কঠিন হয়ে যাবে, নির্বান্ধব হতে থাকবো আমরা। ছোট ছোট পরিবর্তন একদিন বড় পরিবর্তন আনবেই কিন্তু।
সাদিয়া নাসরিন এর ফেসবুক থেকে