‘বিশেষ বিধান’-এর বিশেষ সমস্যা
প্রকাশ | ০৬ ডিসেম্বর ২০১৬, ০১:৩৩
সম্প্রতি এক কাজে ঢাকার বাইরে একটি জেলার বেশ প্রত্যন্ত অঞ্চলে যাওয়া হয়েছিল। আমার প্রতিনিধি জানালেন, অনেক চেষ্টা করেও একটি বালিকার বিয়ে ঠেকাতে পারছেননা তারা কয়েক সাংবাদিক বন্ধু। আমি যখন পৌছেছি তখনও বিয়েটা হয়নি। তাই ফোন করলাম উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে, কারণ রাষ্ট্রের পক্ষে তারই এখানে প্রধান ভূমিকা। কিন্তু বোঝা গেলে তিনি কিছুটা নির্লিপ্ত। তার যুক্তি, মেয়ের বাবার কাছে জন্ম নিবন্ধন সনদ আছে, যাতে প্রমাণ হয় ক্লাশ সেভেনে পড়লেও এই মেয়ের বয়স আসলে ১৮ এর বেশি।
বাংলাদেশে চাইলে সনদ যে কেউ পেতে পারে, তৈরী করে নিতে পারে একথা ইউএনও সাহেবের চেয়ে কে বেশি জানে? এভাবেই প্রতিদিন শত শত মেয়ের বাল্যবিয়ে হচ্ছে। আর এ কারণেই কোনভাবেই অকালমাতৃত্বের লাগাম টানা সম্ভব হচ্ছেনা। বাংলাদেশে বাল্যবিবাহের হার ৬৬ শতাংশ। ১৮ বছর পূর্ণ হওয়ার আগেই তাদের বিয়ে হয়ে যাচ্ছে। এর অধিকাংশই মেয়েশিশু। অর্থাৎ গড়ে প্রতি তিনটি বিয়ের মধ্যে দু’টিই বাল্যবিয়ে। এর অনিবার্য পরিণতি মেয়েদের অকালমাতৃত্ব।
এমন এক প্রেক্ষাপটেই গত ২৪ নভেম্বর মন্ত্রিসভায় ‘বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন, ২০১৬’-এর খসড়া অনুমোদন করা হয়। সমাজ এগিয়ে চলে প্রড়তির পথে। কিন্তু আমরা কেবলই পেছনে হাটি। আগের আইনে যেখানে মেয়েদের বিয়ের বয়স ১৮ বছর রাখা হয়েছিল, সেখানে ২০১৬ সালে এসে আইনে ‘বিশেষ বিধান’ রেখে ১৮ বছরের কম বয়সের মেয়েদের বিয়ে জায়েজ করার চেষ্টা হচ্ছে। বলতেই হয় যে প্রধানমন্ত্রী নারীদের ক্ষমতায়ন নিয়ে এতো সোচ্চার, তার সরকারের এটি একটি পশ্চাৎপদ সিদ্ধান্ত।
‘বিশেষ বিধান’ রেখে আইন প্রণয়ন করা মানেই আইনি ভিত্তিকে দুর্বল করে দেয়া। নারী শিক্ষার ক্ষেত্রে যে অগ্রগতি নিয়ে আমাদের এতো গর্ব, তা থেকে পিছিয়ে যাওয়ার আয়োজন এই বিশেষ বিধান। এর কারণে অপরিণত বয়সে সন্তান ধারণের কারণে বাড়বে মাতৃমৃত্যু ও শিশুমৃত্যুর হার। বাড়বে নারী নির্যাতন। বাধাগ্রস্ত হবে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য (এসডিজি) অর্জন।sorbajoya_dce1-1
মেয়েদের বাল্যকালে বিয়েতে বাধ্য করা এদেশের এক শতাব্দী-প্রাচীন সমস্যা। এর জন্য দায়ী দারিদ্র, অশিক্ষা ও লিঙ্গবৈষম্য। সরকারি প্রচেষ্টায় মেয়েরা আজ শিক্ষায় অনেকদূর এগিয়ে। কিন্তু তবুও গ্রামেগঞ্জে, শহরাঞ্চলেও বাবা-মা ও অভিভাবকদের একটা বড় অংশ মনে করেন মেয়েদের শিক্ষার জন্য টাকাপয়সা খরচ করা মানে অপচয়। তার চেয়ে বরং অল্প বয়সে পাত্রস্থ করতে পারলে সংসারে এক জনের অন্ন খরচ কমে। একটা বড় ভাবনা হলো বিয়ে দিতে দেরি করা মানেই পাত্রীর চাহিদা কমে যাওয়া ও পাশাপাশি। আছে যৌতুকের চাপও। তাই তাদের বিবেচনায় মোটামুটি ভাল পাত্র পাওয়া মাত্রই আর দেরি করতে চাননা অভিবকরা।
আমরা প্রায়ই দেখি গ্রামবাংলার প্রত্যম্ত অঞ্চলে একের-পর-এক স্কুল-পড়ুয়া মেয়ে বাবা-মা, অভিভাবক, পরিবার ও সমাজের চাপ উপেক্ষা করে বাল্যবিয়ের অভিশাপ হতে নিজেদের মুক্ত করছে। অকুতোভয়ে এসব মেয়ে স্পষ্ট করে জানিয়ে দিচ্ছে তারা পড়ালেখা করতে চায়, নিজের পায়ে দাড়াতে চায়, এখনই বিয়ে করতে চায়না। সমাজের মুখের উপর এই দুঃসাহস কেবল শহরে নয়, প্রান্তিক পর্যায়েও দেখা যাচ্ছে। দারিদ্রের বাধ্যতা, পরিবারের বাধা, সমাজের রক্তচক্ষু অগ্রাহ্য করে এমনকী বিয়ের আসর থেকে সাহসী কন্যারা উঠে আসছে শিক্ষার জগতে। না, এর পিছনে কোন সমাজ-সংস্কারক নেই, আন্দোলন নেই, কোন এনজিও’র প্রেরণাও নেই। আছে ওই কিশোরীদের স্বাবলম্বী হবার দুর্মর তাগিদ, পূর্ণাঙ্গ মানুষ হিসাবে বিকশিত হওয়ার দাবি।
আজ বিশেষ বিধান করে যদি একবার বাধন হাল্কা করা হয়, তাহলে এই সাহসিকাদের বিরুদ্ধে একজোট হবে পুরো পুরুষ সমাজ, গ্রামে, শহরে সর্বত্র। বাল্যবিয়ে মানেই ধর্ষনকে বৈধতা দেয়া। ১৮ বছরের আগে বিয়ে মানেই হলো দিনের পর দিন একটি মেয়েকে নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে স্বামীর যৌন নির্যাতনের শিকার হতে দেয়া। এমনিতেই আমাদের সামাজিক কাঠামোতে বড় সমস্যা আছে। তার উপর একবার যদি আইনী সমর্থন পাওয়া যায়, তবে আরো বেশি দুর্বিনীত হয়ে উঠবে পুরুষ।
দেশ জুড়ে মেয়েদের ওপর বেড়ে চলা যৌন-হিংসার জেরে, সর্বত্র মেয়েদের, বিশেষত অল্পবয়সি মেয়েদের, পথেঘাটে বেরোনোর আত্মবিশ্বাসে অনেকটাই ফাটল ধরেছে। প্রশ্ন হল, নতুন আইন এলে ইভ টিজিং-এর শিকার মেয়েদের দ্রুত বিয়ের আয়োজন করবেন বাবা-মা’রা এবং তারা ব্যবহার করবে এই বিশেষ বিধান। যখন প্রয়োজন নিরাপত্তার অভাবে ভুগতে-থাকা মেয়েদের মনে সাহস জোগানো, তখন যদি এমনটা ঘটে তাহলে লিঙ্গ-ন্যায্যতা কতটা নিশ্চিত করা যাবে?
আমাদের অতিরিক্ত আইন-মনস্ক রাষ্ট্রব্যবস্থায় যতখানি মনোযোগ ব্যয়িত হচ্ছে আইন তৈরির দিকে, রাজনৈতিক নেতৃত্বের সঙ্গে যখন নাগরিক সমাজের দৃষ্টিও নিবদ্ধ কঠোরতর আইন প্রণয়নের অভিমুখে, তখন এমন বিধান কতটা সাহায্য করবে নারীদের ব্যাপারে রাষ্ট্র ও সমাজের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন আনতে? রাষ্ট্রের নীতি নির্ধারকরা যথেষ্ট সংবেদনশীল না হলে লিঙ্গ-অসাম্যের ভিত টলানো খুবই কঠিন।
আমাদের পিতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় ছেলে ও মেয়েদের ছোট থেকেই আলাদা সামাজিকীকরণ হয়। প্রতিনিয়ত আমাদের সমাজ পৌরুষের প্রকাশকে বাহাদুরি মনে করে ‘রেপ কালচার’কে প্রশ্রয় দেয়। কোন মেয়ে যৌন হেনস্থার শিকার হলে বেশির ভাগ সময় তার উপরই অপরাধের দায় চাপানো হয়। এমন এক সমাজে, সচেতন সরকার কি করে আইনের মাধ্যমে সুযোগ করে দেয় দুষ্টচক্রকে? নিশ্চয় বিষয়টি আররেকবার বিবেচনা করা হবে।
বাল্যবিবাহ রদ করতে প্রয়োজন সমষ্টিগত বহুমাত্রিক লড়াই। সমাজের অনেককেই এতে শামিল হতে হবে। বাবা-মা, ছেলেমেয়ে, গ্রামের নানা স্তরের মানুষ, স্বাস্থ্যকর্মী, স্থানীয় স্কুল শিক্ষক, স্থানীয় প্রশাসন, শিক্ষিত সমাজ-সচেতন নাগরিক সকলকে নিয়ে মেয়েদের বাল্যবিয়ের বিরুদ্ধে প্রচার-অভিযান চালাতে হবে। সেই আন্দোলন চলছেও। কিন্তু শাসনব্যবস্থা যাদের নিয়্ত্রণে তাদের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন না এলে, যে সামাজিক মানসিকতা ও লিঙ্গ অসাম্যমূলক আচরণের জন্য মেয়েরা যৌন-নিগৃহীত হয়, তার প্রতিকার করা অসম্ভব।
লেখক: পরিচালক বার্তা, একাত্তর টিভি
প্রথম প্রকাশ: প্রাণের বাংলা