আমি মেয়ে তাই পারি না !
প্রকাশ | ১৩ ডিসেম্বর ২০১৬, ০১:৫৩
আমি মেয়ে তাই পারি না
আমি মেয়ে তাই সমাজ আমাকে চেপে রাখে
আমি মেয়ে বলে আমাকে দিয়ে কিছুই হবে না
সংসারের চাপে স্বপ্ন মরে গেছে
২৫ পেরিয়েছে , বুড়া হয়ে গেছি
প্রচণ্ড হতাশার এই লাইনগুলো বহুবার শুনেছি এবং রোজ শুনছি। বিয়ের আগে একটু আধটু উড়াউড়ির চেষ্টা থাকলেও বিয়ের পরে নিরানব্বই ভাগ বাঙালী মেয়েরা ধরেই নেয়, তাদের জীবনে আসলে সাংসারিক দায়িত্বের বাইরে আর কোন কিছু করার নেই। যারা চাকরী করেন তাদের কাছে চাকরিটাও সংসার সচ্ছল রাখা, সামাজিকভাবে খানিকটা সম্মান কিংবা বাড়তি আয়ের একটা মাধ্যমে পরিণত হয়। সেখানে নিজের ইচ্ছে কিংবা আনন্দের জায়গাটা মুখ্য হয় না কখনোই। আমার এক প্রাক্তন কবি বান্ধবীকে প্রায়ই আক্ষেপ করতে শুনি, নয়টা-ছয়টা ব্যাংকের ঘানি টানা স্বপ্ন না রে, শুধুই দায়িত্ব। এখানে কবি হবার সুযোগ কই?
বহুবার ভেবেছি আসলেই কি বিয়ের পরে সব কিছু থেমে যায়? চাইলেই কি বাধা পেড়িয়ে আকাশ ছোঁয়া অসম্ভব?
এই প্রশ্নের উত্তরে মনে পড়ে গেল কিংবদন্তি নায়িকা সুচিত্রার কথা। হিন্দু রক্ষণশীল পরিবারের বউ হয়ে এসেছিলেন, এক সন্তানের জননী হয়েও রীতিমত সংগ্রাম করে রুপালী পর্দায় পা রেখেছিলেন। তখনকার সময়ে উচ্চবংশীয় নারীদের জন্য সিনেমায় অভিনয় করা রীতিমত যুদ্ধে জয়ের মত কঠিন ছিল। তার উপরে বিবাহিতা নারীদের জন্য 'অসম্ভব' শব্দটাই সত্যি ছিল। কিন্তু সুচিত্রা এই নিয়ম ভেঙেছিলেন। তার উপরে নায়িকা মানেই যে অবিবাহিত খুকি চরিত্র, সেই ধারণা ভেঙে চুরচুর করে ৪০ বছর পর্যন্ত দর্শকদের কাছে সর্বকালের জনপ্রিয় নায়িকা হিসেবে অভিনয় করে গেছেন। বাংলা সিনেমায় এত জনপ্রিয় নায়িকা আর কখনো আসেনি হয়ত আসবেও না।
এবার কেউ কেউ নাক উঁচিয়ে বলতেই পারেন, সে তো সিনেমার ক্ষেত্রে, আর কোন ক্ষেত্রে নারী এত বাধা অতিক্রম করে স্বপ্ন ছুঁয়েছে শুনি?
আচ্ছা ঠিক আছে, এবার তবে নারী জাগরণের পথিকৃৎ বেগম রোকেয়ার উদাহরণ-ই না হয় দেই। বেগম রোকেয়া পুরুষ নিয়ন্ত্রিত, রক্ষণশীল পরিবারে জন্মেছিলেন। তার বাবা চার বিয়ে করেছিলেন, তার মধ্যে এক বউ তো আইরিশ ছিলেন যদিও সেই সংসার বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। প্রচণ্ড পুরুষ শোষিত পরিবারে বেড়ে ওঠায় নিজের ইচ্ছা বলে যে তার কিছু ছিল না তার প্রমাণ বিবাহিত, এক বাচ্চার জনক , মধ্য বয়স্ক এক পুরুষকে স্বামী হিসেব গ্রহণ করতে হয়েছিল তার। ভাগ্য খানিকটা ভাল ছিল বিধায় স্বামী সাখাওয়াত হোসেন বিলেত ফেরত হওয়ায়, তার মানসিকতা তৎকালীন রক্ষণশীলতাকে অতিক্রম করেছিল। তখন অবশ্য বিলেত ফেরত উচ্চশিক্ষিত বহু পুরুষ ছিল কিন্তু তার সধর্মিণীরা কেউ রোকেয়া হয়নি। অথচ সামান্য অক্ষরজ্ঞান সম্পন্ন মেয়েটি পরবর্তীতে ইংরেজির মত কঠিন ভাষা রপ্ত করেছিলেন, সাহিত্যের বাঁকগুলো অতিক্রম করেছিলেন নিজ মেধা আর চেষ্টায়। মোল্লাদের ফতোয়া আর সমাজের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে রচনা করেছেন 'আমাদের অবনতি' শীর্ষক সাহসী প্রবন্ধ, 'জ্ঞানফল' এর মত অসাধারণ লেখা। এত প্রতিকূল সমাজ রোকেয়াকে দমাতে পারেনি।
এবার নিন্দুকেরা বলবেন বুঝলাম, কিন্তু আন্দোলন সংগ্রাম এর ক্ষেত্রে নারীদের উদাহরণ কি? বাধা পেরিয়ে কোন যোগ্য আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছে নারী এমন কোন উদাহরণ টানুন তো। অনেক অনেক আছে, তবুও খানিকটা ভাবলাম, তারপর খুব যত্নে লিখলাম 'জাহানারা ইমাম'।
১৯৪৭ এ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিএ পাশ করেছিলেন। জীবন শুরু করেছিলেন খুব সাধারণ বাঙালি মেয়ের মতই। স্বামী সংসার বাচ্চা আর শিক্ষকতার সরল জীবন। তারপর ৭১ থেকে ৯৪ পর্যন্ত তার আন্দোলনের, তার সংগ্রামের ইতিহাসটা কারো অজানা নয়। স্বামী সন্তান হারানোর যন্ত্রণা চেপে বাঙালি ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর শত্রুদের বিরুদ্ধে যে লড়াই তিনি করেছেন, আজ তার সুফল পাচ্ছি আমরা।
নারী লক্ষ্মী, নারী সরস্বতী, নারী দুর্গা নারী কালীর রূপ। কোন বাধাই নারীকে দমিয়ে রাখতে পারে না যদি নারী চায়। প্রত্যেক নারীর পিঠেই একটা অদৃশ্য ডানা থাকে, সেই ডানাকে যত্ন করে, চেষ্টা আর মেধা দিয়ে উড়ার উপযোগী করতে হয়। বিয়ের আগে কিংবা পরে নারীর মেধার কোন পরিবর্তন হয় না, বিয়ের আগে যে মেয়েটি সিনেমা বানাবে বলে স্বপ্ন দেখত, বিয়ের পরেও সে, সে-ই একই মেয়ে থাকে।
সংসার নামক বন্ধন কে বাধা ভাবলেই স্বপ্ন মরে যায়। কিন্তু ইচ্ছা আর চেষ্টা থাকলে স্বপ্ন ডানা মেলবেই। শুধু দরকার সঙ্কল্প, এক দিন সকালে ঘুম থেকে উঠেই প্রতিজ্ঞা করতে হয়
'আজ থেকে আমি আমার স্বপ্নের পেছনে ছুটবো, যদি কবি হতে চাই তবে আজই লেখা শুরু করবো, যদি সিনেমা বানাতে চাই তবে আজ-ই পড়া শুরু করবো, ছোট্ট মোবাইলটা দিয়ে ভিডিও করা শুরু করবো আর শিখবো কি করে সিনেমা বানাতে হয়। যদি নায়িকা হতে চাই তবে অভিনয় শিখবো, নিজেকে গড়ে নেবো আজ থেকে।'
স্বপ্ন দেখো মেয়ে, এক জীবনে যা করার করে যেতে হবে। অথর্ব, অনর্থক জীবন কাটিয়ে কি লাভ? তোমার মৃত্যুতে যদি সমস্ত দেশ হাহাকার না করে, যদি জাতিকে নিজের মেধা দিয়ে কিছু দিতেই না পারো, তবে তোমার জীবনের সাথে ঐ ফার্মের মুরগিটার জীবনের তফাৎ কি রইলো?
চেষ্টা করেই দেখো। পারলে ভালো, না পারলেও ক্ষতি নেই, অন্তত নিজেকে বলতে পারবে আমি চেষ্টা করেছি। আমি লড়ে হেরেছি, এটাও আমার প্রাপ্তি।
ফড়িং ক্যামেলিয়া'র ফেসবুক থেকে