কর্ম যখন প্রবল আকার
প্রকাশ | ১২ মার্চ ২০১৭, ১২:০০
১
সাদা কাগজের দিকে ঠায় তাকিয়ে আছি। তাকিয়ে থাকতে আজকাল আর সাহস লাগে না। চোখ ফেরাতে তাও ধক লাগে অনেক। এখন মানুষের মুখের থেকে চোখ ফেরানো কঠিন। তুলনায় অমানুষদের সাথে বাক্যালাপ বরং অনেক সহজ। ঠিক যেভাবে প্রসাদকাকুর থেকে চোখ ফিরিয়ে নিতে পেরেছি আমি। বুঝেছি, ওখানে একটা মানুষ ছিল একটু আগেও, তবে এখন নেই। প্রসাদকাকু ছিল। ছিল, অর্থাৎ অতীত। অতীতের থেকে চোখ ফেরানো অনেক সহজ। বর্তমানের দিকে দৃঢ় দৃষ্টিপাত করা বড্ড কঠিন। অতএব আমি সাদা অতীতের, শূন্যতার দিকেই ঠায় তাকিয়ে আছি।
এভাবে তাকিয়ে থাকতে থাকতেই বুঝতে পারি আমার আসলে লেখার কিছু নেই, বলারও না। শুনেছি মানুষের মৃত্যুতে শোক থাকে, আমার প্রবল রাগ আছে। ভয় পাচ্ছি আমি খুব।
ভয় পাচ্ছি কারণ আমি যে আর বিশ্বাস রাখতে জানব না। ঝাঁকরা চুল, হাসিমুখে মুশকিল আসান হয়ে আসা সকল মানুষদের স্থায়িত্ব অস্বীকার করব, জানি। যখনই কেউ কাঁধে হাত রেখে বলবে, “ডানা, তুই এখনও ছোট, বড়দের কথা শোন”- ঝটকায় সরাব সেই হাত। বড়রা কথা রাখেনা একথা আমি জেনে গেছি ভালো মতই। কেবল কথার পিঠে কথা চাপিয়েই যায় অবিরত। আর ফেলে যাওয়া শব্দের ভারে আমরা, ছোটরা, কেবল ন্যুব্জ হতে থাকি। আমাদের শিরদাঁড়ায় কাঁপুনি ধরিয়ে বড়রা কেমন যেন একটু বেশিই বড় হয়ে যায়। তাঁরা, তাদের কর্ম, সবটুকুই প্রবল আকার ধারণ করে। আমরা যারা ছোট, বিনীত, তারা কাঁপতে কাঁপতে ফুলের খোঁজ করতে থাকি এই ব্যপ্তির পায়ে ছড়ানোর জন্য। মৃত ফুল আর প্রবল ব্যপ্তির কারোরই তাতে কোন ভ্রূক্ষেপ নেই। তাঁরা বড়। অনেক বড়। তাঁরা আরো বাড়তে থাকেন শুধু।
২
জন্মাবার পরমূহুর্তে বাবার আগে প্রসাদকাকুর সান্নিধ্য পেয়েছি। মঞ্চে প্রথম কম্পিটিশনে গান গেয়েছি, তবলায় সেই প্রসাদকাকুই। আজন্ম যার কাছে সমে ফেরার পাঠ নিয়ে এসেছি, তার শেষ যাত্রায় কিছুতেই যেন লয় মিলতে চায়না। যার দিকেই তাকাই না কেন, কেউই ঠিক আশ্বস্ত করতে পারেনা। কেউই জোর দিয়ে বলতে পারছে না আমায়, সব ঠিক হয়ে যাবে। সবাই চোখ এড়িয়ে যাচ্ছে একে অপরের। কারণ সবাই জানে, সব কিছু বদলে যাবার জন্য যে মানুষটার প্রয়োজন ছিল, সে অতীত। তার বর্তমান বলতে কতগুলি সাদা ফুলের মালা আর ঠাণ্ডা, কঠিন একটা বাস্তব। আর ভবিষ্যৎ? আমি ভয় পাচ্ছি।
বড়দের একটা দায়িত্ব থাকে ছোটদের ‘মানুষ’ করবার। বড়রা চেষ্টা করেন নিজের ক্ষুদ্রত্বের সমাহারেই আমাদের সর্বোত্তম করে তোলার। পারেন কি না জানিনা, তবে চেষ্টা চলতেই থাকে। দুঃখের বিষয় এটাই, প্রসাদকাকু আমাদের ‘মানুষ’ করে বড় করে দিয়ে যেতে পারল না। চূড়ান্ত অমানবিক একটা সময়ের সামনে ঠেলে চোখে আঙুল দিয়ে বুঝিয়ে গেল আমাদের চরম অপারগ ক্ষুদ্রত্বের গণ্ডীটুকু।
বড়দের অভিজ্ঞতা থাকে, সুতরাং সমাধান চাইতে ছোটরা বড়দের কাছে হাত পাতবে এটাই স্বাভাবিক। প্রসাদকাকুও সেই পথেই হাঁটত। সহজ পরবের লেখা থেকে কলেজে ভর্তি হবার আগের উপদেশ- কাকা হয়ে জ্যাঠাসুলভ বাণী দেওয়ায় প্রসাদকাকুর কোন জুড়ি ছিল না। কোথায় খাব, কীভাবে লিখব, কেন ভাবব- এত প্রশ্নের একটাও কখনও উত্তরহীন ফিরে আসেনি। দায়িত্বের প্রসঙ্গে একটা ঘটনার কথা বলি। আমার তখন বয়স বড়জোর ছয় কি সাত মাস হবে। গণনাট্য সঙ্ঘের কনিষ্ঠতম সদস্য হিসেবে বাবা মায়ের সাথে আমিও আসামের এক প্রান্তিক গ্রামে সফরসঙ্গী। অনুষ্ঠানের সন্ধ্যেয় মঞ্চে গান গাইছে বাবা-মা, তবলায় প্রসাদকাকু। জয়কাকু (সৌমিত্র শঙ্কর চৌধুরী)-র কোলে আমি। মায়ের গাওয়া শেষ হলে মঞ্চ থেকে নেমে এসে আমায় কোলে নেবে এমনই কথা। কিন্ত বাবার তো কোন ঠিক নেই। মায়ের গান বাদ দিয়ে হঠাৎ নাচের গান ধরল। বেগতিক দেখে জয়কাকু আমাকে মাঠের মাঝে বসিয়েই স্টেজে লাফ, মায়েরও আর মঞ্চ থেকে নামা হল না। আমি রইলাম মাঠে। আমিও ফাঁক পেয়ে হামাগুড়ি দিয়ে মাঠ চষে বেড়াচ্ছি। নাচে-গানে সবাই বেমালুম ভুলে গেছে আমার কথা। জয়কাকু বারবার নাচের মাঝে মাঝে এসে বাবার সামনে ফিসফিস করে বলতে থাকে “ডানা! ডানা!” কিন্তু কে শোনে কার কথা। মা-বাবার নজরে না পড়লেও প্রসাদকাকু ঠিকই শুনেছিল সেদিন, তবলা বাজাতে বাজাতে ভিড়ের মাঝে আমাকে দেখতে পেয়ে বাবাকে কানে কানে বলেছিল, “ওই দেখো, এক মহিলার কোলে ডানা!” সেই তবে থেকে আজ পর্যন্ত বাপ-মা বাদ দিলে আমার অভিভাবকের দায়িত্বে চিরকালই প্রসাদকাকুর অগ্রাধিকার। আমার সব প্রথমের সাক্ষী সেই প্রসাদকাকু এবারও অভিভাবকের, পিতৃস্থানীয় বন্ধুর মৃত্যুদায়ের হাতেখড়ি করিয়ে দিয়ে গেল। আর আমি অসহায় সন্তানের মত মাথা পেতে সেটাও মেনে নিলাম।
সেদিন মাঠের হাজার হাজার দর্শকের মাঝে প্রসাদকাকুর চোখ দেখতে পেয়েছিল আমাকে। হারিয়ে যেতে দেয়নি ভিড়ে। এখন বয়স বেড়েছে অনেক। আমার পঁচিশ ছুঁয়ে ফেলা নিয়ে মশকরাও করেছিল কিছু মাস আগে।
আমি প্রাণপণ চেষ্টা করেছিলাম কিন্ত সেদিন প্রসাদকাকুকে খুঁজতে। লোকারণ্য রাস্তায়, ফুলের ভারের নীচে কোথাও খুঁজে পাইনি। হারিয়ে গেছে।
৩
সাদা কাগজের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতেই ঠিক করলাম তোমাকে আর খুঁজব না। বদলে তোমাকে গড়বার চেষ্টা করব প্রতিদিন। আয়নায়, শব্দে, গানে, স্বপ্নে তোমাকে গড়ব সযত্নে। একা পারব না জানি, কিন্ত সবাই মিলে টুকরো টুকরো হয়ে তোমায় ধরবার চেষ্টা করব, যাতে আশাবরী আশেপাশে চোখ বোলালে বারবার তোমায় দেখতে পায়।
আমরা তো ছোট। আমরা ব্যপ্তিকে ধারণ করতে পারিনা, সাধনা করে যাই শুধু বড় হবার। সঙ্গীতের মতোই এই সাধনা দীর্ঘ সময়ের ফলস্বরূপ হবার ছিল। কিন্ত সব কিছু নস্যাৎ করে কী জানি কোন এক অদ্ভূত তাড়ায় হুট করে বড় করে দিয়ে গেলে আমাদের সকলকে। যেমন দায়িত্বের সাথে অভিভাবক হয়েছিলে, তার চেয়েও গুরুভার এই অনাথ বাস্তবতা। এভাবে বড় হওয়ার মধ্যে কিন্ত মানুষ হতে পারা নেই। আছে কেবল অমানবিক যন্ত্রণা, উত্তরাধিকারের অভিমান আর একরাশ লড়াই।
আবারও আমার চোখ তোমায় খুঁজছে। আমি হামাগুড়ি দিচ্ছি মাঠে-ঘাটে-রাস্তায়। আমার সাথেই অচল হয়ে পড়ে আমারই মত অসংখ্য ছোট ছোট হাত, গলা, কলম, দোতারা গ্রামে-গঞ্জে। এক নতুন, অপরিচিত সাদা শূন্যতা ক্রমশ গ্রাস করতে থাকে আমাদের। আমরা হারিয়ে যেতে থাকি। অনেক দূরে কেউ গুনগুন করে- “আকাশে রোদের দেশে ভেসে ভেসে বেড়াই, মেঘের পাহাড়ে চড়ো তুমি”
সাদা তো মেঘ হয় জানতাম ছোটবেলায়। বড় হয়ে মেঘের সাথে মৃত্যুর তুলনা করতে শিখে গেছি। অতল জলের খোঁজ করতে যাই। আর শিরদাঁড়ায় কাঁপুনি দিয়ে জ্বর আসতে থাকে আমাদের।
একটা গোটা প্রজন্মজুড়ে আমরা ভয় পেতে থাকি। আমরা অনাথ।
লেখক: ব্লগার, সঙ্গীতশিল্পী ও ভারতের সংস্কৃতি কর্মী