ধর্মের খেলা!
প্রকাশ | ১৪ অক্টোবর ২০১৬, ০১:৩১
আমি যখন ছোট ছিলাম, তখন ধর্ম নিয়ে মাথা ঘামাতাম না, ওসব আমি ঠিক বুঝতাম না। আরও একটু বড় হওয়ার পর বুঝলাম ধর্ম, ঈশ্বর, -- সবই কাল্পনিক। তখন ভাবতাম ধর্মটর্ম বুঝি আমার মায়ের মত ইমোশোনাল কিংবা দুর্বল হৃদয়ের মানুষরাই পালন করে। ভাবতাম, ইয়াং জেনারেশন নিশ্চয়ই এই জাতীয় কাল্পনিক বিষয়গুলো বিশ্বাস করে না।
আমার স্কুল জীবনের অধিকাংশ বন্ধু-বান্ধব ফাজিল টাইপ ছিলো। কাজেই আমাদের ফাজলামি থেকে ধর্মও রেহাই পেতো না। ধর্ম বিষয়টাকে কখনো পাত্তা দিই নি।
ধর্ম-ক্লাসে সাধারণত আমাদের ধর্ম-টিচার ধর্ম-বইয়ের গল্প ‘রিডিং’ পড়তেন, সেসব নিয়ে আলোচনা করতেন। একদিন একটা গল্প পড়া শুরু করেলন, গল্পটা হল--একবার ব্রহ্মা বিশ্রাম নিতে কোনো এক আশ্রমে গেলেন। তো দেবতা-মানব-দানব অনেকেই ব্রহ্মার কাছে উপদেশ নিতে এসেছে। ব্রহ্মা সবাইকে এক কথায় উপদেশ দিলেন, ‘দ’। দেবতারা যেহেতু অনেক ধন সম্পদের মালিক তারা ধরে নিয়েছে যে, ব্রহ্মা তাদেরকে ‘দ’ মানে দান করতে বলেছেন। মানবেরা যেহেতু লোভী প্রকৃতির হয়, কাজেই তারা ধরে নিয়েছে, ‘দ’ বলতে ব্রহ্মা তাদেরকে দমন করতে মানে, নিজেদের লোভকে দমন করতে বলেছেন। আবার দানব অর্থাৎ দৈত্যরা ভাবল যে, তারা যেহেতু নির্দয়, ব্রহ্মা তাদেরকে দয়াশীল হওয়ার উপদেশ দিয়েছেন।
ধর্ম-শিক্ষকের গল্প পড়া শেষ হলে, আমরা বন্ধুরা একজন আরেকজনের দিকে তাকিয়ে হাসলাম। একজন বলল, ব্রহ্মা আসলে ‘দ’ বলতে কী বুঝিয়েছিলেন বলতো, আরেকজন বলল, ব্রহ্মা বিশ্রাম নিতে জঙ্গলে এলেন, এরমধ্যে তাকে উপদেশের জন্য বিরক্ত করছিল, তাই বললেন ‘দ’ মানে ‘দূর হও’। আর এইসব মাথা নষ্টগুলো এর কত অর্থ বানিয়ে ফেললো। তারপর এটা নিয়ে কতক্ষন হাসাহাসি হল। তো, এই ছিল আমার ধর্ম।
মাঝেমাঝে ধর্ম নিয়ে বিভিন্ন মানুষের সাথে কথা বলে বুঝতে পারলাম, ধর্ম একটি সিরিয়াস বিষয়। অধিকাংশ মানুষই এই বিষয়টাকে ভয় পায়, কাল্পনিক ঈশ্বরের ভয়ে কত কিছুই যে করে! এসব দেখে আমার হাসি পেতো। মনে হতো, আমার মত একটা ছোট মানুষ বুঝতে পারছে যে, ঈশ্বর আল্লাহ সব কাল্পনিক, ধর্ম মানুষেরই সৃষ্ট কিছু নিয়ম, সেখানে বড় মানুষগুলো বোকার মত এসব হাবিজাবি কাহিনী বিশ্বাস করে কেন?
ধীরে ধীরে আরও একটু বড় হয়ে, বইপত্র পড়ে টের পেলাম যে, ধর্ম কেবলই একটি সিরিয়াস বিষয় নয়, বরং ভয়ংকর সিরিয়াস জাতীয় কিছু। এটি এতই ভয়ংকর যে, এটি রক্ষা করতে মানুষকে খুন করা হয়, নির্বাসিত করা হয়, ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য এটি একটি অত্যন্ত মূল্যবান সিঁড়ি।
রাজনীতিবিদরা এই সিঁড়ির প্রতি খুবই যত্নবান। এটা অপরাধ ঢাকার ঢাল হিসেবেও ব্যবহৃত হয়। জঘন্য জঘন্য সব অপরাধ করেও যদি ইমেজ ঠিক রাখতে চান, তবে ধর্মিক ইমেজটা বজায় রাখা অত্যন্ত জরুরী।
আমি এমনিতেই সিরিয়াস টাইপ কিছু ভাবতে পারি না, কাজেই এই ভয়ংকর সিরিয়াস বিষয়টা থেকে সবসময় নিরাপদ দুরত্ব বজায় রাখতাম। কিন্তু দূরে গিয়েও রক্ষা নেই। কেন আমি ধর্ম পালন করি না, এইসব নিয়ে প্রশ্ন, ধর্ম পালনে বাধ্য করা.. এইসবে খুব বিরক্ত হতাম। এভাবে ধর্মের প্রতি আমার তীব্র ঘৃণা সৃষ্টি হয়েছিল। কিন্তু কোনো ধর্মের মানুষে প্রতি কোনো রকম ঘৃণা আমার ছিল না। কিন্তু লক্ষ্য করতাম, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই, এক ধর্মের মানুষের অন্য ধর্মের মানুষের প্রতি ঘৃণা ভাব থাকেই।
২৪ জুলাই, ২০১৪ সালে অভিজিৎ রায় তার ফেইসবুকের একটি স্ট্যাটাসে লিখেছিলেন, ‘আমি নাস্তিক। কিন্তু আমার আশে পাশের বহু কাছের মানুষজন বন্ধু বান্ধবই মুসলিম। তাদের উপর আমার কোন রাগ নেই, নেই কোন ঘৃণা। তাদের আনন্দের দিনে আমিও আনন্দিত হই। তাদের উপর নিপীড়ন হলে আমিও বেদনার্ত হই। প্যালেস্টাইনে বা কাশ্মীরে মুসলিম জনগোষ্ঠীর উপর অত্যাচার হলে তাদের পাশে দাঁড়াতে কার্পণ্য বোধ করি না। অতীতেও দাঁড়িয়েছি, ভবিষ্যতেও দাঁড়াবো। এটাই আমার মানবতার শিক্ষা’।
অভিজিৎ রায়ের জন্মদিনে তাঁকে নিয়ে কিছু লিখব ভাবতেই তাঁর এই স্ট্যাটাসের কথা মনে পড়ে গেলো। অভিজিৎ রায়ের মৃত্যুর পর কলেজের এক বন্ধু মন্তব্য করেছিল, ‘আমাদের দেশে প্রতিদিন কত অভিজিৎ মারা যাচ্ছে, এক অভিজিৎকে নিয়ে এত কান্নাকাটির কী আছে?’ তাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, আমাকে কুপিয়ে ফেলে গেলেও কি সে এই জাতীয় কোনো মন্তব্য করবে কিনা। সে চুপ হয়ে গেলো।
অভিজিৎ রায় একজন নাস্তিক ছিলেন, তিনি ধর্মে বিশ্বাস করতেন না। নিজেকে হিন্দু মুসলিম না ভেবে মানুষ ভাবতেন। মানুষের প্রতি তাঁর কখনো বিদ্বেষ ছিল না, ভালোবাসা ছিল। অভিজিৎ রায়ের মত মানুষ প্রতিদিন জন্মায় না। সমাজটাকে সুন্দর-সভ্য করতে, তাঁর মত মানুষেরা তাঁদের চিন্তা-চেতনা মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে চান। আর যারা চায়, মানুষ নিজেকে মানুষ না ভেবে ধার্মিক ভাবুক, চোখ বন্ধ করে সত্য কে অস্বীকার করুক, তারা অভিজিৎ রায়দের হত্যা করে। কিন্তু হত্যা করলে, ভয় দেখালেই কি সত্য বদলে যায়?
লেখক: আহবায়ক, তসলিমা পক্ষ