সমসাময়িক ক্রাইম-ট্রেন্ড ও রাষ্ট্রযন্ত্রের ডিনায়্যাল
প্রকাশ | ০৫ নভেম্বর ২০১৬, ২২:২০ | আপডেট: ০৫ নভেম্বর ২০১৬, ২২:৫১
পোশাক-আশাকের তথা ফ্যাশন ট্রেন্ডের মতো দেশের অপরাধ প্রবণতারও যে একটি ট্রেন্ড রয়েছে সেটা লক্ষ্য করছি অনেকদিন ধরে। আশির দশকের এসিড সন্ত্রাসের যে ট্রেন্ড চলমান ছিল (মূলতঃ নারীদের লক্ষ্য করে) তা থেকে আমরা উত্তরণ পেয়েছিলাম। তবে বর্তমান সময়ের নতুন নানা ট্রেন্ড আমরা উতরাতে পারছি না। বরং দিনকে দিন এসমস্ত ট্রেন্ড প্রবলগতিতে জনজীবন বিপন্ন করছে।
কিছুদিন চলন্ত বাসে/গাড়িতে ধর্ষণের ট্রেন্ড বেশ চলমান ছিল। অসংখ্য নারী সেই ট্রেন্ডের বলি হয়েছেন। এখন তা খানিকটা স্তিমিত, যদিও আর কোন নারী যে সহসাই আবারো এই ট্রেন্ডের বলি হবেন না - এমন কথা নিশ্চিত করে বলা যাবে না। সাম্প্রতিক সময়ে তনুর ধর্ষণ ও হত্যাকান্ডের পর একই ধরণের ঘটনার পুনরাবৃত্তি হয়েছে বেশ নিয়মিতভাবেই। যেহেতু 'নো ওয়ান কিলড তনু' সেহেতু সমকালীন সেসব ঘটনা ক্রমে বিলীন হয়েছে কালের গহীন গহ্বরে।
এর কিছুদিন পরই চাকু ট্রেন্ডের আবির্ভাব ঘটে। এ ট্রেন্ডের প্রথম শিকার হয় উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুলের ছাত্রী রিশা! সেই ছাত্রী ছুরিকাহত হওয়ার পর পরই আমরা একই ধরনের অনেকগুলো ঘটনা দেখতে পেলাম; ছুরি থেকে কাস্তে- চাপাতি। সর্বশেষ সাভারের এক গৃহবধূকে 'প্রেমের প্রস্তাবে' সাড়া না দেয়ার 'অপরাধে' প্রাণ দিতে হল। কিছুদিন আগে আমরা পেটে হাওয়া ঢুকিয়ে পৈশাচিকভাবে শিশু হত্যা দেখেছি বেশ কয়েকটি। পাশাপাশি চুরির অভিযোগে প্রকাশ্য জনসমক্ষে বীরবিক্রমে পিটিয়ে শিশুদের মেরে ফেলার প্রদর্শনীও দেখেছি নির্লিপ্তভাবে।
এ মূহুর্তে লেটেস্ট ট্রেন্ড হলো খুব বীভৎসভাবে অপ্রাপ্তবয়স্ক কন্যাশিশু ধর্ষণ, নির্যাতন ও হত্যা! পরপর অতিদ্রুত ঘটে গেলো এমন কয়েকটি ঘটনা। এসব ঘটনার ভিক্টিমদের বয়স তিন থেকে পাঁচের মধ্যে আর ঘটনার বিবরণ মধ্যযুগীয় নারকীয়তাকেও হার মানায়। পাশাপাশি অতি সম্প্রতি শুরু হয়েছে সংখ্যালঘুদের প্রতিমাসহ বাড়িঘর ভাঙচুরের ট্রেন্ড! যদিও আমি সংখ্যালঘু শব্দটি বলতে নারাজ, নিজে লজ্জাবোধ করি কাউকে ক্ষুদ্র হিসেবে তুলে ধরতে। দুর্বল ও প্রান্তিকদের উপর চালানো জ্বালাও-পোড়াও-ভাঙচুর এর সাথে সাথে ভিন্নমত পোষণকারীদের উপর নাজেল হওয়া 'চাপাতি ট্রেন্ড' তো বহাল তবিয়তেই বহমান!
এক সময় এমন কথা প্রচলিত ছিল (এবং তা বেশ 'জনপ্রিয়ও' ছিল) যে মেয়েরা 'যৌন-উত্তেজক' পোশাক পরার কারণে 'বাধ্য হয়েই' পুরুষেরা তাদেরকে ধর্ষণ করে! যদিও সাম্প্রতিককালের রেপ ভিক্টিমদের অনেকেই হিজাব-নেকাব-বোরখায় আবৃত ছিলেন। আর এ সময়ে যে সব দুধের বাচ্চা মেয়ে ধর্ষণের শিকার হচ্ছে তাদের তো পোশাকও কি 'যৌন-উত্তেজক'? এ বয়সে তো আমরা শুধু একটা হাফপ্যান্ট পরে খালি গায়েই বড় হয়েছি।
আমার বিশ্বাস, দেশের সিংহভাগ মানুষই চলমান এসব ট্রেন্ডের বিপক্ষে; তারপরও কেন এসব ট্রেন্ড আরো শক্তিশালী হচ্ছে? কেন তীব্রতর হচ্ছে প্রতিনিয়ত? একটা সময় ছিল যখন চোখের সামনে কেউ কোন অন্যায় করলে তাকে বারণ করা হতো, তার পরিবারের কাছে নালিশ জানানো হতো। কিন্ত এখন মানুষ এতো বেশি আত্নকেন্দ্রিক হয়ে গেছে যে কারও বিপদে কেউ এগিয়ে আসে না সহজে। আর যেহেতু অন্যায়গুলো করছে মূলতঃ ক্ষমতাশীলরা, সাধারণ মানুষ দাঁড়াতে পারছে না এদের বিরুদ্ধে। রাজনীতি, কালো টাকা আর লেলিহান লোভের মেরি-গো-রাউন্ডে চেপে ঘুরছে দুষ্টচক্র।
বিচারহীনতার সংস্কৃতি একদিকে যেমন অপরাধপ্রবণদের উৎসাহিত করছে অন্যদিকে রাষ্টযন্ত্র ও তার 'দায়িত্বশীল' ব্যক্তি/প্রতিষ্ঠানের অস্বীকারের (ডিনায়্যাল) সংস্কৃতি পরিস্থিতিকে করে তুলছে আরও দুরূহ। উত্তরণ ও প্রশমনের পরিবর্তে বেড়ে চলেছে অপরাধী চাষের যৌথ খামার। রাষ্ট্র যদি চলমান এসকল ট্রেন্ড নির্মূলে অতিসত্তর কঠোর ও কার্যকরী ব্যবস্থা না নেয় তবে সোনার বাংলা যে তামা তামা হয়ে যাবে সেটা বোঝার জন্য বিশেষজ্ঞ হওয়ার দরকার নেই।
মাহফুজা আখতার এর ফেসবুক থেকে