স্বাধীনতা

প্রকাশ | ১৬ মার্চ ২০১৭, ১৬:৪৫ | আপডেট: ১৮ মার্চ ২০১৭, ০০:৩৮

আমার মায়ের চেহারা তখন ডাইনি বুড়ির মতো, কোটরাগত চোখ জ্বলজ্বল করছে। আমার দিকে তাকিয়ে কঠিন গলায় বললেন, ‘তুই পারবি?’ আমি ভয়ে ভয়ে বললাম, ‘পারব।’

মা আমাকে যে কাজটি করতে বলেছেন, সেটি খুব সহজ কাজ ছিল না- বাবার কবর খুঁজে তাঁর দেহাবশেষ বের করা, সারা পৃথিবীতে খুব বেশি মানুষকে এই কাজটি করতে হয়েছে বলে মনে হয় না। একাত্তরে এই দেশে পাকিস্তানি মিলিটারিরা লাখ লাখ মানুষকে মেরেছে; তাদের ভেতরে আমার বাবাও একজন। মৃতদেহটি নিজের চোখে দেখেননি বলে আমার মা কখনোই ঘটনাটি বিশ্বাস করেননি। যারা নদী থেকে তুলে বাবার দেহটিকে নদীতীরে কবর দিয়েছে, তারা এসে নিজের মুখে বলার পরও আমার মা সেটা বিশ্বাস করেননি।সমস্ত যুক্তিতর্ক পাশ কাটিয়ে বিশ্বাস করতেন, বাবা বেঁচে আছেন, দেশ স্বাধীন হলে ফিরে আসবেন।

দেশ স্বাধীন হয়েছে, বাবা ফিরে আসেননি। বাবার মৃত্যুকে মেনে নেওয়া ছাড়া আর কিছুই করার নেই। তখনো মা শেষ চেষ্টা করলেন। আমাকে বললেন, কবরটা খুঁড়ে দেখতে, সত্যি সত্যি সেখানে বাবার দেহ আছে কি নেই। তখন জানুয়ারির শেষ কিংবা ফেব্রুয়ারির প্রথমদিক, অনেকদিন  পর ইউনিভার্সিটি খুলেছে। ছেলেমেয়েরা হইচই করে ক্লাস করছে, স্বাধীন দেশে প্রথমবার ক্লাসে যাওয়ার আনন্দটাই অন্যরকম। আমি ক্লাসে যেতে পারছি না, মাকে নিয়ে পিরোজপুর যাচ্ছি। সেখানে একটি নদীতীরে আমার বাবার কবর খুঁড়ে তাঁর দেহাবশেষ বের করতে হবে।

ছোট লঞ্চটা মেঘনার উথাল-পাথাল ঢেউয়ের ওপর দিয়ে যাচ্ছে, ভেতরে টিমটিমে হলুদ আলোয় আমি ছোটবোনটিকে জড়িয়ে ধরে রেখেছি। ঘুমের ভেতর সে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। সেইরাতে সৃষ্টিকর্তার ওপর আমার খুব অভিমান হয়েছিল। খুব ভোরে লঞ্চঘাটে নেমেছি, এখান থেকে রিকশা করে পিরোজপুর শহরে, যেখানে আমাদের সাজানো-গোছানো বাসা ছিল, এখন কিছুই নেই। শহরে কোথায় যাব, কোথায় উঠবো কিছুই জানিনা। রিকশায় করে শহরে আসতে আসতেই অবশ্য পরিচিত মানুষ, আপনজন আমাদের কাছে ভিড় করে এল। আমাদের বাসার ঠিক সামনে ডাক্তার সাহেবের বাসা, তিনি তার বাসায় আমাদের তুললেন। ডাক্তার সাহেবের ছোট ছোট বাচ্চাগুলো একসময় আমার খুব ভক্ত ছিল, এতদিন পর আমাকে দেখে চোখ বড় বড় করে দেখছে। কাছে আসতে সাহস পাচ্ছে না।

আমার মা প্রথম সুযোগ পেয়েই বললেন, তিনি কবরটা খুঁড়ে দেখতে চান, যদি সেখানে সত্যিই বাবার দেহাবশেষ থেকে থাকে, তাহলে তুলে এনে কবরস্থানে কবর দিতে চান। বাবা পুলিশ অফিসার ছিলেন। তাই স্থানীয় পুলিশের লোকজন বলল, কবর থেকে দেহাবশেষ তুলে ময়নাতদন্ত করে পাকিস্তানি মিলিটারি অফিসারদের বিরুদ্ধে খুনের মামলা করতে চায় তারা। সারেন্ডার করার পর প্রায় লাখ খানেক মিলিটারি ইন্ডিয়ায় আছে, তাদের ভেতর থেকে যুদ্ধাপরাধীদের আলাদা করে এনে বিচার করা হবে। আমরা বললাম, আমাদের কোনো আপত্তি নেই, এদেশে এরা এত মানুষকে ঠান্ডা মাথায় খুন করেছে, কারো বিচার হবে না- এটা তো হতে পারে না। বাবার দেহাবশেষ আনার জন্য একটি কফিন বানানো হলো। নৌকায় সেই কফিন নিয়ে আমি, মা আর ছোট বোনকে নিয়ে রওনা দিয়েছি। আমাদের সঙ্গে আছেন ডাক্তার, পুলিশ অফিসার এবং আরো কয়েকজন। নৌকা করে মাইল খানেক যাওয়ার পর নদীতীরে খানিকটা ফাঁকা জায়গা পাওয়া গেল এবং সেই ফাঁকা জায়গাটার ঠিক মাঝখানে একটা কবর। পাকিস্তানি মিলিটারিরা বাবাকে মেরে নদীতে ফেলে দিয়েছিল, জোয়ার ভাটায় তিনদিন এই নদীতে ভেসে বেড়িয়ে এখানে নদীর কিনারায় তাঁর শরীরটা আটকে গিয়েছিল। গ্রামের মানুষ ইচ্ছে করলেই ঠেলে আবার নদীতে ভাসিয়ে দিতে পারত- এদেশের লাখ লাখ মানুষের মতো তার দেহটাও নদীর পানিতে মিশে যেত। কিন্তু ঠিক কী কারণ কে জানে, তারা সেটা করেনি, বাবার দেহটি তুলে এখানে কবর দিয়েছে। আজ আমি এসেছি সেই কবর খুঁড়ে তাঁর দেহাবশেষ বের করতে।আমার বাবা অসম্ভব রূপবান ছিলেন, হালকা-পাতলা কিশোরের মতো দেহ, কুচকুচে কালো এক মাথা চুল, খাড়া নাক, উজ্জ্বল চোখ, ধবধবে ফর্সা গায়ের রঙ। কবর খুঁড়ে আমরা তো আর সেই মানুষটিকে বের করব না, বের হবে তাঁর দেহাবশেষ। আমি চাই না আমার মা কিংবা ছোট বোন সেই দেহাবশেষটুকু দেখুক, তাই আমি তাদের একটু দূরে একটা গাছ তলায় বসিয়ে এলাম। আমি আর আমানুল্লাহ মিলে বাবার কবরটা খুঁড়ে তাঁর দেহাবশেষ বের করেছিলাম।

সুদীর্ঘ ১০ মাসে শুধু হাড়গুলো আছে, পা দুটো অল্প একটু ভাঁজ করে কবরের ভেতরে শুয়ে আছেন। দুই পায়ে গাঢ় সবুজ রঙের নাইলনের দুটো মোজা অবিকৃত রয়ে গেছে। জীবনের শেষদিনে যখন তিনি পায়ে মোজাগুলো পরছিলেন, আমি তখন পাশে দাঁড়িয়ে ছিলাম। সেই মোজাগুলো পরে এখন কবরে অসহায় ভঙ্গিতে শুয়ে আছেন। বুলেটগুলো কোথায় আঘাত করেছিল, বোঝা যাচ্ছে।

একটা লেগেছে মাথায়, অন্য একটা পায়ের বড় হাড়টিতে, যেটা শরীরের সঙ্গে এসে লাগে। বুলেটের নিশ্চয়ই প্রচন্ড শক্তি, তার আঘাতে হাড়ের একটা বড় অংশ উড়ে বের হয়ে গিয়েছিল। আমি এক ধরনের গভীর মমতায় বাবার সেই ক্ষতস্থান গুলোতে হাত বুলিয়ে দিলাম। ছেলে মানুষের মতো মনে হচ্ছিল, আমার সেই স্পর্শ দিয়ে বুঝি বুলেটের সেই তীব্র আঘাতের কষ্ট মুছে দেওয়া যাবে। আমি আর আমানুল্লাহ মিলে বাবার শরীরের দেহাবশেষ কফিনের মধ্যে তুলে তার ডালাটি বন্ধ করে মায়ের কাছে গিয়ে মাথা নিচু করে দাঁড়ালাম। মা আমার চোখের দিকে তাকালেন, তারপর প্রথমবার তাঁর বুকে চেপে ধরলেন, সেই দৃশ্যটি দেখতে দেখতে আমার হঠাৎ মনে হলো, আমার বয়স বুঝি অনেক বেড়ে গেছে।

প্রথম প্রকাশ : অর্জন, ২০১১