নেতা নয়, এ গণ-মানুষের 'আম্মা'
প্রকাশ | ০৮ ডিসেম্বর ২০১৬, ১৭:২৬ | আপডেট: ০৮ ডিসেম্বর ২০১৬, ১৭:৪৫
অক্টোবরের শেষ সপ্তাহে চিকিৎসার জন্য কয়েকদিনের জন্য যখন সপরিবারে তামিলনাডু গিয়েছিলাম, তখনো জানতাম না রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী জয়রাম জয়াললিতা একই হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন। চেন্নাই আন্তর্জাতিক বিমান বন্দর থেকে ট্যাক্সিতে করে শহরের প্রায় অন্য প্রান্তে গ্রীমস রোডে যেতে যেতে ট্র্যাফিক জ্যাম দেখে শহরটিকে নিজের শহর ঢাকার চেয়ে খুব আলাদা মনে হয়নি। পরদিন সকালে চেন্নাই অ্যাপোলো হাসপাতালের মেইন ব্লকে ঢোকার মুখে দেখি, প্রবেশপথের একদিকে একদল মানুষের জটলা। এদের বেশিরভাগই নারী, ভজন গাইছেন। তাদের ঘিরে আছেন শ'খানেক মানুষ। অপর পাশে কড়া প্রহরা। মেটাল ডিটেক্টর দিয়ে শরীর এবং ব্যাগ তল্লাশি শেষে ভেতরে ঢুকছেন শিশুসহ চিকিৎসা প্রার্থী সব মানুষ।
জানলাম, এ সাধারণ নিরাপত্তার অংশ নয়। রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী জয়ললিতা জয়রাম, যিনি 'আম্মা' নামেই তামিলদের কাছে সবচেয়ে বেশী পরিচিত, এখন এই হাসপাতালেই চিকিৎসাধীন। সেইজন্যই এত আয়োজন। বেরুবার মুখে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে দেখলাম। এখানেই পরিচয় হলো ময়ুরেশ মুরুগাপ্পার সঙ্গে। এক ডিপার্টমেন্টাল স্টোরে বিক্রয় কর্মীর কাজ করেন তিনি। জানালেন যেদিন থেকে 'আম্মা' হাসপাতালে, সেদিন থেকেই চলছে এই প্রার্থনামূলক পূজার ব্যবস্থা। এখানে ময়ুরেশের মা এবং বোনেরাও এসেছে। মুরুগাপ্পা পরিবারের কেউই রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত নন। কিন্তু রোজ সকালে এই প্রার্থনায় তারা আসেন, আসবেন যতদিন আম্মা সুস্থ হয়ে বাড়ি না ফিরছেন। ময়ুরেশ জানালেন, দুপুর নাগাদ এখান থেকেই কাজে যাবেন তিনি।
প্রথমবার আমার নিজের শহর থেকে ভিন্ন কোথাও এসেছি বলে মনে হল। শ্রদ্ধা জানাতে আসা মানুষের ঢল। প্রার্থনা শেষে বিলানো হচ্ছে প্রসাদ। কারি পাতা দিয়ে সব্জি-খিচুড়ির এক পদ সেটি। হাসপাতালে আসা রোগী কিংবা তাদের স্বজন কিংবা রাস্তার উৎসুক জনগণ সকলের জন্য।
ময়ুরেশের কাছে জিজ্ঞেস করেছিলাম, কত লোকের জন্য রান্না হয় রোজ? কে পয়সা দেয়? শেষ প্রশ্নের উত্তর সে জানে না, তবে রান্না হয় পাঁচশো লোকের জন্য।
পরদিন খুব ভোরে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করানোর জন্য হেঁটে হাসপাতালের প্যাথলজি ভবনটিতে যাবার পথে হঠাৎ দেখি এক ট্যাক্সি। যার গায়ে সবুজ রঙ এর বড় এক বোর্ড লাগানো। গায়ে ইংরেজিতে লেখা, "রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী এই হাসপাতালে ভর্তি আছেন। যতদিন তিনি সুস্থ না হবেন, ততদিন এই হাসপাতালে ভর্তি রোগী ও তাদের স্বজনদের এই ট্যাক্সি বিনামূল্যে আনা নেয়া করবে। সকাল নটা থেকে রাত নটা পর্যন্ত।"
অবাক হয়ে মালিকের সঙ্গে পরিচিত হলাম। নাম জি সুকুমার। বিএ পাস করেছে গত বছর। পেশায় ট্যাক্সি চালক। খুবই নিম্ন আয়ের মানুষ। রাত ন'টার পর যতক্ষণ শরীরে কুলায়, ট্যাক্সি চালিয়ে খাবারের পয়সা জোগাড় করেন।
জিজ্ঞেস করেছিলাম, 'আম্মা' সুস্থ হলে তার সঙ্গে দেখা করতে যাবেন কিনা। অসুস্থতার সময়, তার এই সেবা সম্পর্কে 'আম্মা'কে জানাতে চাইবেন কিনা। উত্তর ছিল, কেন যাব? আমার তো ট্যাক্সি আছে, আমার চাকরি বা ব্যবসা লাগবে না। আমার আরেকবার মনে হলো, এ শহরের মানুষেরা অচিন মানুষ।
ডাক্তারদের সাথে কথাবার্তা শেষে যেদিন ফিরব, সন্ধ্যে হয়ে গিয়েছিল। হাসপাতালের গেটে অপেক্ষা করছি ট্যাক্সির জন্য। হঠাৎ একপাশে দেখলাম, বিনামূল্যে পানি বিতরণ করা হচ্ছে। এই পানি আসছে শিভানী শিবানীর বাড়ি থেকে। গ্রীমস রোডের হোটেল পাড়া যেখানে শেষ, সেখানে শুরু হয়েছে প্রায় আধা কিলোমিটার দীর্ঘ এক বস্তি। ঐ বস্তিতেই দুই ছেলে আর এক বোনকে নিয়ে থাকে শিবানী। আগে রাস্তার পাশে ভ্যানে করে ফল কেটে বিক্রি করতেন। এখন ছেলেরা রোজগার করে। 'আম্মা' অসুস্থ হবার পর থেকেই এখানে পানি খাওয়াচ্ছেন লোককে। এদিয়ে পুণ্য অর্জন হবে। আর তা যোগ হয়েই 'আম্মা' সুস্থ হয়ে যাবেন।
আর আমি ভাবতে ভাবতে ফিরলাম, এক সময়ের জনপ্রিয় অভিনেত্রী, একজন রাজনীতিবিদ, একজন মুখ্যমন্ত্রী- সমাজের কতটা গভীরে পৌঁছেছেন! কতটা ভালোবাসায় এইসব সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের নিজের মানুষে পরিণত হয়েছেন!
হয়ত এভাবেই জয়রাম জয়ললিতা 'আম্মা' হয়ে উঠেছেন তাদের।
লেখক: সাংবাদিক, বিবিসি বাংলা