আসসালামু আলাইকুম চোর সাহেব
প্রকাশ | ০৭ ডিসেম্বর ২০১৬, ১৭:২৪ | আপডেট: ১৩ ডিসেম্বর ২০১৬, ১৭:৫১
ভাষার বিষয়ে আমার খুব সেনসিটিভিটি কাজ করে। এটা কে আমি সেনসিটিভিটি-ই বলবো, এর ভালো বাংলা মনে পড়ছে না। বয়সের সাথে সাথে খেয়াল করেছি, কেউ অশালীন ভাষা ব্যবহার করলে, বিশ্রী ভঙ্গি বা টোনে কথা বললে, কিংবা কোন গালি বা নোংরা শব্দ ব্যবহার করলে, আমার ভেতরে প্রচণ্ড প্রতিক্রিয়া শুরু হয়। আমি অসুস্থ ফিল করতে শুরু করি। তীব্র রাগ, অভিমান কাজ করে, মনে হয় কেন এভাবে, কেন? এর প্রতিবাদ করতে ইচ্ছে হয়, মনে হয় এর পরিবর্তন আবশ্যক। সুন্দর ভাষায়ও বোল্ডনেস প্রকাশ করা যায়। নিজের অবস্থানে দৃঢ় থেকে শালীন ভাষায় নিজের বক্তব্যকে জাহির করা যায়। অন্তত আমি তাই চেষ্টা করি সবসময়, আর যাদের পারি সবাইকে এ তত্ত্ব বোঝাতে বসি।
অনেকেই আমার এ অবস্থানের সাথে এক মত নয়। বহুল পরিচিত কথা-ই আছে যে, মিষ্টি কথায় চিড়া ভিজে না। আবার অনেকেই বলে আমাদের সমাজে এ তত্ত্ব কাজ করবে না। বরের সাথে এ নিয়ে অনেক তর্ক হয়, ও তখন একটা উদাহরণ টানে সব সময়। ওর এক পুলিশ বন্ধু নাকি ওকে বলেছিলো যে, আমি যদি চোরকে ধরে বলি, আসসালামু আলাইকুম চোর সাহেব, কেমন আছেন আপনি, তা কি কারণে, কিভাবে চুরি করলেন, আমাকে একটু বলেন। চোর নাকি তখন স্বীকারই করবে না যে সে চুরি করেছিল। চোরকে ধরেই নাকি আচ্ছা মত মার আর গালিগালাজ দিলে তবেই নাকি সে স্বীকার করবে যে সে চোর। আমি কিছুতেই ওর সাথে এক মত হতে পারি না, ভেতরটা কষ্টে জ্বলে যেতে থাকে, আমাদের বিতর্ক চলতে থাকে এই নিয়ে।
উন্নত বিশ্বে অপরাধীর বিচার প্রক্রিয়ার সময়ও তার যে হিউম্যান রাইটস তা কঠোরভাবে মানা হয়, তাই বলে কি তার অপরাধের বিচার হয় না? তারা তো এ অবস্থানে এক দিনে আসেনি, আমাদের ভালো বিষয়গুলোর চর্চা চালিয়ে যেতে হবে তবেই না একদিন আমরাও সভ্য সমাজ পাবো। এক্ষেত্রে ট্র্যাম্পকে আমি এক্সেপশনাল ভাবি, ওর উদাহরণ না আনলেই ভালো। আমি এখানে ছোট ছোট বাচ্চাদের নিয়ে কাজ করি, এ কাজের জন্য নিয়মিত বিভিন্ন ট্রেনিং এবং ওয়ার্কশপ এ অংশ নিতে হয়। মানব জীবনের চমৎকার সব বিষয় নিয়ে থাকে সেসব ওয়ার্কশপে। সেগুলো আমি খুব মনোযোগ দিয়ে করি, কারণ আমার নিজেরও দুইটা বাচ্চা আছে, কিভাবে তাদেরও আমি একজন পরিপূর্ণ মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে পারি সেটাই আমার আগ্রহের কারণ। আর আমার অনুশীলনের জায়গাতো রয়েছেই। এরকমই একটা বিষয় ছিল তিন চার বছরের শিশুদের ভাষা নিয়ে।
তিন বছরের শিশুদের অনেকেকেই বিভিন্ন কনফ্লিক্ট সিচুয়েশনে আমাদের শব্দের যোগান দিতে হয়, যাতে তারা সুন্দর ভাবে আর্গুমেন্ট করে তাদের ঝামেলাটা মেটাতে পারে। তাদের শব্দ ভান্ডার তখনও অত সমৃদ্ধ থাকে না। অভিযোগকারী এবং যার বিরুদ্ধে অভিযোগ দুজনকেই কথা বলতে সাহায্য করা হয়, অর্থাৎ যাদের মধ্যে ঝামেলা প্রত্যেককেই কথা বলতে দেয়া হয়, তবে সঠিক শব্দ প্রয়োগের যোগান দিতে হয় আমাদের। আবার এটাও খেয়াল রাখা হয় কেউ যেন সমস্যাটা নিয়ে কথা না বলেই শুধু শুধু স্যরি বলে চলে না যায়। কারণ সেক্ষেত্রে আমাদের দেশে যেমন প্রচলিত কথা আছে যে লাত্থি মেরে স্যরি বলে চলে যাওয়া, সেরকম একটা ব্যাপার প্রচলিত হয়ে যেতে পারে। খুব অল্প সময়ের মধ্যে অভিযোগকারীকে তার অপছন্দের অংশটুকু স্ট্রংভাবে বলতে বলা হয়, অন্তত তার যে ভাল লাগে নাই সে তথ্যটকু। আবার এর প্রতিক্রিয়ায় যার বিরুদ্ধে অভিযোগ তার মতামত চাওয়া হয়। বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই আমি দেখেছি, অভিযোগকারী ভালো ফিল করে, তার যে খারাপ লেগেছে এটা সুন্দর ভাষায় প্রকাশ করে। আর যার বিরুদ্ধে অভিযোগ সে বেশীরভাগ সময়ই বলে বসে আমি আর এরকম করবো না, বা নেক্সট টাইম আর এমন হবে না।
তিন চার বছরের এক দল বাচ্চাকে একবছর ধরে এভাবে ট্রেনিং দেয়ার পর, পরবর্তীতে একই বাচ্চার সাথে কাজ করতে যেয়ে খেয়াল করেছি, তাদের মধ্যে অভ্যাসটা গড়ে উঠেছে কনফ্লিক্ট সিচুয়েশনে এভাবে কথা বলার। এমনকি সামনে টিচার উপস্থিত না থাকলেও। তারা খেলনা নিয়ে কাড়াকাড়ি করতে গিয়েও কথা বলছে, শালীন ভাষায় কথা বলছে। এদের মধ্যে অনেকেই ছিল যারা কিছু স্ল্যাং শিখে ফেলেছিল নানাভাবে, তারা জানে তা এখানে বর্জনীয়। কেউ উচ্চারণ করলেও অন্য বাচ্চা এসে টিচারকে বলে দিবে যে, ও বাজে শব্দ ব্যবহার করেছে। এক্ষেত্রেও আমার ভীষণ ভালো লেগেছে যা- যে শিশুটি টিচারকে বলতে আসে যে, কেউ ঐ বাজে শব্দটা বলেছে সেও তা উচ্চারণ না করে শুধু এটুকুই বলে, "he/she used bad word". সেও জানে এই শব্দটি বলতে সে নিজেও অ্যালাওড না। কি দারুণভাবে শিখছে শিশুগুলো! আমার কাছে মনে হয় এই যে প্র্যাকটিস তারা করছে তা শুধু অভ্যাসের কারণেই কি তাদের মধ্যে দীর্ঘদিন রয়ে যাবে না? আবার কেউ কেউ সেটা ভেতরে ধারণ করবে তীব্রভাবেই, নৈতিক আদর্শ হিসেবেই।
এভাবেই তো মানুষ নিজেকে পরিবর্তন করেছে। এভাবেই সমাজ থেকে দূর হয়েছে অসুন্দর। তাই আমার বর যখন ঐ চোরের উদাহরণ দেয়, আমি সব সময় এই উদাহরণগুলো দেই। আমি বিশ্বাস করি এরকমভাবে আমাদের প্রত্যেকের সন্তানকে যদি আমরা শেখাতে পারি, আর নিজেরা প্র্যাকটিস করি তাহলে কোন কিছুর প্রতিবাদ করতে আমাদের অশালীন ভাষা ব্যবহার না করেও কাজ হবে। শালীনতা, সৌন্দর্য জয় করবে সব অসুন্দরকে।
আফরিন জাহান হাসি'র ফেসবুক থেকে