মৃত্যুর বৈধকরণ সংস্কৃতি ও সমূহ বিপদ
প্রকাশ | ২৭ জানুয়ারি ২০১৭, ০১:১২
গত কয়েকমাস ধরে সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছি। সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছি ভেজিটারিয়েন হবো কী না তা নিয়ে। গত ঈদে সারাদিন বৃষ্টি ছিল। অফিসে যাবার সময় দেখলাম বাসার আশেপাশে জবাই হচ্ছে এমন গরু-ছাগলের রক্তে ভেসে যাচ্ছে চারপাশ। যেসব পশু জবাই হচ্ছে তাদের ধড়ফড়ানি দেখে আমার চোখ দিয়ে জল পড়ছিল। আমি চোখ মুছতে মুছতে চলে আসলাম। অফিসে এসে গরুর মাংস আর পোলাও, সাথে মুরগী এমন আয়োজন। জবাইকৃত প্রাণী ছাড়া খাবার-দাবার আর কিছু নাই। ইচ্ছে করছিল, না খেয়ে চলে আসি। আমি প্রাণীহত্যা সহ্য করতে পারি না, সেই আমি আবার প্রাণীর গোশত না খেয়েও থাকতে পারি না। বিষয়টা ঠিকঠাক হজম করতে পারি না। খেতে বসলে চাপাচাপা লাল রক্ত, তাদের কাটা মাথা, গোঙানিতে আমি আরো সিদ্ধান্তহীনতায় পড়ে যাই, খারাপ লাগে। কিভাবে কী করব, দোটানায় পড়ে যাই।
সকালে বড় একটা গ্রুপে পোস্ট দিয়েছিলাম কুকুর নিধন প্রসঙ্গে। চট্টগ্রামের কয়েকটা স্থানে সিটি কর্পোরেশন কোন আইন-কানুনের তোয়াক্কা না করে কুকুর নিধন কর্মসূচি চালাচ্ছেন। ঘটনার যথার্থতা এবং সত্যতা কতখানি তা জানার জন্যই মূলত পোস্টটা দিয়েছিলাম। এরপর শুরু হল আক্রমণ। কেউ কেউ বললেন কুকুর মানুষকে কামড়াচ্ছে তাই কুকুর নিধন ঠিক আছে। কেউ কেউ বললেন তাবৎ শহরে কুকুরের যা সংখ্যা তাতে মানুষের হাঁটাচলায় বিড়ম্বনায় পড়তে হচ্ছে। আবার অনেকে বলছেন, নিজের বাড়ির পোষা কুত্তার অভিজ্ঞতা নিয়ে ম্যাডামে মানবাধিকার/প্রাণী অধিকার ফলাইতে আসছে। একজন বলল নারী জাতির মাথা-মোটা এটাই তিনি প্রমাণ করতে আসছেন। কয়েকজন পরামর্শ দিলেন এ দেশে প্রতিদিন অনেক মানুষ না খেয়ে রাস্তায় পড়ে থাকে, বিনা চিকিৎসায় মরে যায় তাদের জন্য কি আপার কষ্ট হয় না? কুত্তা-বিলাইকে আপায় মানুষের চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ ভাবতেসে।
আমি একটা কমেন্টেরও জবাব দেই নি। দেই নি কারণ, ওখানে সবাই আমাকে জাজ করছিলেন; আমার সম্পর্কে কিচ্ছু না জেনেই। একজন তো বলেই ফেললেন দামি ফ্ল্যাট আর বিলাসবহুল গাড়ি চড়ে কুত্তা-বিলাই নিয়ে কান্নাকাটি করা আর বাস্তব জীবন পুরোপুরিই আলাদা। আমি কিছুক্ষণ কমেন্টটার দিকে তাকিয়ে ভাবলাম, এদের সাথ কথা বাড়িয়ে কী লাভ? এরা তো জানেই না পাবলিক বাসে দাঁড়িয়ে আমি অফিস-বাসাসহ পুরো শহরেই যাতায়াত করি। রাস্তার কুকুর-বিড়ালের মাথায় হাত বুলিয়েই আমি ওদের ভালবাসি, আমার বাড়ি-ঘরে কোন পোষাপ্রাণী নেই।
মৃত্যুকে কখনো কোনভাবে বৈধকরণ করা যায় না, কোন মৃত্যুকেই নয়। আজ যখন কুকুর মেরে ফেলার পক্ষে কথা বলতে গিয়ে মানুষ আর কুকুরে পার্থক্য আছে বলেই খারাপ মানুষকে মেরে না ফেলে জেল-হাজতে পাঠাতে বলছেন, তারাই কিন্তু মানুষের ফাঁসির আদেশে মিষ্টিমুখ করেন। মৃত্যু যেমনই হোক, কঠিন-সহজ যাই হোক অপরাধ করলে শাস্তি পাবে এমন নিয়ম হলে মেনে নেওয়া যায় হয়ত কিন্তু সেই মৃত্যুকে নিয়ে উল্লাস করলে সেটা অমানবিক হয়। আজকে কুকুর নিধনকে বৈধকরণ করতে মনে বাধে না, গতকাল চোর-বাটপার বলে মাথা কেটে ফেলে নির্মম হত্যাকে বৈধকরণ করতে খারাপ লাগে না, তার আগেরদিন বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া শিক্ষার্থীকে নাস্তিক বলে কোপানোর সময়ও কারো মাথা-ব্যাথা হয় না, তারও আগের দিন খাবারের দোকান থেকে খাবার চুরির অপরাধে ৮ বছরের বাচ্চাকে পিটিয়ে মারা হল তখনও কারো ভাবান্তর হল না। এসব দেখি আর ভাবি, কোনকছিুকে হত্যা করা আমাদের কাছে কত যুক্তিহীন আর সহজ! যুক্তি ছাড়াই নিজেদের খেয়াল-খুশিমতো যে কাউকে, যেকোন কিছুকে আমরা মেরে ফেলার পেছনে যুক্তি দিতে পারি।
কয়েকদিন আগে এক পুরনো সহকর্মী কথায় কথায় বললেন ‘আগে মানুষকে ভালবাসেন, তারপর পশুপাখিকে ভালবাসতে পারলে পরে বাসবেন’। আমি কিছুক্ষণ ভাবলাম। সত্যি কি এমন কিছু হওয়া উচিত? আমাদের ভালবাসা মাত্র এক বয়াম, বয়াম থেকে একটু করে করে মানুষকে ভালবাসতে বাসতে যদি শেষে কিছুটা ভালবাসা তলানিতে পড়ে থাকে তব সেটা প্রাণীদের জন্য রাখতে পারি? না হলে নয়। যদিও আমি জানতাম প্রত্যেকটি সৃষ্টিকেই মানুষের ভালবাসা উচিত, আমার হঠাৎ মনে হল এরকম বয়ামবন্দী মাত্র এক বয়াম ভালবাসা নিয়ে তাহলে কীভাবে সমগ্র সৃষ্টিকে ভালবাসা সম্ভব?
পৃথিবীতে কয়জন মানুষ কুকুর দ্বারা খুন আর কতজন মানুষ যে মানুষ দ্বারা খুন সে হিসেব করতে গেলে সবাই উন্মাদ, পাগল তকমা এঁটে দেবে। কিন্তু কুকুর মানুষকে কামড়ায় এমন যুক্তিতে যদি কুকুর নিধনকে বৈধ ঘোষণা করা হয়; মানুষ যে মানুষকে খুন করে, আহত করে এমন যুক্তিতে মানুষ নিধন প্রকল্পে সবার অনীহা থাকার কারণও নেই তাহলে!
অজগর ভয়ানক একটা সরীসৃপ, মানুষকে একবার কামড়ালে বেচারা প্রাণবায়ুর নিশ্চিত নির্গমন। বাঘও মাংশাসী, মানুষকে খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করবে না এমন লিখিত কোন প্রজ্ঞাপণ বাঘ-সিংহ কেউই দেয় নি। তাহলে অজগর, বাঘ, সিংহকেও মেরে ফেলার চিন্তা করতে সুবিধা হয় কি? হয় না সম্ভবত। কারণ বন্যপ্রাণী রক্ষা আইন ২০১২ এর কারণবশত ফেঁসে যাবেন।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসেবে, বিশ্ব জুড়ে কুকুরের কামড়ে জলাতংক রোগে আক্রান্ত হয়ে বছরে ৫০ হাজারের বেশি মানুষ মারা যায়। এই হারকে কমিয়ে আনা, এমনকি নিশ্চিহ্ন করে দেয়ার উদ্যোগে অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও কুকুরকে ভ্যাক্সিন দেয়া, তাদের জন্মনিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা রয়েছে। ২০১২ সাল থেকে ‘অভয়ারণ্য’ নামের একটি সংস্থা ঢাকায় ১০ হাজারের মতো কুকুরকে জন্মনিয়ন্ত্রণের আওতায় এনেছে৷ এবং মেরে না ফেলে সবকিছুরই একটা সহজ-সুন্দর সমাধান আছে।
বাংলাদেশে প্রচলিত ‘ক্রুয়েলটি টু অ্যানিমেল অ্যাক্ট-১৯২০'-তে বলা হয়েছে, ‘যদি কেউ পশুকে দিয়ে ক্ষমতার চেয়ে বেশি ভার বহন করায়, বিনা কারণে কোনো পশুর প্রতি নির্দয় আচরণ করে, প্রহার করে অথবা এমনভাবে বেঁধে রাখে বা বহন করে, যাতে নির্দয় আচরণ স্পষ্ট হয় অথবা নির্দয় আচরণের কারণে কোনো পশুর মৃত্যু হয়, তাহলে এর জন্য দায়ী ব্যক্তির সর্বোচ্চ তিনমাসের জেল এবং ১০০ টাকা জরিমানা হতে পারে৷' তবে এই শতবর্ষ পুরনো আইন আর নামমাত্র জরিমানা পশুপাখির জন্য কতটা উপকারী সে বিষয়ে সবারই সন্দেহ রয়েছে।
গত চার বছর ধরে কুকুর নিধন বন্ধ বাংলাদেশে৷ এছাড়া উদ্যোগ নেয়া হয়েছে কুকুরের জন্মনিয়ন্ত্রণের৷ এই কাজে সিটি কর্পোরেশনকে সহায়তা করছে ‘অভয়ারণ্য'৷ এ নিয়ে একটি সমঝোতা স্মারকও সই হয়েছে৷ কিন্তু আশঙ্কার কথা এই যে আইন করে অনেক কিছুরই লাগাম টেনে দেওয়া সম্ভব। কিন্তু মানুষের মন যদি শক্ত হয়ে যায়, প্রত্যেকটি মৃত্যুকেই যদি যে যার মতো বৈধকরণ করতে থাকে তাহলে বিপদ। শুধু বিপদ নয়, মানবতা বিপন্ন-বিপর্যয়ের মতো বিপদ।
আমি তাই সৃষ্টি-বান্ধব। ভেজিটারিয়েন হবার চেষ্টায় আছি। কবে সফল হবো জানি না, নিশ্চয়ই কোন একদিন তো হবোই। সকল ক্রুয়েলটির বিরুদ্ধে তৈরি হোক শক্ত অবস্থান, আমরা সৃষ্টি ভালবাসি।
বিথী হক এর ফেসবুক থেকে