বেগম রোকেয়া থেকে তসলিমা: নন্দিত ও নিন্দিত
প্রকাশ | ১১ ডিসেম্বর ২০১৬, ১৫:২১ | আপডেট: ০৯ ডিসেম্বর ২০১৯, ১৫:৫০
৯ ডিসেম্বর। নারী জাগরণের অগ্রদূত বেগম রোকেয়ার জন্ম ও মৃত্যু দিবস। বেগম রোকেয়া ও তসলিমা নাসরিন উভয়েই নারীর অধিকারের পক্ষে কথা বলেছেন। বেগম রোকেয়া তাঁর সময়কালে পুরুষতান্ত্রিক সমাজের নিন্দা কুড়িয়েছিলেন, বর্তমানে তসলিমা নাসরিন কুড়াচ্ছেন। তসলিমা নাসরিন ও বেগম রোকেয়ার লেখার মূল অর্থ এক হলেও তসলিমা নাসরিন বাংলাদেশে একটি নিষিদ্ধ নাম আর বেগম রোকেয়া মুসলিম নারী জাগরণের অগ্রদূত হিসেবে সম্মানিত। পাঠ্যবইয়ে বেগম রোকেয়ার বাছাই করা কিছু লেখা অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। রোকেয়া হল, রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। নারী অধিকারের পক্ষে তসলিমা নাসরিনের কোনও লেখা উল্লেখ করলে লোকে বলে তসলিমা নয় বেগম রোকেয়া পড়ো। বেগম রোকেয়াকে অনুসরণ করো। বেগম রোকেয়াকে আমাদের সমাজে একজন মুসলিম নারীর ইমেজ দেয়া হয়েছে। ঘোমটা পরা, স্বামী-পিতা-ভাইদের সকল আদেশ মাথা পেতে নিয়ে কেবল স্কুলে যাওয়ার অধিকার চায় এমন। যদিও বেগম রোকেয়ার বই গুলো ঘাঁটলে তাঁর লেখা ভয়ংকর সব সত্য বেরিয়ে আসে- ধর্ম সম্পর্কে, পুরুষ সম্পর্কে। এতে বোঝা যায় রোকেয়া ও তসলিমার আদর্শ ভিন্ন নয় বরং এক।
বেগম রোকেয়া মৃত। তসলিমা জীবিত। জীবিত তসলিমাকে কবর দিতে মৃত বেগম রোকেয়াকে টেনে আনা হয় নিজেদের মত করে। ভবিষ্যতে হয়তো নতুন কোনও প্রতিবাদী নারী আসবে যাকে নিষিদ্ধ করতে তসলিমাকে হিজাব পরিয়ে মুসলিম নারী সাজানো হবে। একথা তসলিমা নাসরিন তাঁর ‘সেই সব অন্ধকার’ বইটিতেও উল্লেখ করেছিলেন।
তসলিমা নাস্তিক, বেগম রোকেয়া আস্তিক। কাজেই বেগম রোকেয়াকে আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করা যায়। এরকম একটি ধারণা প্রচলিত আছে। চলুন দেখি বেগম রোকেয়া ধর্ম সম্পর্কে কী লিখে গেছেন-
"আমাদিগকে অন্ধকারে রাখিবার জন্য পুরুষগণ ঐ ধর্মগ্রন্থগুলিকে ঈশ্বরের আদেশপত্র বলিয়া প্রকাশ করিয়াছেন।... তবেই দেখিতেছেন, এই ধর্মগ্রন্থগুলো পুরুষ রচিত বিধি ব্যবস্থা ভিন্ন আর কিছুই নহে। ...কোন স্ত্রী মুনির বিধানে হয়তো তাহার বিপরীত নিয়ম দেখিতে পাইতেন।..যেখানে ধর্মের বন্ধন অতিশয় দৃঢ় সেইখানে নারীর প্রতি অত্যাচার অধিক।..." ( গ্রন্থঃ মতিচুর)
এখানে স্পষ্টভাবে বোঝা যায় রোকেয়া ঈশ্বরের অস্তিত্বে বিশ্বাস করতেন না। বেগম রোকেয়ার মত তসলিমা নাসরিনও মনে করেন, ধর্ম হল নারীকে দমনের উদ্দেশ্যে পুরুষের সৃষ্ট কিছু বিধান। যেখানে ধর্মের প্রভাব বেশি সেখানে নারীর প্রতি অত্যাচারও বেশি। এ কথা রোকেয়া বলেছিলেন, তসলিমা তাঁর বিভিন্ন লেখায় নানান তথ্য হাজির করে প্রমাণও করেছেন।
‘অলঙ্কার না Badge of Slavery’ প্রবন্ধে রোকেয়া লিখেছেন “ধর্মগ্রন্থসমূহ ঈশ্বর-প্রেরিত বা ঈশ্বরাদিষ্ট নহে। যদি ঈশ্বর কোন দূত রমণী শাসনের নিমিত্ত প্রেরণ করিতেন, তবে সে দূত কেবল এশিয়ায় সীমাবদ্ধ থাকিত না। ... যে কথা পুরাকালে অসভ্য বর্বরগণ বিশ্বাস করিয়াছিল, তাহা বর্তমান কালের সুসভ্যগণ যদি বিশ্বাস করেন, তবে সভ্যতা ও অসভ্যতায় প্রভেদ কি? যাহা হউক আমরা আর ধর্মের নামে নতমস্তকে নরের প্রভুত্ব সহিব না।”
ঈশ্বরে অবিশ্বাসীদের মধ্যে যারা পুরুষতান্ত্রিক চেতনায় বিশ্বাসী তাঁরা মনে করেন তসলিমা নাসরিন পুরুষ বিদ্বেষী, আর রোকেয়া তেমনটা নন। কাজেই রোকেয়া অনুসরনীয়, তসলিমা বর্জনীয়। আসুন দেখি পুরুষ সম্পর্কে রোকেয়া কী বলেছেন-
১. নারী যাহা দশ বৎসরে করিতে পারে, পুরুষ তাহা শতবর্ষেও করিতে অক্ষম।
২. নারীস্থানে স্বয়ং শয়তানকেই (পুরুষ জাতি) শৃঙ্খলাবদ্ধ করিয়াছেন, দেশে আর শয়তানী থাকিবে কি রূপে? (সুলতানার স্বপ্ন, ১৩৪)
৩. তাহারা কিছুই করিবে না- তাহারা কোন ভালো কাজের উপযুক্ত নহে। তাহাদিগকে ধরিয়া অন্তঃপুরে বন্দি করিয়া রাখুন। (সুলতানার স্বপ্ন, ১৩৫)
৪. কুকুরজাতি পুরুষাপেক্ষা অধিক বিশ্বাসযোগ্য। (ডেলিশিয়া-হত্যা)
যারা পুরুষতন্ত্রকে মনেপ্রাণে ধারণ করে, তারা সাধারণত পুরুষ আর পুরুষতন্ত্র’কে আলাদা করতে পারেন না। তাই তারা নারীবাদ বলতে বুঝেন পুরুষ বিদ্বেষ। ইদানীং অনলাইনে নারীবাদ নিয়ে কিছু লিখলেই সেসব পুরুষেরা স্লোগান তুলেন, ‘সব পুরুষ এক নয়’। নিজেকে এক মনে না করলে, ভিন্ন মনে করলে সেসব কথা নিজের গায়ে না লাগালেই পারেন। হাতে গোনা কয়েকজন ভালো পুরুষ আছেন অবশ্যই। যারা সমানাধিকারে বিশ্বাস করেন, নারী অধিকারে বিশ্বাস করেন। কিন্তু ভূষির বস্তায় দু এক দানা চাল পাওয়া গেলেই তো আর সেটা চালের বস্তা হয়ে যায় না বা সে চালগুলোর কথা আলাদা ভাবে উল্লেখ করতে হয় না। তসলিমা’কে বর্জনের ক্ষেত্রে সুশীল সমাজের একটি হাস্যকর যুক্তি হল, বেগম রোকেয়া মেয়েদের জন্য স্কুল করেছে, ঘরে ঘরে গিয়ে মেয়েদের শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা অভিভাবকদের বুঝিয়েছেন। তসলিমা কি ঘরে ঘরে গিয়ে সবাইকে নারী অধিকার বুঝিয়েছে? মেয়েদের জন্য স্কুল করেছে? না। কাজেই তসলিমা বর্জনীয়। ঘরে ঘরে গিয়ে মেয়েদের শিক্ষার আলো পৌঁছানোর যুগ পার করে এসেছি আমরা। আর মাঠ পর্যায়ে কাজ করার জন্য দেশে এনজিওর অভাব নেই। বেগম রোকেয়ার সময়ে রোকেয়া যা করছেন এবং তসলিমার সময়ে তসলিমা যা করছেন দুজনেই সঠিক। সময়ের পার্থক্যে কাজের পদ্ধতি ভিন্ন হয়েছে শুধু।
বেগম রোকেয়া সমাজের অবস্থা বিবেচনায় তাঁর স্কুলটিকে টিকিয়ে রাখতে অনেক সময় আপোষ করেছেন বটে। তবে বর্তমানে বেগম রোকেয়ার মূল আদর্শকে আড়াল করে ওই আপোষের অংশটুকুকেই রোকেয়ার আদর্শ হিসেবে দেখানো হয়।
১. আমার স্কুলটা আমার প্রাণ অপেক্ষাও প্রিয়। একে বাঁচিয়ে রাখার জন্য আমি সমাজের অযৌক্তিক নিয়ম কানুনগুলিও পালন করছি। (সওগত পত্রিকার সম্পাদক মোহাম্মদ নাসিরউদ্দিনকে দেয়া সাক্ষাৎকার)
২. তবু পর্দা করছি কেন জানেন? বুড়ো হয়ে গেছি, মরে যাব। ইস্কুলটা এতদিন চালিয়ে এলাম, আমার মরার সঙ্গে সঙ্গে এও যদি মরে সেই ভয়ে। (ইব্রাহিম খাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎকার)
নারী জাগরণের অগ্রদূত বেগম রোকেয়া এবং তসলিমা নাসরিন উভয়েই স্পষ্ট ভাষায় উল্লেখ করেছেন, ধর্মের ছায়াতলে কখনও নারীমুক্তি সম্ভব নয়। বর্তমানে অনেকেই আছেন যারা বেগম রোকেয়াকে আদর্শ মনে করেন, লেখাপড়া শিখে স্বামীর আদেশ মেনে হিজাব মাথায় চাপেন। মনে করেন হিজাব পালন তাদের ধর্মীয় নীতি এবং হিজাবে নারীর সম্মান বাড়ে। তারা কেন প্রশ্ন তোলে না, ধর্ম রক্ষা করতে ক’জন পুরুষ দাড়ি রাখে, টুপি পরে, জিন্স টি-শার্ট ফেলে টাকনুর উপর পাজামা পরে? ধর্ম রক্ষার দায় কি শুধু নারীর? তারা প্রশ্ন করেন না, কারণ ধর্ম তাদেরকে প্রশ্ন করতে শেখায় না, মেনে চলতে শেখায়।
ইসলামিক পিস টিভির হুজুর যিনি তার ওয়াজের জন্য বিখ্যাত, নাম আব্দুর রাজ্জাক। এই আব্দুর রাজ্জাকের এক ওয়াজে দেখলাম, তিনি বেগম রোকেয়াকে নারী জাতির কলঙ্ক হিসেবে উল্লেখ করেছেন এবং হাজারো ধর্মপ্রাণ মুসল্লি সেসব শুনছেন। না, তিনি রোকেয়ার ধর্মবিরোধী লেখা পড়ে তাকে ত্যাগের ঘোষণা দিয়েছেন তা নয়। রোকেয়া নারীকে শিক্ষিত ও স্বাবলম্বী হওয়ার কথা বলেছেন বলেই হুজুরের কাছে তিনি নারী জাতির কলঙ্ক উপাধি পেয়েছেন। শফি হুজুর, যিনি মনে করেন মেয়েদের বাইরে কাজ করার অধিকার নেই, আল্লাহ্ নারীদের সৃষ্টি করেছেন শুধু ঘরের কাজ ও স্বামী সেবার জন্য। সেই হুজুর লক্ষ জনতা নিয়ে ঢাকা শহরে প্রকাশ্যে সংবিধান বিরোধী ১৩ দফা দাবী তোলার সাহস পায়। ধর্মীয় মৌলবাদকে প্রশ্রয় দেয়ার ফল তো এমনই হয়।
বেগম রোকেয়ার সময়কাল থেকে নারীরা একটু করে এগিয়ে প্রথমে পর্দার ভিতরে থেকে স্কুলে গেছে, ধীরে ধীরে শিক্ষিত হয়ে নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে পর্দা থেকে নিজেকে মুক্ত করেছে, পরবর্তীতে রাজনৈতিক-সামাজিক বিভিন্ন বিপ্লবে ও প্রতিবাদে নিজেরা অংশগ্রহণ করেছে, মতামত দিয়েছে। রোকেয়ার আদর্শকে পুরোপুরি মেনে না নিলেও বাছাই করা অংশটুকুকে অন্তত মেনে নেয়া হয়েছিল, রোকেয়া নামটিকে শ্রদ্ধার সাথে উচ্চারণের নীতি চালু হয়েছিল। এই অগ্রগতির ধারাবাহিকতা বজায় রেখে বর্তমানে আরও অনেক দূর এগিয়ে যাওয়ার কথা ছিল। অথচ আমরা এক পা এক পা করে পিছিয়ে আবার ‘পর্দার ভিতরে থেকে লেখাপড়ার অধিকার’ এর যুগে চলে এসেছি। ঠিক যেভাবে অসাম্প্রদায়িক চেতনায় একটি দেশ সৃষ্টি হয়ে বর্তমানে দেশটি রাষ্ট্রধর্মের অভিশাপ নিয়ে একটি সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র হওয়ার পথে হাঁটছে। এখানেই ধর্ম ও ধর্মীয় মৌলবাদীদের সার্থকতা।
ইতু ইত্তিলা'র ফেসবুক থেকে