সতীত্ব পরীক্ষার নামে নারীদের যে হয়রানির শিকার হতে হয়
প্রকাশ | ১৪ অক্টোবর ২০১৬, ০১:২০
মানব সভ্যতার ইতিহাসে বর্তমান পৃথিবী সবচেয়ে সমৃদ্ধশালী এবং মানবিক হয়েছে বলে বিবেচনা করা হয়। সভ্যতার এ অগ্রগতিতে নারী পুরুষতান্ত্রিক প্রথার সতীত্বের কারাগারে বন্দী। পৃথিবীর প্রায় সকল রক্ষণশীল দেশেগুলোতে পিতৃতান্ত্রিক সমাজে নারীর শরীরকে নারীর সম্ভ্রম হিসেবে দেখা হয়, বিবাহের পূর্বে কোন নারীর পুরুষের সঙ্গে যৌন সম্পর্ক ব্যভিচারী বলে গণ্য হয়। ধর্মমতে ও পুরুষতান্ত্রিক সমাজে স্বামী ব্যতীত অন্য কোন পুরুষের সঙ্গে নারীর সহবাস বা যে কোন যৌন আচরণ নিষিদ্ধ এবং একে ব্যভিচারী ও অপরাধ বলে গণনা করা হয়, এ অপরাধ শাস্তিযোগ্য অপরাধ। নারীর ইচ্ছের বিরুদ্ধে যদি কোন পুরুষ তার সঙ্গে যৌন সংসর্গ করে বা ধর্ষণ করে তবুও নারী অপরাধী বলেই গণিত হবে ও শাস্তি অবশ্যই ভোগ করতে হবে।
এ সমাজ পুরুষকে ভাবতে শিখিয়েছে পুরুষই একমাত্র মানুষ। যদিও নারী মানুষ হয়েই জন্মায়, জন্মানোর পরে তাকে নারী রূপে তৈরি করা হয়- কেননা এ সমাজ হাজার বছর ধরে শিক্ষা ব্যবস্থা পুরুষের পক্ষেই তৈরি করে রেখেছে। নারী জন্মায় শুধু পুরুষের সেবাদাসী হয়ে, যৌনদাসী হয়ে, পুরুষের ভোগের ভোগের সামগ্রী হয়ে। নারী জন্মায় পুরুষ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হওয়ার জন্য, পুরুষের আজ্ঞা যথাযথ পালনের জন্য; এটা কোন নারীর চাওয়াতে ঘটে না, ঘটে পুরুষতন্ত্রের চাওয়াতে, ধর্মের চাওয়াতে, পুরাতন রুগ্ন সমাজ ব্যবস্থার চাওয়াতে। এই চাওয়াগুলোর পুরোটার দাবীদার পুরুষ, পুরুষের আদিম আকাঙ্ক্ষিত চাওয়া নারীর শরীর, নারীর সতীত্ব, আনন্দের জন্য, মানসিক-শারীরিক তৃপ্তির জন্য, ভোগবিলাসের জন্য। পুরুষতন্ত্র, ধর্ম ও সমাজ ব্যবস্থা মানুষ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে একমাত্র পুরুষকে, নারীকে করেছে পুরুষের সেবাদাসী ও যৌনদাসী। নারী স্বাধীনতা এ সমাজের প্রচলিত প্রথাগুলো স্বীকার করে না। নারীর কোন ইচ্ছে থাকতে নেই, নারীর একমাত্র কাজ পুরুষকে খুশী করা, পুরুষের মেজাজ মর্জিকে প্রাধান্য দেয়া। অর্থাৎ পুরুষের ইচ্ছেই নারীর ইচ্ছে। যেন নারীর জন্মই যৌনবিকৃত রুচি সম্পন্ন পুরুষের যৌন লালসা পূরণের জন্য। এ ক্ষেত্রে নারীর একমাত্র কাজ মুখ বুজে পুরুষের সকল অত্যাচার সহ্য করা, তবেই সে ভাল নারী। যে নারী যত বেশি মুখ বুজে মেনে নিতে পারে এ সমাজ সে নারীকে ভাল মেয়েমানুষ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। সতীত্ব শব্দটি নারীর মাথায় এমনভাবে গেঁথে দেওয়া হয়, নারী তার কৌমার্য রক্ষায় হয়ে ওঠে বদ্ধপরিকর। বেশীরভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায় শ্লীলতাহানীর ভয়ে পুরুষের সব ধরনের অত্যাচার নারী মেনে নিতে বাধ্য হয়।
”সব ধর্মেই নারী অশুভ, দূষিত, কামদানবী। নারীর কাজ নিষ্পাপ স্বর্গীয় পুরুষদের পাপবিদ্ধ করা; এবং সব ধর্মেই নারী অসম্পূর্ণ মানুষ।” ( হুমায়ুন আজাদ_নারী, পৃঃ ৮২)
অভিধানে সৎ শব্দটির অর্থ বিপরীত অর্থ সতী, পুরুষ সৎ আর নারী সতী। সৎ পুরুষ মানুষ মানে ভাল মানুষ। পুরুষের কিছু কর্মকে বুঝায় যেমন বিদ্ধান, জ্ঞানী, সত্য, সাধু, শুভ, সৎসাহস অর্থাৎ যে পুরুষ ভাল কাজ, পুণ্যের কাজ ও জনহিতকর কাজ করে সে সৎ। সৎ এর স্ত্রীলিঙ্গ সতী হলেও কার্যত এ শব্দ দুটির মধ্যে পার্থক্য অনেক। সতী শব্দটির মধ্যে সৎ শব্দটির গুনাবলী প্রকাশিত নয়। সতী বলতে প্রতিব্রতা, স্বামী ভিন্ন অন্য পুরুষে আসক্ত নয় এমন নারীকে বুঝায়। নারীর যৌন পবিত্রতা, পতিব্রত্য, সতী স্ত্রীর ধর্ম।
বাংলাদেশ, ভারতসহ দক্ষিন এশিয়ার অনেক দেশে কুমারিত্বের অগ্নিপরীক্ষা সম্পর্কে ছোটবেলা থেকেই মেয়ে শিশুকে শিক্ষা দেয়া হয় নিজ শরীর সম্পর্কে। সমাজের কাছে সতীত্ব (virginity) একটি গুরুত্বপূর্ণ শব্দ, এ শব্দটি শুধুমাত্র নারীর জন্য। সতী নারী মানে কুমারী নারী, যে নারীর যোনী কোন পুরুষের স্পর্শ এখনো পায়নি। নারীর জন্য সতীত্ব। অথচ নারীর শরীরে কোন পুরুষের স্পর্শ পাওয়া মানে ঐ শরীর নষ্ট হয়ে যাওয়া, স্পর্শকারী পুরুষের শরীর তাতে নষ্ট হয় না, নারী একাই সতীত্ব হারায়। স্বামী ব্যতিত অন্য কোন পুরুষের সঙ্গে সহবাস করা মানে মেয়েটি অসতী হয়ে যায়, অসতী মেয়েকে এ সমাজের পুরুষেরা বিয়ে করতে অপারগতা ও অনিচ্ছা প্রকাশ করে। সব ধরনের জীবাণুর আক্রমণ থেকে নারীর শরীরটিকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে শুধু একটি মাত্র পুরুষ(স্বামী) নামক জীবাণুর জন্য। বিয়ের প্রথম রাতে নারী সতীত্বের বা কুমারীত্বের (virginity test) পরীক্ষা দেবে! বাংলাদেশসহ রক্ষণশীল মুসলিম ও অমুসলিম দেশগুলোতে সতীত্বের সামাজিক ও ধার্মিক গুরুত্ব অনেক। সতীত্বের প্রমাণ হিসেবে দেখা হয় তার যৌনাঙ্গের ভেতরে সতিচ্ছদ পর্দা অক্ষত আছে কিনা বা আগে কখনো সে যৌন সম্পর্ক করেনি, বিয়ের রাতে তা প্রমাণের জন্য তাই প্রয়োজনে অনেক নারী অস্ত্রোপচার করতে বাধ্য হয়।
এককালে ভারতবর্ষে সতীত্ব হারানোর অভিযোগে স্ত্রী সীতাকে বিসর্জন দিয়েছিলেন রাম। আর এ যুগে পুরুষের বিকৃত মানসিকতার কাছে নারীদের দিতে হচ্ছে ‘দুই আঙ্গুল পরীক্ষা’ (two finger examination), আবার কোথাও গ্রাম পঞ্চায়েতের সামনে উত্তপ্ত লোহার রড ধরে সতীত্বের অগ্নিপরীক্ষা দিতে হচ্ছে নারীকে।
বিয়ের আগে যৌন পুরুষতান্ত্রিক সমাজে পুরুষের সবচেয়ে উপভোগ্য হলো নারীর শরীর, সতী নারীর শরীর। নারীর সতীত্ব পুরষের কাছে সবচেয়ে আকর্ষণীয় বিষয়। বিয়ের পরে মিলনের প্রথম রাতে স্ত্রীর যৌনাঙ্গ থেকে রক্ত বের না হলে অনেক স্বামী ভাবে তার স্ত্রী আগে সতীত্ব হারিয়েছে, কিন্তু নারীর এই সতীত্ব পরীক্ষা করার কোন উপায় নেই। তারপরও পুরুষ চায় নারীর সতীত্ব পরীক্ষা করতে। বিয়ের পরে তখনই পুরুষেরা সবচে’ সুখী হন, যখন জানতে পারেন তার স্ত্রী সতী। সমাজে একটি প্রবাদ আছেঃ ফুলশয্যার রাতের পরে বরের মা এসে বৌমার খাটের চাদর দেখেন, চাদরে রক্তের দাগ দেখতে পেলে তবেই শাশুড়ি মা খুশি হন, নয়তো তার মুখ অন্ধকার হয়ে যায়।
ভারতে নববধূর সতীত্ব খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিবেচিত হয় এবং বিয়ের আগে যৌনক্রিয়াকে গর্হিত কাজ মনে করা হয়। আমরা জানি, এক সময় ভারতবর্ষে সতীদাহ প্রথা প্রচলিত ছিল। পৌরাণিক ও মধ্যযুগীয় আদর্শ মতে, মূলতঃ স্বত:প্রণোদিত হয়েই পতির মৃত্যুতে স্ত্রী অগ্নিতে আত্মাহুতি দিত। পৌরাণিক কাহিনীতে এ আত্মাহুতি অতিমাত্রায় শোকের বহিঃপ্রকাশ হিসেবে দেখানো হয়েছে। কিন্তু বাস্তব চিত্র ছিল ভিন্ন, কোন নারী স্বেচ্ছায় নিজের জীবন উৎসর্গ করত না। কোন স্ত্রীলোকের স্বামী মৃত্যুবরণ করলে জীবিত স্ত্রীকে বাধ্য করা হয় সহমরণে যেতে, মৃত স্বামীর চিতার আগুনে জীবন্ত পুড়ে মরতে বাধ্য করা হত যাতে ঐ নারী স্বামীর মৃত্যুর পরে অন্য কোন পুরুষের সঙ্গে যৌনক্রিয়া করতে না পারে।
১৮২৯ সালে এই অমানবিক সতীদাহ প্রথা বাতিল ঘোষণা করা হয়েছে, কিন্তু ‘সতীত্ব রক্ষা’ শব্দটির যথাযথ ব্যবহার আজো সমাজে টিকে আছে এবং গণহারে নারী বাধ্য হচ্ছে সতীত্বের পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে।
ইরান একমাত্র মুসলিম দেশ, যেখানে রাষ্ট্র ব্যবস্থা শতভাগ ‘মুসলিম শারিয়া আইন’ দ্বারা পরিচালিত হয়। ইরানের সমাজে এখনও অবিবাহিতা মহিলার সতীত্বের গুরুত্ব অনেক। বেশীরভাগ পরিবার চায় তাদের পুত্রবধূকে সতী হতে হবে, অর্থাৎ বিয়ের আগে তার যেন যৌন সম্পর্ক না হয়। আইএলএমও নামে ইরানের সরকারি একটি মেডিকেল সংস্থা সতীত্ব পরীক্ষা করে সনদও দেয়, চাইলে বিয়ের আগে কনেপক্ষ থেকে সতীত্বের সেই সনদ বরপক্ষের হাতে তুলে দিতে হয়। অনেক সময় কনের আপত্তি থাকা স্বত্বেও পরিবার জোর করে সতীত্বের পরীক্ষা করিয়ে থাকে। এক সড়ক দূর্ঘটনায় ইরানী তরুণী মাহনাজ হোসেনের নিতম্বের হাড় ভেঙ্গে গিয়েছিলো। তরুণী যখন হাসপাতালে যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছিল তখন তরুণীর মা ডাক্তারকে অনুরোধ করেছিল দূর্ঘটনার কারণে মেয়েটির সতীত্ব ঠিক আছে কিনা তা পরীক্ষা করে দেখতে, পরীক্ষা করা হয়েছিল, ফলাফল মাহনাজ সতীত্ব হারিয়েছে। সন্দিহান হয়ে অনেক মহিলা অস্ত্রোপচার করে যোনীর পর্দা জোড়া লাগাতেও দ্বিধাবোধ করে না। ইরানে বিবাহ বহির্ভূত যৌন সম্পর্ক ভয়ংকর অপরাধ। শুধু যে সামাজিকভাবে নিষিদ্ধ তা নয়, সে ধরনের সম্পর্ক আদালতে প্রমাণিত হলে শারীয়া আইনে মেয়েটিকে কঠিন সাজা ভোগ করতে হয়।
ইন্দোনেশিয়া মুসলিম প্রধান হলেও হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, আদিবাসী প্যাগান বিভিন্ন ধর্মের মানুষ সেখানে বসবাস করে এবং জাতীয় বিমান সংস্থার নাম হিন্দু ও বৌদ্ধ ধর্মের বিশেষ পবিত্র পাখি দেবতা গড়ুঢ় দেব’র নামে ‘গাঢ়ুদা এয়ারলাইন্স’। (The holy bird Garuda of Hinduism and Buddhism,also after the national emblem of Indonesia, the airline is headquartered at Soekarno-Hatta International Airport in Tangerang, near Jakarta.) জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সকল পুরুষ মানুষকে ‘খাতনা’ দেয়া দেশটির সামাজিক প্রথা, একসময় ঢোল পিটিয়ে নামাজের জন্য মুসলিম সম্প্রদায়কে আহ্বান করা হত। নারীর জন্য মানবাধিকার লঙ্ঘন, অবমাননাকর, বৈষম্যমূলক ও বেদনাদায়ক সতীত্ব পরীক্ষা ‘টু-ফিঙ্গার এক্সামিনেশন’ নামে পরিচিত। ইন্দোনেশিয়ায় সামরিক বাহিনীতে যোগ দেওয়ার সময় ও উচ্চ শিক্ষার গ্রহনের জন্য সতীত্বের পরীক্ষা দিতে গিয়ে নারী শারীরিক ও মানসিকভাবে যন্ত্রণাভোগ করে এবং সভ্রমহানীর গ্লানিতে ভোগে। ইন্দোনেশিয়ার জাতীয় পুলিশের ওয়েবসাইটে বলা হয়েছে। ”পুলিশ ও সামরিক বাহিনীতে যোগ দিতে হলে অন্যান্য পরীক্ষার পাশাপাশি নারীদের অবশ্যই সতীত্বের পরীক্ষা দিতে হবে” — ”Virginity tests are obligatory for female military and national police recruits who are typically high school graduates aged between 18 and 20. HRW’s research indicates that the air force, army and navy have for decades also used the test on the fiancees of military officers before marriage. It also says local governments and the civil service have been known to use the test. In February, officials in Jember, East Java, scrapped a plan to make high school girls be tested before they could graduate from high school.” , অর্থাৎ, ‘অক্ষতযোনি’র বিষয়টি প্রমাণ করতে পুলিশে যোগদান করতে ইচ্ছুক নারীদের অবশ্যই ‘দুই আঙ্গুল’ পরীক্ষা অংশগ্রহণ করতে হবে। কেউ ‘সতীত্ব পরীক্ষা’য় পাশ না করলে তাকে পুলিশের চাকরীতে নেয়া হয় না এবং রিক্রুট হলে নিয়োগ বাতিল করা হয়। ভুক্তভোগী নারীর ভাষ্য, ”সতীত্ব পরীক্ষার কক্ষে প্রবেশের মতো কষ্টদায়ক আর কিছু নেই। এটা অবমাননাকর।” এই ‘সতীত্ব পরীক্ষা’ অন্যায়ের বিরুদ্ধে সমাজের মানুষগুলো নিশ্চুপ রয়ে গেছে। বিশ্বের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম জনসংখ্যার এদেশটিতে নর-নারীর বিবাহপূর্ব মেলামেশা থাকলেও এখনও সেখানে নারীদের জন্য বেদনাদায়ক, বিরক্তকর, ক্ষতসৃষ্টিকারী ও অপমানজনক ‘সতীত্ব’ শব্দটি খুব বেশি গুরুত্ব দেয়া হইয়।
জর্জিয়ায় মেয়েদের বিয়ের প্রধান শর্তই হলো, তাদের কুমারিত্বের পরীক্ষা দিতে হবে। অর্থাৎ ভার্জিনিটি টেস্ট করাতে হবে। রিপোর্টে তাঁদের কুমারিত্ব প্রমাণিত হলে, তবেই বিয়ে হবে; না-হলে জোটে নষ্ট মেয়ের তকমা। এককালের সোভিয়েত ইউনিয়নের সদস্য জর্জিয়া এ মধ্যযুগীয় মানসিকতা থেকে মুক্ত হতে পারেনি। কুমারিত্ব পরীক্ষা শুধুই নারীদের জন্য কেন? কোন পুরুষকে কেন এই একই পরীক্ষা করানো হয়না! যদিও সে দেশের চার্চের ব্যাখ্যা, এই টেস্টের উদ্দেশ্য এইচআইভি, এইডসের মতো রোগের হাত থেকে যুবতীদের বাঁচিয়ে রাখা। এই টেস্টের জন্য চার্চের পক্ষ থেকে মহিলাদের একটি দলও গঠন করা হয়েছে। ভার্জিনিটি টেস্ট করানোর জন্য যুবতীদের ওপর কোনো রকম চাপ সৃষ্টি করা হচ্ছে না বলে চার্চ সাফাই দিয়েছে। যুবতীরা কুমারী প্রমাণিত হলে তাদের সার্টিফিকেট ও একটি সুন্দর পোশাক দিচ্ছে চার্চ। প্রশ্ন থেকে যায়, এইচআইভি(HIV), এইডস(AIDS) কি শুধু নারীর হয়? পুরুষের হয় না? তাহলে পুরুষের এইচআইভি, এইডস ও ভার্জিনিটি টেস্টে’র ব্যাপারে চার্চ নীরব দর্শকের ভূমিকায় অবতীর্ণ কেন?
‘জর্জিয়া ফরেন্সিক ব্যুরো’তে এ টেস্টের জন্য হবু কনেদের কাছ থেকে ৬৯ পাউন্ড নেওয়া হচ্ছে। যদি টেস্ট রিপোর্ট তাড়াতাড়ি দরকার, তবে আরো বেশি কড়ি গুনতে হয়। জর্জিয়ার লোকেদের কাছে এই টেস্টের খরচ, তাদের গড় মাসিক খরচের সমান।’ সূত্র-বিবিসি। তা-ও পরীক্ষায় পিছপা হচ্ছে না কেউই এবং চার্চের তরফে এই টেস্টের জন্য যে মহিলা দল গঠন করা হয়েছে সে দলের সদস্যদের ভার্জিনিটি টেস্টের জন্য কোন টাকা দিতে হয় না।
অন্যদিকে আফ্রিকার দেশ ব্রাজিলে ২৫ বছরের কম বয়সী ও সকল অবিবাহিত নারীকে সরকারি চাকরি গ্রহনের জন্য অবশ্যই সতীত্বের প্রমাণ দিতে হবে। ২০১২ সালে দেশটির কেন্দ্রীয় সরকার এই আইনটি জারি করে। নারীদেরকে তাদের সতীত্ব প্রমাণে বাধ্য করা হচ্ছে, যা নারীর অধিকার হরণ করে। এ এমন একটি বিষয় যা নারীর একান্ত গোপনীয়তা প্রকাশে বাধ্য করা হয়।
এটা কোন সতীত্ব হারানোর মত ঘটনা নয় ! সতীত্ব প্রথার বিরুদ্ধে অন্যরকম প্রতিবাদ এলিজাবেথ রেইন (Elizabeth Raine) নামের এক আমেরিকান মেডিকেল ছাত্রী নিজের সতীত্ব বিক্রির উদ্দেশ্যে নিলামের আয়োজন করেন, তিনি সতীত্ব পরীক্ষা করেন ও প্রমাণের জন্য ডাক্তারি সনদ যোগাড় করে রীতিমত নিলামের ডাক দেন যে রেইন সবচেয়ে বেশি দর প্রস্তাবকারীর সঙ্গে তিনি ১২ ঘণ্টা সময় কাটাবেন। সতীত্ব নিলামে তোলার এই উদ্যোগটিকে বড় এক ব্যবসার মতো করেই দেখছেন রেইন। তিনি এজন্য পেশাদার ব্যবসা সংক্রান্ত পরামর্শকদের মাধ্যমেই নিলামের আয়োজন করছেন। এমন একটি কাজে শারীরিক ও মানসিক ক্ষতি হতে পারে জেনেও রেইন এর মনে হয়েছে কোন সমস্যা হবে না তবে তিনি কিছুটা ভয় পেয়েছিলেন। রেইন এর মতে এ কাজটিকে পতিতাবৃত্তির সাথে তুলনা করা চলবে না। কারণ পতিতাবৃত্তি খুবই কলঙ্কিত ও সমালোচিত পেশা। তার এটি করার কারণ টাকা সাথে অবশ্য বোনাস আরো কিছু আছে। যেমন- রোমাঞ্চ, যৌনতা ও নিজের কিছু একান্ত ইচ্ছা। নিলামে পাওয়া অর্থের ৩৫ শতাংশ উন্নয়শীল দেশের নারীদের উন্নয়নে দান করার কথা রেইন এর। উল্লেখ্য, ২০০৯ সালে চার মিলিয়ন ডলারে সতীত্ব বিক্রি করেছিলেন নাটালি ডিল্যান(২২) নামের এক আমেরিকান তরুণী।
একজন কুমারী নারীর সতীচ্ছদ পর্দা বিভিন্ন কারণে ছিঁড়ে যেতে পারে। পুরুষতান্ত্রিক সমাজ নারীদের সতীত্ব পরীক্ষা করে। যদিও মেডিকেল সায়েন্সে সতীত্ব বলে কোনো শব্দ নেই। এটা পুরুষদের নিজের ব্যাকরণে তৈরি। একহাজার কন্যা শিশুর মধ্যে কমপক্ষে একজন ভুমিষ্ট হয় সতিচ্ছেদ(Hymen) ছাড়াই। একশ জনের মধ্যে চল্লিশ জন নারীর প্রথমবার মিলনে রক্তপাত হয় না। মেয়েদের সতীচ্ছদ যে শুধু হম্তমৈথুন ও সহবাসের (sex) ফলে নষ্ট হয় তা নয়, ভারী কোন কাজ করলে সাঁতার কাটলে, খেলাধূলা করলে, সাইকেল চালালে, যোগব্যায়াম করলে বা অন্য কোন কারণে সতীচ্ছদ নষ্ট হতে পারে। সতীচ্ছেদে একটি ছোট ছিদ্র থাকে, যেটি ( periods )মাসিকের সময় (period pain) ও রক্তধারা প্রবাহিত হওয়ার জন্য স্বাভাবিক থেকে একটু বড় হয়। যদি টেমপন (tampon) ব্যবহার করা হয়ে থাকে তবে সতীচ্ছেদ ছিঁড়ে যেতে পারে। রক্ত ক্ষরণ ছাড়াই সতীচ্ছেদ ছিঁড়ে যেতে পারে।
এবারে প্রশ্ন হলো নারীর সতিচ্ছদ কি আসলেই তার সতীত্ব বহন করে?
নারী ও পুরুষ একে অপরের পরিপূরক। যদি কেউ কারো সঙ্গে জীবন অতিবাহিত করতে চায় তাহলে একে অপরের উপর আস্থা রাখবে, পরস্পরকে ভালবাসবে ও শ্রদ্ধা করবে।
মানুষ এ-সমাজ ও পৃথিবী থেকে নারীর প্রতি অমানবিক বৈষম্যমূলক সতীচ্ছদ(Hymen) শব্দটির নামে এ হয়রানি বন্ধ করবে কী?
মানুষ বলবে কি, ধিক এই সতী প্রথা! ধিক এই হাইমেন!
লেখক: নারীবাদী ও কলামিস্ট