সাঁওতালদের কথা
প্রকাশ | ১৮ নভেম্বর ২০১৬, ০২:০৭
সাঁওতালদের ওরকম আলাদা করে রাখা হয় কেন? ওরা কি চিড়িয়াখানার জন্তু? জন্তু না হলেও পর্যটন বাণিজ্যের পণ্য অথবা দর্শনীয় বস্তু নিশ্চয়ই। কেউ কেউ বলে, ‘মেইনস্ট্রিম সমাজে ওদের না থাকাই ভালো, থাকলে ওদের কৃষ্টি, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য, লোকাচার, ভাষা সব হারিয়ে যাবে’। কিন্তু দল বেঁধে বাস করলেই ঐতিহ্য রক্ষা করা হয় না। দারিদ্র্য ওদের জীবন থেকে সংস্কৃতি ভুলিয়ে দিয়েছে। বারো মাসে ওদের তেরো পার্বণ। পার্বণ পালনের জন্য যে কড়ির দরকার হয়, সে কি আছে ওদের ঝোলায়? ওরা তো এর মধ্যে নিজেদের পোশাক ছেড়ে আর সবার মতো পোশাক পরছে। ওরা তো বাংলা ভাষাটাকেও বলতে শিখেছে। মূলস্রোতে মিশে যাওয়ার জন্য বাকি আর কী আছে?
ভারতের আন্দামানের একটা জায়গায় জারোয়াদের বন্দি করে রাখা হয়। পর্যটকরা ওদের দূর থেকে দেখে। চিড়িয়াখানার জন্তুদের যেমন দেখে, তেমন দেখে ন্যাংটো ন্যাংটো মানুষগুলোকে। ওদেরও মূলস্রোত থেকে সরিয়ে রাখা হয়েছে, দর্শনীয় বস্তু হিসেবে রেখে দেওয়া হয়েছে। মনে পড়ছে ইংরেজরা যখন আফ্রিকার জঙ্গল থেকে পিগমিদের—ছোট ছোট মানুষদের—ধরে এনেছিল, ওরা মানুষ কিন্তু ওদের মানুষ নয়, বরং ‘মানুষের মতো দেখতে এক ধরনের জন্তু’ বলে রায় দিয়েছিলেন তখনকার বিজ্ঞানীরা, ওদের রাখা হয়েছিল খাঁচায় বন্দি করে, ঠিক যেমন জঙ্গলের হিংস্র জন্তুকে খাঁচায় বন্দি করা হয়। আন্দামানের জারোয়াদের জন্যও তো তেমন অদৃশ্য খাঁচা নির্মাণ হয়েছে! সাঁওতালদেরও জন্যও হয়তো অদৃশ্য কোনো খাঁচা আছে। সাঁওতালদের জন্য একটা নির্দিষ্ট এলাকা বেঁধে দেওয়া হয়েছে, আমেরিকার নেটিভ আমেরিকানদের জন্য যেমন বেঁধে দেওয়া হয়েছে। সবচেয়ে খারাপ এলাকাগুলোই দেওয়া হয়েছে ওদের, যারা দেশটার আদিবাসী, মানে আদি থেকে বাস করছে যারা। বহিরাগতরা আদিবাসীদের দেশ দখল করে আদিবাসীদেরই একরকম ‘একঘরে’ করে। আদিবাসীদের এভাবেই ধীরে ধীরে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া হচ্ছে পৃথিবী থেকে।
মনে পড়ছে ইংরেজরা যখন আফ্রিকার জঙ্গল থেকে পিগমিদের—ছোট ছোট মানুষদের—ধরে এনেছিল, ওরা মানুষ, কিন্তু ওদের ‘মানুষের মতো দেখতে এক ধরনের জন্তু’ বলে রায় দেওয়া হয়েছিল, রাখা হয়েছিল খাঁচায় বন্দি করে। আন্দামানের জারোয়াদের জন্যও তো তেমন অদৃশ্য খাঁচা নির্মাণ হয়েছে! সাঁওতালদেরও হয়তো অদৃশ্য কোনো খাঁচা আছে।
বাংলাদেশে সম্ভবত দুলাখ সাঁওতাল বাস করে। বেশি বাস করে ঝাড়খন্ডে, পশ্চিমবঙ্গে। উড়িষ্যায়, বিহারে, আসামেও সংখ্যা কম নয়। নেপালেও কিছু আছে। সাঁওতালদের জন্য তো সাঁওতাল পরগণা বানিয়ে দেওয়া হয়েছিল। এক ধরনের খাঁচাই তো! অবশ্য সাঁওতালরাও নিজেদের জন্য একটা রাজ্য চেয়েছিল। আর নির্যাতিত হতে চায় না বলেই চেয়েছিল। সমাধান তো আলাদা রাজ্যে, বা আলাদা গ্রামে, বা আলাদা খাঁচায় নেই। সমাধান একটা বৈষম্যহীন সমাজ। তেমন একটি সমাজ আমরা না দিতে পেরেছি সাঁওতালদের, না দিতে পেরেছি আমাদের।
বাংলাদেশে আমি ৩১ বছর কাটিয়েছি, কোনোদিন দেখিনি আমার পাশের বাড়িতে এক সাঁওতাল পরিবার ভাড়া থাকেন, অথবা নাটক দেখছি, পাশের সিটে একজন সাঁওতাল, বাজার করছি, একজন সাঁওতালও করছেন, অথবা হাসপাতালে ডাক্তারি করছি, একই হাসপাতালে একজন সাঁওতালও ডাক্তারি করছেন। স্কুল-কলেজে আমি গারো আর চাকমা সহপাঠী পেয়েছি, কিন্তু সাঁওতাল পাইনি। ওরা শিক্ষা-দীক্ষা আর চাকরি-বাকরি কতটুকু চায়, আর এতে বাধা কতটুকু পায়, আমার বড় জানতে ইচ্ছে করে।
সাঁওতালদের নাচ গান পরব উৎসব বেঁচে থাকুক, কিন্তু ওদের কট্টর পুরুষতান্ত্রিক সংস্কৃতি বেঁচে থাকার দরকার কী? ওদের ভূত প্রেতের বিশ্বাস, পাহাড় পুজো, সূর্য পুজো এসব একশ রকম কুসংস্কারকে সম্মান করার, শ্রদ্ধা করার আমি কোনো কারণ দেখি না। শুধু সাঁওতালদের নয়, কোনো গোষ্ঠীর কুসংস্কারকেই সম্মান করা উচিত নয়। মানুষের অধিকারকে যেহেতু মানি, সেহেতু অলৌকিকে বিশ্বাস করার যে অধিকার মানুষের আছে, তাকেও মানি। মানি বলেই ঈশ্বরে বিশ্বাস না করেও ঈশ্বরে বিশ্বাস যারা করে, তাদের বিশ্বাস করার অধিকারের জন্য মিছিলে নামি।
সাঁওতালরা দরিদ্র। তাদের দারিদ্র্য ঘোঁচাবার জন্য কোনো সরকার কি উদ্যোগ নিয়েছেন কখনো? আমার তো মনে হয় না। শুনেছি সরকার উলটে উচ্ছেদ করতে চাইছেন সাঁওতালদের। সরকারের বন্দুকবাহিনী গাইবান্ধার সাঁওতাল এলাকায় গিয়ে বাড়িঘর জ্বালিয়ে দিয়েছে, গুলি করে মেরেছে ওদের। সাঁওতালদের খুন করতে বন্দুক হাতে নিয়েছিল ইংরেজরাও। সেই ১৮৫৫ সালে জমিদার, মহাজন, আর ইংরেজদের অত্যাচারে ষাট হাজার বিক্ষুব্ধ সাঁওতাল তীরধনুক হাতে নিয়ে সশস্ত্র ইংরেজদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। ইংরেজরা পনেরো হাজারেরও বেশি সাঁওতালকে হত্যা করেছিল। সাঁওতালদের গ্রামগুলো জ্বালিয়ে দিয়েছিল। ২০১৬ সালেও সাঁওতালদের গ্রাম জ্বালানো হয়। ঔপনিবেশিক সরকার আর দিশি সরকারের মধ্যে পার্থক্য কোথায়? শাসকের চেহারা ভিন্ন হলেও শোষণের চেহারা এক।
১৮৫৫ সালে সাঁওতাল বিদ্রোহের শ্রেষ্ঠ নায়ক সিদু মাঝি আর কানু মাঝিকে হত্যা করা হয়েছিল। সাঁওতাল বিদ্রোহ ভেঙেচুরে দিয়েছিল ইংরেজরা। একজন ইংরেজ আর্মি অফিসার বলেছিলেন, ‘ওটা যুদ্ধ ছিল না। সাঁওতালরা পরাজয় স্বীকার করতে জানতো না। যতক্ষণ তাদের ড্রাম বাজতো, ততক্ষণ তারা দাঁড়িয়ে থাকবে, আর গুলি খাবে। তাদের তীর আমাদের লোকদেরও খুন করেছে, সে কারণেই আমরা ওদের লক্ষ্য করে গুলি চালিয়েছি, যতক্ষণ ওরা দাঁড়িয়ে ছিল, গুলি চালিয়েছি। ওদের ড্রাম বাজা বন্ধ হলে ওরা সিকি মেইল হেঁটে যেত, কিন্তু বাজনা শুরু হলে আবার ওরা দাঁড়িয়ে যেত। তখন আমরাও নিশ্চিন্তে ওদের বুকে গুলি চালাতাম। আমাদের এমন কোনো সৈন্য নেই, যে কিনা এই যুদ্ধে অপরাধবোধে ভোগেনি।’ চার্লস ডিকেন্স লিখেছিলেন ‘সাঁওতাল গোষ্ঠীর মধ্যে নিজেদের সম্মানবোধটা বেশ ভালোই ছিল। তারা তাদের তীরে বিষ লাগাতো যখন শিকার করতো, কিন্তু কোনো শত্রুর দিকে বিষাক্ত তীর ছোড়েনি। তারা আমাদের শত্রু রাশিয়ানদের চেয়েও নিশ্চয়ই অনেক সভ্য। রাশিয়ানরা তো নিশ্চয়ই সাঁওতালদের কাজকে বোকার কাজ বলতো, আর বলে দিত, এটা কোনো যুদ্ধই নয়।’ সাঁওতাল বিদ্রোহের পর একশ ষাট বছর পার হয়েছে, এখনো সাঁওতালরা আগের মতই হতদরিদ্র, বঞ্চিত, লাঞ্ছিত। জমি বেদখল, সহিংসতা, মিথ্যে মামলা, জাল দলিল, বৈষম্য আর হেনস্থার শিকার হচ্ছে প্রতিদিন। নিজের দেশেই, নিজের স্বাধীন মাটিতেই তারা চরম অবহেলার শিকার হয়ে বেঁচে আছে। আমি বুঝি না, একশ’ ষাট বছরে সাঁওতালদের অবস্থার তো কোনো উন্নতি হয়নি, তবে কেন সাঁওতালরা বিদ্রোহ করেনি আর? ওদের কি আত্মবিশ্বাস নাশ হয়ে গেছে! আবার মনে হয়, এই যে সেদিন সরকারি রিলিফ ফিরিয়ে দিল, এতে তো মনে হয় এখনও চাইলে মেরুদণ্ড টান করে দাঁড়াতে পারে, এখনো তীরধনুক নিয়ে লক্ষ্যভেদি নিশানা করতে পারে। দারিদ্র্য মানুষকে যেমন বিদ্রোহী করে, তেমন দুর্বল করে। সাঁওতালদের সম্ভবত দুর্বলই করেছে দারিদ্র্য। তা না হলে যে লোকেরা সাঁওতালদের নির্যাতন করছে বছরের পর বছর তাদের বিরুদ্ধে ওরা রুখে উঠছে না কেন? ওরা নিশ্চই এর মধ্যে বুঝে গিয়েছে তীর আর গুলির মধ্যে যুদ্ধ বাধতে পারে না। আমার খুব ইচ্ছে করে দেখতে যে তীর ওরা ওদের অত্যাচারীর দিকে ছুড়ছে, সেই তীরের ডগায় বিষ মাখিয়ে নিয়েছে। কিন্তু এও বুঝি এ কোনো সমাধান নয়। সমাধান যার হাতে, সেই সরকারই তো রাতের অন্ধকারে রক্ত নেয়। ইংরেজ সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধে জিততে পারেনি সাঁওতালরা, বাঙালি সরকারের বিরুদ্ধেও পারবে না। মারণাস্ত্রের বিরুদ্ধে তীরধনুক হেরে যায়, ধনীর বিরুদ্ধে গরিবেরা হেরে যায়। সমতার, সমানাধিকারের, সহানুভূতির, সমমর্মিতার আওয়াজগুলো কত যে ফাঁপা, তা আরেকবার স্পষ্ট হয়ে ওঠে। বাংলাদেশে কৃষি কাজ করে বাঁচে সাঁওতালরা। বাঙালির কোনো অনিষ্ট করে না। কিন্তু তারপরও বাঙালিরা ওদের ঘৃণা করে। কালো বলে ঘৃণা করে, গরিব বলে ঘৃণা করে। ওদের ভাষা ভিন্ন বলে, ধর্ম ভিন্ন বলে, সংস্কৃতি ভিন্ন বলে ঘৃণা আমি নিজে বাঙালি হয়ে বলছি, সারা পৃথিবী ঘুরে নানা রকম জাত দেখেছি, বাঙালির মতো এত অসহিষ্ণু, বর্ণবাদী, লোভী, গরিবকে ঘৃণা- দুর্বলকে মারধর-ধনীকে সম্মান করা, হিংসুক, নিষ্ঠুর জাত কমই দেখেছি।
লেখক: নির্বাসিত লেখিকা