নারীর অবদমন নারীকেই ভাঙতে হবে
প্রকাশ | ০৮ মার্চ ২০১৭, ০৩:২২
চার ফসলি জমিতে দুই ফসল তুললে তো বিপাকে পড়তেই হয়। নারী অধিকার নিয়ে আজকাল অনেকেই কথা বলছেন, এটা ভালো দিক কিন্তু ভালো দিকটার পালে জোর হাওয়া লাগছে না। কেন? এই কেন নিয়ে যত নাড়াচাড়া করা যাবে ততই মঙ্গল মনে করি।
কয়েক বছর আগের কথা। আমার এক বন্ধু আড্ডায় আরেক বন্ধুর কাছে জানতে চাইলো, সে গাড়ি কিনবে, প্রাইভেট কার কি টয়োটা নিলেই বেটার হয় না। সাথে সাথে অপর বন্ধু বললো, প্রাইভেট কার কিনবি মানে, ওটাতো মাইয়া মানুষের গাড়ি, পুরুষের গাড়ি জিপ। শুধু ওই বন্ধুই বা বলি কেন, সমাজের সব বিভাগেই এই বিভাজন। নারীর বাইক হবে স্কুটি, ব্যবসা হবে পার্লার, জুতাতে হিল থাকতেই হবে, পকেট বিহীন পোশাক, ওয়ালেটের বদলে হাতব্যাগ ইত্যাদি ইত্যাদি। মোদ্দা কথা হলো, আমরা আগে নদী আঁকছি, গাছপালা বসাচ্ছি তারপাশে একটা পালতোলা নৌকা, নদীতে কয়েকটা হাঁস থাকতে পারে, দুটো কুঁড়েঘর থাকতে হবে, তবেই আমরা তাকে একটি প্রাকৃতিক দৃশ্য বলে স্বীকৃতি দিয়ে দেব।
দাসপ্রথা বিলুপ্ত হয়েছে বেশিদিন হয়নি। এখনো পাকাপাকি বিলুপ্ত এ কথাও জোর দিয়ে বলতে পারছি না। একসময় ধনীরা হাট থেকে উপযুক্ত দাম দিয়ে দাস কিনতো তার আধুনিক সংস্করণ হলো মোহরানা দিয়ে বিয়ে। আদতে যতোদিন পর্যন্ত নারী বিয়ে করতে না পারবে (বিয়ে বসা নয়) ততোদিন তাকে কেউ মানুষ গণ্য করবে না। সংখ্যায় কম হলেও কিন্তু আমরা দেখি ঘরজামাইদের অবস্থা, অবস্থান। শুধু পুরুষ নারীকে নয় সমাজে মালিক শ্রমিক, ধনী-গরিব, সাদা-কালো অনেক বৈষম্যের মতো নারী-পুরুষ বৈষম্যের একটা বড় কারণ অর্থনৈতিক। হ্যাঁ, একথা সত্য, চাকুরিজীবি নারীদেরও অনেক বৈষম্য পোহাতে হয়, তার কারণ প্রচলিত সমাজ ব্যবস্থা, ধর্মীয় বৃত্ত ইত্যাদি ইত্যাদি তবুও নারী মুক্তির প্রথম শর্ত হিসেবে আমি মনে করি নারীকে অবশ্যই অর্থনৈতিক ভাবে স্বাবলম্বি হতে হবে। সংসারের খরচা থেকে শুরু করে রান্না, কাপড় ধোয়া, বাচ্চা পালন সবক্ষেত্রে নারী-পুরুষ দুজনকেই সমান অংশ গ্রহণ করতে হবে।
শরীর দিয়েই নারীকে মাপে পুরুষশাষিত সমাজ। একটা মেয়ে ধর্ষিত হলেই তাকে কেন আত্মহত্যা করতে হবে? সমাজে কত রকম জন্তু, কীট, পোকামাকড়ের বসতি। একটা জন্তু কামড়ালো আমি আত্মহত্যা করে বসবো? এই মানসিক বৃত্ত থেকে বেরোতে হবে। নারী-পুরুষ সহযোদ্ধা হয়ে বসত করতে পারে, ভালোবাসতে পারে, সন্তান জন্ম দিতে পারে তার মানে এই নয় কেউ কারো কেনা সম্পদ। ব্যপারটা স্রেফ বন্ধুত্বের মতো, বা আরেকটু গুছিয়ে বলছি, ঘনিষ্ঠ বন্ধু। বনিবনা না হলে যার যার রাস্তা সে সে দেখবে। বন্ধুত্বে দায়বদ্ধতা থাকেই তাই নারী পুরুষ উভয়কেই মনে রাখতে হবে এমন কিছু করা যাবে না যাতে আমার বন্ধু কষ্ট পেয়ে সম্পর্কটাই শেষমেষ ভেঙে যায়। নারীর অবদমন নারীকেই ভাঙতে হবে, একটা সুন্দর নারী দেখলে যদি পুরুষ তাকায় তবে সুন্দর পুরুষ দেখলেও নারীর ঘাড় ফিরিয়ে তাকাতে দোষ কোথায়?
বালিকা বিদ্যালয়, মহিলা কলেজ, সংরক্ষিত আসন, আলাদা জিম সব তুলে দিতে হবে, সব। নারী পুরুষ একসাথে স্কুলে যাবে, একই সেলুনে চুল কাটাবে, একসাথে সাইকেল চালাবে, অফিস করবে, মিছিল করবে, স্লোগান ধরবে। পুরুষের চেয়ে নারীর স্তন একটু স্ফীত এর বাইরে আর কি আলাদা আপনার চোখে পড়ে বলুন তো? এই প্রাকৃতিক গড়নের জন্য এতো বৈষম্য! এটা আলাদা কোন চেরাগ না। লোভ, আকৃষ্টতা, কাম সব আমাদের মগজে, নারীর শরীরে না। আর এই মানসিক ক্যান্সার সারাতে হলে নারী-পুরুষ বা এক শব্দে মানুষের কাজ করতে হবে।
ধর্ম নিয়ে শুধু এটুকু বলবো আপাতত, ধর্ম হলো শোষণের সবচেয়ে সফল মারণাস্ত্র। যা কিছু সভ্য সমাজ স্বীকৃতি দিতে অস্বীকার করবে তা হাতের মুঠোয় পেতে সহজ বর্ম হলো ধর্ম। এবং আরো মনে রাখতে হবে, যা সংস্কারযোগ্য নয় তা গ্রহণযোগ্যও নয়।
নারী আন্দোলন হচ্ছে, হবে এবং মজার ব্যপার হলো নারী আন্দোলনের অগ্র সৈনিকদের বেশিরভাগ নারীরাই উল্টো বুঝে। এ দোষ অবশ্য পুরো তাদের নয়, সে জন্য আগের বলা কারণগুলোই দায়ি।
নারী আক্রমণের প্রধান অস্ত্র হলো তার চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন তোলা। এই দেশে দুর্নীতি, হত্যা, লুট, ঘুষ কোন কিছুতেই চরিত্র যায় না, চরিত্র যায় ভালোবাসায়। লড়াই হচ্ছে, লড়াই আরো জোরদার হবে, সামনের দিনগুলোতে অজস্র সৈনিক আমরা মাঠে পাবো। এ লড়াইয়ে অনেক চড়া মূল্য দিয়েই জিততে হবে। অভিবাদন সেইসব নারীদের যারা ইতোমধ্যে চড়া মূল্য দিয়েছেন, দিয়ে যাচ্ছেন একটা মানুষের পৃথিবীর জন্য। সকল মানুষকে নারী দিবসের শুভেচ্ছা।
লেখক: শিল্পী ও অ্যাক্টিভিস্ট