‘ছেলেরা একেকটা স্পয়েল্ট ব্র্যাট’
প্রকাশ | ০২ জুন ২০১৬, ১৬:৫০ | আপডেট: ০২ জুন ২০১৬, ১৭:০৮
বাংলার--দুই বাংলারই মধ্যবিত্ত এবং উচ্চবিত্ত ঘরের ছেলেরা একেকটা স্পয়েল্ট ব্র্যাট। শুধু বাংলাই বা বলি কেন, পুরো ভারতবর্ষেই, বা ভারতীয় উপমহাদেশেই দেখছি একই ঘটনা। সন্তানদের, মূলত ছেলেদের, সুস্থ স্বাভাবিক ভাবে গড়ে উঠতে দেন না বাবা-মা। শুরু থেকেই পরনির্ভর বানান। পঙ্গু বানান। সংসারের কোনও কাজ করতে ছেলেদের শেখান না।
দুনিয়ার বাস্তবতা থেকে ওদের দূরে সরিয়ে রাখেন। নিজের ঘর নিজে গুছিয়ে রাখা, নিজের জামা কাপড় পরিস্কার রাখা, ইস্কুলের জন্য নিজে নিজে তৈরি হওয়া, নিজের খাবার নিজে বানাতে শেখা, সময়মতো খাবার খেয়ে নেওয়া, বাসনপত্র ধুয়ে রাখা, বাড়ির টুকিটাকি কাজ করা - নাহ, এসব কিছুই ছেলেকে করতে দেবেন না বাবা-মা।
ছেলেকে স্বনির্ভর হতে দিতে নারাজ তাঁরা। ছেলে যা চায়, যে জিনিসই চায়, তাই দেবেন বাবা মা। যে করেই হোক দেবেন, সাধ্যের বাইরে হলেও দেবেন।
কলকাতার অনেক পরিবারে দেখেছি ছেলের চৌদ্দ পনেরো বছর বয়স হয়ে গেলেও বাবা-মা ছেলের জন্য আলাদা ঘর বা আলাদা বিছানার ব্যবস্থা করেন না, নিজেদের বিছানাতেই ছেলেকে ঘুমোতে দেন। এমন ভাবে মা-নির্ভর হয়ে ওঠে ছেলেরা যে বিয়ের পর বিবাহিত হয় বটে, বড় হয় না। যত পুরুষ দেখি চারদিকে, সব পুরুষই পরনির্ভর। হয় বাবা-মার ওপর নির্ভরশীল, নয়তো স্ত্রীর ওপর। বাবা-মার ওপর নির্ভরশীল ছোটবেলায় সকলেই থাকে। কিন্তু তারপর তো ধীরে ধীরে বড় হয় , পৃথিবীর পথে একা চলার জন্য প্রস্তুত হয়।
আমাদের অঞ্চলের ছেলেদের এই প্রস্তুতি নেওয়া হয় না। তাদের কখনও সত্যিকার অর্থে স্বনির্ভর হওয়া হয় না। যে বয়সে পাশ্চাত্যের ছেলেরা ব্যাকপ্যাক নিয়ে পৃথিবী আবিস্কারে বেরিয়ে পড়ে, সে বয়সে আমাদের বাঙালি ছেলেরা মা খাইয়ে না দিলে নিজের হাতে ভাতটাও খেতে পারে না।
স্পয়েল্ট ব্র্যাটগুলোর প্রশংসায় পঞ্চমুখ বাবা-মা। ছেলে কাঁটা বেছে মাছ খেতে জানে না, জলটাও গ্লাসে ভরে খেতে জানে না, জুতোর ফিতে বাঁধতে জানে না,নিজের বিছানাপত্তর গুছিয়ে রাখতে জানে না - এ নিয়ে অস্বস্তি হওয়ার বদলে বাবা-মা’র স্বস্তি হয়। ছেলেকে নিজেদের ওপর নির্ভরশীল বানানোর বড় মওকা পেয়ে যান তাঁরা। তাঁরা কি সত্যিই সন্তানদের ভালোবাসেন?
দু'দিন আগে ভালো ছাত্র নামধারী বাংলাদেশের কিছু ছেলের ভয়ংকর অজ্ঞতার নমুনা টিভিতে প্রচার হয়েছে। এ নিয়ে টিভির বিরুদ্ধে মানুষের সে কী প্রতিবাদ! সকলেই ছেলেগুলোর পক্ষ নিয়েছে। যত ভুলই ছেলেরা করুক, তাদের কটাক্ষ করা যাবে না। যত হাস্যকর উত্তরই ছেলেরা দিক, হাসা নৈব নৈব চ। যত অন্যায়ই ওরা করুক, প্রতিবাদ করা যাবে না। ওরা ছেলে। ওরা পুত্রধন। ওরা ভগবান। ওদের কোমল হৃদয়, কটাাক্ষ করলে ওদের কষ্ট হবে, অভিমান হবে। ওরা ছাত্র। পরীক্ষা দিয়েছে, পাশ করেছে। এ কী কম কথা! ওরা মহান। ওরা বিশাল। ওরা গুষ্ঠি উদ্ধার করেছে। না, এভাবে ছেলেরা আর যাই হোক, মানুষ হয় না। হয়তো পরীক্ষায় ভালো নম্বর পায়, চাকরি বাকরি ব্যবসা বাণিজ্য জুটিয়ে ফেলে কিছু, কিন্তু জীবনের অনেক প্রশ্নে অজ্ঞ আর অশিক্ষিতই থেকে যায়।
লেখিকা তসলিমা নাসরিন এর ফেসবুক স্ট্যাটাস থেকে