‘সেক্স এডুকেশন’কে হ্যাঁ বলুন
প্রকাশ | ১১ ডিসেম্বর ২০১৬, ১৫:৪৮ | আপডেট: ১১ ডিসেম্বর ২০১৬, ১৫:৫৯
আমরা কি নিজেদের শরীরকে চিনি? আমরা কি জানি আমাদের শারীরিক পরিবর্তন কেন বা বয়সের কোন সময়ে হয়? আমরা কি বুঝি যে কী কারণে শারীরিক পরিবর্তনের সাথে সাথে আমাদের মানসিক অবস্থারও পরিবর্তন ঘটে? এমন আরও বহু প্রশ্ন আছে যার উত্তর এক কথায় দেওয়া সম্ভব আর তা হচ্ছে ‘সেক্স এডুকেশন’।
আমার নিজের এক আত্মীয়ের কথা মনে পড়ছে। ছেলেটি তখন সবে প্রাইমারি শেষ করে সেকেন্ডারি পর্যায়ে উঠেছে। একদিন তার মোবাইলের গ্যালারি অপশন ঘাঁটতে গিয়ে দেখলাম ছেলেদের প্রাইভেট পার্টের ছবি তোলা হয়েছে! বুঝলাম ছেলেটির ভেতরে তার শারীরিক পরিবর্তন নিয়ে কৌতূহল তৈরি হয়েছে। সে সময়টায় আরও একদিন তার ব্যবহার করা ল্যাপটপের সার্চ অপশনে গিয়ে দেখলাম ‘penis’ সার্চ দেওয়া হয়েছে। দেখে একেবারেই বিস্মিত হইনি। কারণ আমি জানি এ বয়সে এটাই স্বাভাবিক। ছেলেটিকেও আমার ইঁচড়ে পাকা বলে মনে হয়নি বরং মনে হয়েছে সে তার কাছের অভিভাবকদের কাছ থেকে কোনও তথ্য জানতে না পেরে বা সংকোচে জিজ্ঞেস করতে না পেরেই সার্চ দিয়েছে। পুরো ব্যাপারটাকে আমার কাছে সাধারণ কৌতূহল নিবারণের প্রচেষ্টা বলেই মনে হয়েছে।
এতো গেলো বয়ঃসন্ধিকালের পর্যায়ে নিজের শারীরিক পরিবর্তনের সঙ্গে স্ট্রাগেল করে চলা একটা ছেলের অবস্থা। আমি একজন প্রাপ্ত বয়স্ক মহিলার কথা জানি যিনি বিয়ের পর গর্ভধারণের পরেই জানতে পেরেছিলেন মেয়েদের ‘vagina’ এবং ‘urethra’ দুটো শরীরের আলাদা পার্ট। এখন এই মহিলাকে কী বলবো? গাধা? অজ্ঞ? অশিক্ষিত?
আসলে শরীর সম্পর্কে কৌতূহল তৈরি হওয়াটা একটা সাধারণ বিষয়। কিন্তু কৌতুহল তৈরি হওয়ার পর সে বিষয়ে কিছুই না জানা, চেষ্টা না করা বা জিজ্ঞেস করার প্রতিবন্ধকতাকে আমি সাধারণ ঘটনা বলবো না। এটা অস্বাভাবিক। নিজের শরীর সম্পর্কে জানতে হবেই। আর সেটা যখন বয়সের সঙ্গে সঙ্গে ঘটে চলে তখনই জানতে হবে। অভিভাবকদের জানতে হবে বয়সের কোন পর্যায়ে কী ধরনের পরিবর্তন হয়। এক্ষেত্রে কেবল শারীরিক পরিবর্তন সম্পর্কে জানলেই চলবে না বরং বয়সের সঙ্গে সঙ্গে মানসিক অবস্থার পরিবর্তন সম্পর্কেও জানতে হবে। আর অভিভাবকরা এসব তথ্য জানতে বই পড়বেন, ইন্টারনেটে সার্চ দেবেন।
আসলে এ বিষয়ে কেবল অভিভাবকরাই বলবেন এমন নয়। স্কুলের শিক্ষকদেরও এ বিষয়ে জানাতে হবে। নানা আলোচনা, বৈঠক বা স্কুল মিটিং এর মাধ্যমে শারীরিক পরিবর্তনের গুরুত্ব সম্পর্কে বোঝাতে হবে। এটা যে একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এবং ক্লাসরুমে ছেলেমেয়েদের পড়াতে পড়াতে যে অন্যান্য সকল পরিবর্তনের দিকগুলোও নজরদারির মধ্যে রাখতে হয় সে সম্পর্কে সচেতনতা তৈরি করতে হবে। আর এ সকল বিষয়ে সচেতনতা তৈরির সব থেকে বড় হাতিয়ার হলো পাঠ্য বিষয়ে সেক্স এডুকেশন সম্পর্কে বিশদভাবে উল্লেখ করা।
আমি যখন ক্লাস নাইনে পড়ি তখন ক্লাসে শিক্ষিকা রোমিও ও জুলিয়েটের গল্প পড়ে শোনাচ্ছিলেন। পড়ানোর পর্যায়ে শেষ দৃশ্যে রোমিও জুলিয়েটের ঠোঁটে চুমু খায়; এ দৃশ্যটি পড়াতে গিয়ে আমি তার মধ্যে জড়তা দেখতে পেয়েছিলাম। এখন বুঝি এমন ধারার শিক্ষক যে কিনা ক্লাসরুমে সাধারণ এক শব্দ ‘চুমু’ উচ্চারণ করতে সংকোচ বোধ করেন তারা কিভাবে সেক্স এডুকেশন নিয়ে ক্লাসরুমে পড়াবেন? এদের তেমন প্রস্তুতিইতো নেই!
সেক্স এডুকেশন আসলে কেবলমাত্র একজন ছেলে ও মেয়ের মধ্যকার শারীরিক সম্পর্ক নিয়ে কথা বলে না! এটা ছেলেমেয়েদের মধ্যকার শারীরিক পরিবর্তন সম্পর্কেও বিশদভাবে আলোচনা করে। আমার মনে পড়ে প্রথম মাসিকের দিনের কথা। কী ভয়টাই না পেয়েছিলাম হঠাৎ রক্তের স্রোত দেখে! কিন্তু আগাম প্রস্তুতি থাকলে এই ভয়টা কিন্তু আর তৈরি হয় না। আসলের আতংকের এই জায়গাটাতেইতো আমাদের কাজ করতে হবে। শেখাতে হবে। সেজন্যেই কিন্তু সেক্স এডুকেশন।
ধরুন আপনার মেয়েকে স্কুলে পাঠালেন। কোনও কারণে হঠাৎ দুর্ঘটনায় বাচ্চা পেটে চলে আসলো। তখন কী করবেন? মনে রাখবেন আমি এখানে নারী ও পুরুষের মধ্যকার অবাধ মেলামেশাকে প্রশ্রয় দিচ্ছি না। আমি বলছি সচেতনতার কথা। দুর্ঘটনা ঘটতেই পারে। বয়ঃসন্ধিকালের সময়টাতেই এমন ঘটনা ঘটে সব চাইতে বেশি কারণ নিজের আবেগের ওপরে নিয়ন্ত্রণ এ সময়টাতে থাকে না।
কাজেই সেক্স এডুকেশনের বিকল্প নেই। এ শিক্ষা শরীর ও মন দু’ সম্পর্কেই জানায়। আসল বিষয় হলো প্রস্তুতি। সময়ের একটু আগেই যদি পরিবর্তনের বিষয়গুলো নিয়ে খোলামেলা আলোচনা করা যায় তাহলে অকারণ দুর্ঘটনা ঘটার সম্ভাবনা থাকে খুব কম। এখন এ সম্পর্কে বোঝাতে বাবা-মা খুব আনুষ্ঠানিক ভঙ্গি নিয়ে বসবেন এমন নয়। বরং গল্পের ছলে, ঘটনা দিয়ে, তথ্য দিয়ে ছবি দেখিয়ে এগুলো সম্পর্কে সন্তানকে ধারণা দেবেন। সন্তানের সঙ্গে বন্ধু সুলভ সম্পর্ক তাই সবার আগে তৈরি করতে হবে। এমন সম্পর্ক হতে হবে যাতে করে তারা তাদের অভিভাবকদের ওপরে আস্থা রাখে। বিশ্বাস করে। বয়ঃসন্ধিকালের সময়টা বড় বাজে। কারণ সন্তানকে সতর্ক দৃষ্টি দিতে হবে তবে তাই বলে ২৪ ঘণ্টা নজরদারি নয়। তাহলেই বাবা-মায়ের প্রতি অভক্তি তৈরি হবে।
আসলে সব থেকে বড় বিষয় হলো সচেতনতা তৈরি করা। বয়ঃসন্ধিকালের সময়টাতে সচেতনতা তৈরিতে সেক্স এডুকেশনের চাইতে সত্যিই আর কোনও মহোষধ নেই! তাই চলুন সকলেই সচেতন হই। সকলে মিলে একসাথেই সেক্স এডুকেশনকে ‘হ্যাঁ’ বলি।
লেখক: শিক্ষা গবেষক
সূত্র: বাংলা ট্রিবিউন