আমরা যদি এখনো না জাগি তাহলে...
প্রকাশ | ২৬ অক্টোবর ২০১৬, ১৪:২১ | আপডেট: ০৭ নভেম্বর ২০১৬, ২২:০১
কেন উল্টোটা হয় না, কেন আমরা নিশ্চয় করে বলতে পারি না এই পাঁচ বছরের শিশুটি যখন সুস্থ হয়ে বড় হয়ে উঠবে তখন সে দেখবে এ ধরনের একটি ঘটনাই কারো জীবনকে নির্ধারিত করে দেয় না, এই তীব্র কষ্টকর অভিজ্ঞতাকে ভুলে সামনে এগিয়ে যেতে পরিচিত সবাই সহযোগিতা করছে, প্রতিবেশীরা তাদের অতি আগ্রহের জায়গা থেকে সরে এসে সত্যিকার অর্থে ধর্ষিতাকে সে সময়টুকু ভুলে থেকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যেতে সহায়তা করছে, যাবতীয় ব্লেইম-গেইম এর চিত্র পাল্টে গেছে, অপামান ও ঘৃণাটুকু শুধুই ধর্ষকের জন্য বরাদ্দ, ধর্ষক আর তার পক্ষে সাফাই গাওয়ারা সমাজে ঘৃণিত। তাই ধর্ষণ আর প্রতিদিনের খবরের কাগজের চিত্র নয়, বরং প্রতিটি ধর্ষণ বা ধর্ষণচেষ্টা রিপোর্টেড হচ্ছে আর ধর্ষক সমাজের ক্ষমতা কাঠামোর যে স্তরেই থাকুক না কেন দ্রুততার সাথে তার বিচার হচ্ছে।
এমনটাই কিন্তু হওয়ার কথা ছিলো, আর এমনটা হতেই পারে যদি আমরা আমাদের মানসিক দৈন্যতাগুলো সারিয়ে নেই, আমার ছেলে সন্তানটিকে সঠিক শিক্ষা দেই, পরিবারে ভাই ও বোনকে সমান মর্যাদায় বড় করে তুলি, নারীকে অবজেক্ট নয় মানুষ হিসেবে দেখা শুরু করি। এ শিক্ষা শুরু হতে পারে পরিবার থেকে। কিন্তু সামাজিকীকরণ এর সাথে জড়িত প্রত্যেকটি প্রতিষ্ঠানকে এখানে এগিয়ে আসতে হবে, শুধু বিদ্যালয়ের পরীক্ষা পাশ করা শিক্ষা নয় শিক্ষকদের সাম্যতাবোধ নিজের মাঝে ধারণ করে শিক্ষার্থীদের মাঝে তা ছড়িয়ে দিতে হবে, গণমাধ্যমকে নারীর অবজেক্টিফিকেশনের জায়গা থেকে সরে এসে দোষেগুনে একজন মানুষ হিসেবে তুলে ধরতে হবে, বিগত বছর ধরে হয়ে আসা পুরুষ এর আধিপত্য উপস্থাপনের স্থলে নারীর সাফল্য ও অবদানগুলো তুলে ধরতে হবে, প্রতিদ্বন্দ্বী বা প্রতিযোগী নয় সহযোগী হিসেবে পরিবারিক সম্পর্কগুলোকে তুলে ধরতে হবে।
ধর্ষণেচ্ছার মূলে রয়েছে ক্ষমতার প্রয়োগ, আরর আধিপত্যের চর্চা, অন্যকে তুচ্ছ প্রতিপাদ্য করা, কাউকে চরমভাবে অপমানিত অপদস্ত করা, ইচ্ছের বিরুদ্ধে বল প্রয়োগ করে তার মূল্যবান কিছু ছিনিয়ে নেয়া, আর এর সবচেয়ে বড় বর্ম হচ্ছে নৈশঃব্দের বর্ম, নিপীড়ক ধরেই নেয় যে সম্মানহানীর ভয়ে তার পরিচয় আড়াল থাকবে। ধর্ষকরা একদিনে গড়ে উঠে না। সমাজের প্রচলিত ধারণাগুলোই তাকে মাথাচাড়া দিতে সহায়তা করে, আজকের যৌন নিপীড়নের ঘটনা চাপা দেয়ার মাধ্যমে, আপনি আমি ধর্ষককে ইন্ধন দেই।
'ধর্ষণে নারীর সম্মান যায়' যোনীকেন্দ্রিক-সম্মানের এই ধারনা থেকে সরে আসতে হবে, যাবতীয় ব্লেইম-গেইম থেকে ধর্ষিতাকে রেহাই দিতে হবে। অন্যান্য অপরাধের মতো এখানেও সকল লজ্জা ও অসম্মান অপরাধীর, ধর্ষকেরই প্রাপ্য এটা সামাজিকভাবে প্রতিষ্ঠা করতে হবে আমাদের। ভিক্টিমকে ফোকাস করে কেবলমাত্র সিমপ্যাথী টানার 'আহারে-উহুরে' করার ও তার চরিত্র ও পোশাকের দোষ খুঁজে বেড়ানোর চর্চা থেকে সরে আসতে হবে। যত তাড়াতাড়ি আমরা বুঝতে পারবো এ প্রক্রিয়ায় প্রকারান্তরে আমরা ধর্ষককেই উৎসাহিত করছি এবং একদিন হয়তো আমিই আমার সমস্ত ইনোসেন্স নিয়েই আক্রান্ত হবো ততই মঙ্গল। এ চিন্তাধারা প্রতিষ্ঠিত হলে ধর্ষণ-নিপীড়নের অধিকাংশ ঘটনা রেকর্ডেড হত, আর এর দ্রুত কঠোর বিচার নিশ্চিত করতে পারলে এর হারটাও কমে আসতো।
আর সব দায় সমাজ, গণমাধ্যম আর সমাজসেবকদের ঘাড়ে দিয়ে আপনি আমি যদি ঘরে বসে পরম্পরাবোধ থেকে মাছের মাথা, দুধ, ডিম আদর করে ছেলে বা স্বামীজীকে খাইয়ে যাই, আর কেবলমাত্র মেয়েটিকে আদব আর সহমত শিক্ষা দিয়ে ছেলেকে শিখাই তুমিই পুরুষসিংহ তাহলে কোনকালেই কিচ্ছু হবে না। প্রত্যেকেরই নিজ নিজ অবস্থান থেকে করার আছে অনেককিছু। প্রত্যেকের আন্তরিকতাই পরিবর্তন আনবে। আর নয়তো অন্ধকার থেকে যে গহীন অন্ধকার যুগে আমরা প্রবেশ করতে যাচ্ছি তাতে দিনে-দুপুরে পরিবারের বোন, মা, স্ত্রী, মেয়ে, পুত্রবধূ সবার অক্ষত যোনীর চিন্তায় অষ্টপ্রহর তটস্থ থাকলেও কোন ফল নেই। বয়স-ধর্ম-পোশাক-সামাজিক অবস্থান-অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতা ভেদে আত্মীয়-পরিবার-প্রতিবেশী-পরিচিত-কলিগ-অজ্ঞাতনামা যুবক-মধ্যবয়স্ক-বৃদ্ধ নির্বিশেষে, কারো কাছে আমি-আপনি কিংবা আপনার মা-সন্তান-ভালোবাসার মানুষ কেউই আর নিরাপদ না।
জ্বী অবস্থা এখন এমনই গুরুতর। কাজেই আমরা যদি এখনো না জাগি তাহলে...
জোহরা রিতু'র ফেসবুক থেকে