বেশ্যাবৃত্তি বিষমবিপত্তি
প্রকাশ | ০৪ জুন ২০১৬, ০৩:১৮
ব্রিটিশ পিরিয়ডে ইংরেজ সরকারের কাছে তাদের সৈন্যরা ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। উনিশ শতকে ব্রিটিশ সৈন্যরা বেশ্যাদের সাথে খুব বেশি সংস্পর্শ স্থাপন করায় তাদের মাঝে যৌন রোগের প্রকোপ ব্যাপকভাবে বেড়ে যায়। এই নিয়ে ইংরেজ সরকার বেশ চিন্তিত হয়ে পড়েছিলেন। ইংরেজ সৈন্যদের মধ্যে যৌনরোগের হার ১৮২৭ এবং ১৮২৯ সালে যথাক্রমে ২৮% এবং ৩১% ছিল, যা কিনা ১৮৬০ সালে বেড়ে দাঁড়িয়েছিল ৭০% এ। তখনকার এক হিসেবে পুরো কলকাতা জুড়ে বেশ্যার সংখ্যা ছিল ৩০,০০০।
উনিশ শতকে লেখালেখি সভাসমিতিতে অংশগ্রহণের পাশাপাশি, সতীদাহ প্রথা রোধ, বিধবা বিবাহের প্রবর্তন, ইত্যাদির মাধ্যমে মেয়েদের সামজিক অবস্থার পরিবর্তন হলেও ভদ্র ঘরের মেয়েরা বাড়ির বাইরে গিয়ে আয় করছে এরকম দৃশ্য বেশ্যাবৃত্তি ছাড়া খুব একটা দেখা যায়নি। প্রতিটি বেশ্যার বেশ্যা হওয়ার পেছনে ইতিহাস থাকে। 'এলোকেশী বেশ্যা' বইয়ে তেমনি ফুটে উঠেছে এলোকেশী কিভাবে বেশ্যাবৃত্তিতে নামে।
ইংরেজ সৈন্যদের মাঝে এসকল যৌনরোগ নিয়ন্ত্রনের জন্য সরকার বেশ্যাদের উপর এক আইন প্রণয়ন করেছিলেন; যার নাম, 'চৌদ্দ আইন'। চৌদ্দ আইনের মানে হলো প্রতিটি বেশ্যাকে প্রতি চৌদ্দ দিবস অন্তর অন্তর থানায় গিয়ে এক ধরনের শারীরিক পরীক্ষা করাতে হত। সেই শারীরিক পরীক্ষায় কোন রোগ ধরা পরলে তাকে পাঠানো হতো 'লক হসপিটাল' এ, সেখানে বন্দি রেখে তাদেরকে চিকিৎসা করানো হতো। লক হসপিটালের ধারণা এসেছিল ইংল্যান্ডে ১৭৬৪ সালে তৈরি করা নেকড়েদের আটক করার জন্য 'লক হসপিটাল’ থেকে। এই আইন অনুযায়ী বেশ্যাদেরকে দুই ভাগে ভাগ করা হয়েছিল। এক ভাগ ইংরেজ সৈন্যদের সাথে মিশতে পারতো; তাদের জন্য ছিলো আলাদা থাকার ব্যবস্থা, অন্যভাগ মিশতে পারতো না। যেহেতু সৈন্যরা মিলিটারী তদারকির অধীনে থাকা বেশ্যা রেখেও বাইরের বেশ্যাদের সাথে অবাধে মেলামেশা করতো, তাই ইংরেজ সরকারের এই আইন সৈন্যদের মাঝে যৌন রোগের প্রাদুর্ভাব কমাতে তো পারেনি উল্টো যখন এই আইন বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল-তখন সৈন্যদের মধ্যে প্রায় ৫০% যৌন রোগে আক্রান্ত ছিল।
তখনকার দিনে রচিত বিভিন্ন সংগীত কাওয়ালী কবিতায়, নাটকে, প্রহসনে এবং সেই সময়ে প্রকাশিত বটতলার বইগুলোতে বিভিন্নভাবে বেশ্যাদের ভোগান্তির কথা উঠে এসেছে। সেই সাথে অনেক গল্প, কবিতা, গান, বই রচিত হয়েছে বেশ্যাদেরকে ঘাতকিনী হিসেবে উল্লেখ করে। চৌদ্দ আইনে বেশ্যাদের ভোগান্তির কোন অন্ত ছিল না। আইন অনুযায়ী প্রতিটি বেশ্যাকে সরকারী ভাবে রেজিস্ট্রারভুক্ত হতে হতো, কয়েক দফা সরকারী কার্য সম্পাদনের মাধ্যমে। প্রত্যেকটা বেশ্যার থাকতো আলাদা আলাদা রেজিস্ট্রি নাম্বার। অন্যদিকে খদ্দেররা ছিলো সমাজের বিভিন্ন মান্য গণ্য ধনবান পুরুষ, যাদের জন্য এরকম কোন ব্যবস্থা তৈরি করা হয়নি। এমন কি যেসব বাড়িতে বেশ্যাবৃত্তি চলতো তাদের মালিকদেরও সমস্ত তথ্য সরকারী নথিভুক্ত করতে হতো। সরকারী ভাবে হুকুম ছিল, প্রতি চৌদ্দ দিন অন্তর অন্তর কোন বেশ্যা ডাক্তারী পরীক্ষা করাতে না গেলে বা যেতে অস্বীকৃতি জানালে তার বিরুদ্ধে জারি হতো সোজা গ্রেফতারী পরোয়ানা। দিনে রাতে যেকোন সময় উক্ত নারীকে পুলিশ এসে ধরে নিয়ে যেতো, এছাড়াও ছিলো বিভিন্ন নিয়মে বিভিন্ন মেয়াদী শাস্তি ও অর্থদন্ডের ব্যবস্থা। উক্ত ডাক্তারী পরীক্ষা এতোই বেদনাদায়ক ছিল যে, সেই সময় ওই পরীক্ষার ভয়ে অনেক বেশ্যাই কলকাতা ছেড়ে ফরাশডাঙ্গায় পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছিল। নৌকায় পলায়নরত অবস্থায়, ঘরের তালা বাইরে দিয়ে লাগিয়ে রাখা অবস্থায়, বাথরুমে লুকিয়ে থাকা অবস্থায় এমনকি ছদ্মবেশে পলায়নরত অবস্থায়ও পুলিশ এসে ডাক্তারি পরীক্ষার নামে বেশ্যাদের ধরে নিতো এবং সেখানে চলতো নির্যাতন। শেষ অবধি সেই পরীক্ষা হয়ে উঠেছিল এক অশ্লীলতা, অনাচার ও অত্যাচারের জায়গা মাত্র।
অনেক বেশ্যাকে এই পরীক্ষা করিয়ে মৃত্যুবরণও করতে হয়েছিল। ওই পরীক্ষার বিষয়ে ২০/০৪/১৮৬৯ সালে সম্বাদ ভাস্বর পত্রিকায় লেখা হয়, ''...তাহারা ওই পরীক্ষিত বেশ্যাগণকে প্রথমে টবে বসাইয়া দেন তাহাতে জলের সহিত জ্বলাকার পদার্থ থাকে। ওই পরীক্ষার পর গর্ভ দর্শণীয় বিশাল যন্ত্র দ্বারা দর্শণ হয়, পরে উগ্রতরো পিচকারী দেওয়া হইয়া থাকে। জনরবকারীরা বলেন ওই পিচকারীতে অনেকের উদর ফুলিয়া জীবন সংশয় হইয়াছে। অতএব উহা যে স্ত্রী দেহের উপযোগী স্বাভাবিক পিচকারী নয় তাহা অবাধেই সাব্যস্ত হইতেছে। এই পিচকারী দানের বিষয়ে পাত্রাপাত্র বিচার নাই, ডাক্তারেরা রজঃস্বলাক্ষেত্রেও উহা প্রয়োগ করিতেছেন, তাহাতে আবার অধিকতর অনিষ্ট হইতেছে, অপরিমিত রুধির ক্ষরণে দুই এক তরুণীর জীবনও গিয়াছে''।
বরাবরে মতো সুশীল সমাজ ছিল বেশ্যাদের বিপক্ষ অবস্থানে। তখনকার সময়ে সমাজসংস্কারক, বুদ্ধিজীবী এবং মহাভারতের অনুবাদক কালীপ্রসন্ন সিংহ সহ আরো অনেক শিক্ষিত সমাজের ব্যাক্তিরা বেশ্যাবৃত্তির বিপক্ষ নিয়ে ইংরেজ সরকারের প্রশংসা করে-বেশ্যাদের জন্য শহরের বাইরে আলাদা আলয় বা নিবাস তৈরির জন্য প্রস্তাব রেখেছিলেন। অবশ্য ইংরেজ সরকারের পরোক্ষ চেষ্টা ছিল এই প্রথা বিলুপ্তির। কিন্তু সরকারের চাওয়াতে কি আসে যায়, যদি না সৈন্যদল, সাধারণ, সুশীল, বিত্তবান পুরুষেরা বেশ্যালয়ে যাওয়া বন্ধ না করেন। বেশ্যা প্রথা টিকে যায় এবং টিকে থাকে যুগে যুগে কালে কালে, কারণ আমরা দিনের বেলা বেশ্যাদের ঘৃণা করি এবং রাতের বেলায় আমরাই তাদেরকে বুকে টেনে নেই।
তথ্য সংগ্রহঃ মৌ ভট্টাচার্য সম্পাদিত বেশ্যাপাড়ার পাঁচটি দুর্লভ সংগ্রহ।
অন্নপূর্ণা দেবীর ফেসবুক থেকে