নারী নির্যাতন রোধে প্রয়োজন স্কুলভিত্তিক কার্যক্রম

প্রকাশ | ০৭ জুন ২০১৬, ১৪:২৩

অনিকেত আচার্য

একটি সমাজ বা জাতি কতটা অগ্রসর, তা বোঝার অন্যতম শর্ত হলো সেই সমাজে নারীর অবস্থান কতটা উন্নত। যদি সেখানে নারীর নায্যতাভিত্তিক সমঅধিকার থাকে, যদি তাদের শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ অবারিত থাকে তাহলে সত্যিকার অর্থেই সে জাতি আধুনিক। বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে নারীর অবদান এবং নারীসমাজের ভূমিকা সর্বজন স্বীকৃত। নারীর অর্জন আজ এত দৃশ্যমান যে তা অস্বীকার করার উপায় নেই। বাংলাদেশের সামাজিক উন্নয়নের সব সূচকেই বিশাল অবদান রাখছে নারী। কিন্তু নারীদের ওপর সহিংসতাসহ নারী নির্যাতন এবং নারীর প্রতি বৈষম্য দেশের সমাজব্যবস্থায় এখনো বিদ্যমান। বাল্যবিয়ে, বহু বিবাহ, যৌতুক, তালাক, এসিড নিক্ষেপ, নারী ও শিশু পাচার, যৌন হয়রানি, ধর্ষণ এবং পারিবারিক নির্যাতনের মতো ঘটনা সমাজে এখনো ঘটছে।

পপুলেশন কাউন্সিলের গবেষণায় দেখা যায় ৪৭ ভাগ নারী ও ৭২ ভাগ কিশোরী স্বগৃহে অভিভাবক দ্বারা শারীরিকভাবে নির্যাতিত হন। মানসিক নির্যাতনের সংখ্যা যোগ করলে এ সংখ্যা আরো অনেক বেড়ে যাবে। ৫০ ভাগেরও বেশি কিশোরীদের ১৯ বছর বয়সের আগেই বিয়ে দেয়া হয়, যার ফলে তাদের মধ্যে স্বাস্থ্য ঝুঁকিসহ শিশু ও মাতৃমৃত্যুর ঝুঁকি বেড়ে যায়। ৭৬ ভাগ ছাত্রীকে তাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ও প্রতিষ্ঠানের বাইরে যৌন নিপীড়নের শিকার হতে হয়। এসব কারণে নারী এবং কিশোরীদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতাও লক্ষ করা যায়। এগুলো কোনো ‘বিচ্ছিন্ন ঘটনা’ নয়। নারী নির্যাতন বন্ধ এবং নারী ও শিশুদের অধিকার রক্ষা ও কল্যাণে সরকারের বেশ কিছু আইন ও নীতিগত পদক্ষেপ রয়েছে। এছাড়া সাম্প্রতিক সময়ে নারী ও শিশুদের কল্যাণে বেশকিছু নীতিমালাও প্রণয়ন করা হয়েছে। যৌন হয়রানি প্রতিরোধে রয়েছে হাইকোর্টের নির্দেশনা। সংবিধান ও আইনি কাঠামোতে নারী অধিকার প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা বিদ্যমান থাকলেও নির্যাতনমুক্ত জীবন নিশ্চিত করা যাচ্ছে না। এর অন্যতম প্রধান কারণ হলো অধিকাংশ জনগণ তথা দেশের নারী ও পুরুষ এসব আইন ও নীতি সম্পর্কে খুব একটা অবগত নয়। দেশের কিশোর কিশোরীর সংখ্যা মোট জনসংখ্যার শতকরা ২১ ভাগ; যাদের বেশির ভাগই এসব আইন ও নীতি সম্পর্কিত তথ্য থেকে বঞ্চিত রয়েছে। বিশেষ করে দেশের ১৩.৭ মিলিয়ন কিশোরী তাদের অধিকার, স্বাস্থ্য ও জেন্ডার সমতা এবং তাদের ধারণা ও অভিজ্ঞতা বিনিময়ের সুযোগ ইত্যাদি সম্পর্কে জানে না। নির্যাতন ও সহিংসতামুক্ত পরিবেশ তৈরি এবং নারী-পুরুষ সমতাভিত্তিক মূল্যবোধ তৈরির জন্য শিক্ষা ক্ষেত্রে নিবিড়ভাবে বিষয়টি নিয়ে কাজ করে মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক, শিক্ষার্থী এবং কমিউনিটির লোকজনকে এ বিষয়ে সচেতন করা গেলে সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন হওয়া হবে। এতে নারীর প্রতি সহিংসতা ও নারী নির্যাতন প্রতিরোধে সমাজের আপমর মানুষের কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারা সম্ভব। বেসরকারি একটি উন্নয়ন সংগঠন ঢাকা, চট্টগ্রাম, নেত্রকোনা এবং কুষ্টিয়া জেলার ৮০টি মাধ্যমিক স্কুলে ‘নিরাপদ স্কুল, নিরাপদ সমাজ’ প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে। স্কুলের শিক্ষক, শিক্ষার্থী, ম্যানেজমেন্ট কমিটি, অভিভাবক ও কমিউনিটি সদস্যসহ সংশ্লিষ্ট সরকারি দপ্তরের প্রতিনিধিদের সম্পৃক্ত করে স্কুল ও কমিউনিটিতে সহিংসতা ও নির্যাতনমুক্ত পরিবেশ তৈরিতে এ প্রকল্পটি কাজ করছে। স্কুলের শিক্ষকদের নারীর প্রতি সহিংসতা ও নির্যাতন প্রতিরোধে প্রবর্তিত আইন ও নীতিসমূহ সম্পর্কে ধারণা প্রদান করছে। এগুলোর প্রয়োগ ও ব্যবহার জানানো এবং নারীদের প্রতি সব ধরনের নির্যাতন প্রতিরোধ করে সহিংসতা ও নির্যাতনমুক্ত স্কুল ও সমাজ গঠনে করণীয় সম্পর্কে প্রশিক্ষণ দিয়ে দক্ষ করা হচ্ছে। স্কুলের শিক্ষার্থীদের ব্যবহারের জন্য এসব বিষয় সংবলিত কিছু শিক্ষা উপকরণ তৈরি করা হয়েছে।

প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিক্ষকরা এসব উপকরণ ব্যবহার করে শ্রেণিকক্ষে পাঠদান করছেন, যা শিক্ষার্থীদের মধ্যে পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন, নারী নির্যাতন প্রতিরোধের জন্য প্রবর্তিত আইন ও নীতি সম্পর্কে ধারণা অর্জন করতে উৎসাহী করে তুলতে সাহায্য করছে। এছাড়া জাতীয় পর্যায়ে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও সরকারি দপ্তরসমূহের প্রতিনিধিদের সঙ্গে এডভোকেসির মাধ্যমে জাতীয় শিক্ষা কারিকুলামে এ ধরনের বিষয় অন্তর্ভুক্তকরণ এবং জাতীয়ভাবে এ ধরনের কার্যক্রম বাস্তবায়নের জন্য লবিং করা হচ্ছে। যাতে দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার ওপর ভিত্তি করে নারীর সমঅধিকারের মূল্যবোধ তৈরির মাধমে নারীর প্রতিভা, যোগ্যতা, দক্ষতা ও সক্ষমতা বিকাশের উপযোগী একটি নারীবান্ধব সমাজ ব্যবস্থা তৈরির পরিস্থিতি তৈরি করা যায়। যা নারীর আগ্রযাত্রার পথকে আরো সুগম করবে।

প্রথম প্রকাশ ভোরের কাগজ
৬ জুন ২০১৬