নো ব্রা দিবস, র্যাডিক্যাল নারীবাদ এবং অন্যান্য
প্রকাশ | ১৩ অক্টোবর ২০১৬, ২৩:৫০
‘নো ব্রা ডে’ মানে ব্রা খুলে অশ্লীলতা প্রদর্শন করা? কিংবা ‘নো ব্রা ডে’ কি ব্রা না পরে পালন করতে হবে? এটা একটা FAQ (Frequently asked question)উত্তর হচ্ছে— না। ‘নো ব্রা ডে’-তে ব্রা খুলে মিছিল করার মতো ব্যাপার নাই। প্লিজ, ভুল বুঝবেন না।
অক্টোবর মাস ব্রেস্ট ক্যান্সার সচেতনতার মাস। ১৩ই অক্টোবর “No bra day”। এই একটা দিন অন্তত ব্রা খুলে নিজের স্তন দুটোকে পরীক্ষা করুন। এই ক্যান্সারে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা দিনকে দিন বাড়ছেই। সাধারণত ৫০-৭০ বছর বয়সী মহিলারা ব্রেস্ট ক্যান্সার হবার অধিক ঝুঁকিতে থাকে। এই রোগ কেন হয়? এর লক্ষণ, প্রতিরোধ ও প্রতিকারের উপায় এখনই জেনে নিন গুগল ঘেঁটে।
ষাটের দশকে র্যাডিক্যাল নারীবাদীরা বলেছিল “আমরা ব্রা পড়বো কেন? কার জন্য?” একই রকমভাবে অনেকেই লিপস্টিক দেয়ার বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছিল; তারা বলেছিল-“কার জন্য আমরা মুখে লাল-নীল রঙ মেখে সং সাজবো?”, তারা আরও অনেক কথা বলেছিল, “আমরা হাই-হিল পড়বো না; কেন পড়বো? হাইহিল পড়লে আমার বক্ষ এবং নিতম্ব উন্নত দেখাবে? কার কাছে উন্নত দেখাবে? পুরুষের কাছে? পুরুষের মনোরঞ্জনের জন্য আমাদের আর কি কি করতে হবে?” এখনকার অনেক র্যাডিক্যাল নারীবাদীরা ব্রেস্ট ইমপ্ল্যান্টের ঘোরতর বিরোধী।
অনেকের কাছে আচমকা লাগতে পারে। কিন্তু তাদের কথার যুক্তি আছে কি না? আপনি কি মনে করেন? আমি নিজেও হাইহিল জুতার বিপক্ষে; কারণ এতে অনেক হেলথ রিস্ক আছে। শরীরে নানা রকম সমস্যা হয়। পশ্চিমা দেশের মেয়েরা যারা রিসেপশনে কাজ করে,তারা আরামদায়ক জুতা পরে। কারণ হাইহিল পরে বেশিক্ষণ থাকা সম্ভব না। ব্রেস্ট ইমপ্ল্যান্ট নিয়ে ইতিমধ্যে ব্যাপক সমস্যা শুরু হয়ে গেছে; ফ্রান্সের একটি কোম্পানি ব্রেস্ট ইমপ্ল্যান্টের সামগ্রী বানাতো, তারা এখন জরিমানা গুনতে গুনতে দেউলিয়া।
লাইগেশন আরেকটি সমস্যা। এটা স্থায়ী জন্মনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা। এই ব্যবস্থায় একজন নারী সারাজীবনের জন্য মাতৃত্ব হারায়। আজকাল যেভাবে বিবাহ-বিচ্ছেদ হচ্ছে, তাতে একজন নারী যদি দুটি সন্তান নেয়ার পর লাইগেশন করায় তারপর যদি তার বিবাহ বিচ্ছেদ হয়ে যায় তাহলে তার উপায়? উল্লেখ্য, বাংলাদেশে লাইগেশন ব্যবস্থা যত বেশী হয়েছে, সেই হারে পুরুষের জন্য স্থায়ী জন্মনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা "ভ্যাসেক্টমি" কিন্তু হয়নি। কেন হলো না? বিষয়টি কি পুরুষতান্ত্রিক ব্যবস্থার ফলাফল না?
আইভিএফ হচ্ছে আরেকটি ইস্যু। যদি কোনো নারী কিংবা পুরুষ এর ফারটিলিটি সমস্যা হয়; কিংবা বাচ্চা নিতে সমস্যা হয় তাহলে এই ব্যবস্থার দ্বারস্থ হতে হয়। ফার্টিলিটি সমস্যা অনেক রকম হতে পারে; তারমধ্যে (১) স্বামীর সমস্যা (২) স্ত্রী'র সমস্যা। পুরুষের ক্ষেত্রে স্পার্ম কোয়ালিটি (স্পার্ম কাউন্ট, ঘনত্ব ইত্যাদি); আর মেয়েদের ক্ষেত্রে অন্যতম জটিল সমস্যা হচ্ছে "আরলি ম্যানুপজ" কিংবা স্থায়ীভাবে পিরিয়ড বন্ধ হয়ে যাওয়া। এছাড়াও বিভিন্ন রকম সমস্যা আছে। যেমন ওভারিয়ান ফেইলর (গর্ভপাত, টিউবে কন্সিভ করা ইত্যাদি)। আমি এখানে সবচেয়ে বড় সমস্যা "আরলি ম্যানুপজ" নিয়ে আলাপ করবো। এই সমস্যায় একজন নারীর দেহ ডিম উৎপাদন বন্ধ হয়ে যায়। তখন মা হতে হলে অন্য কারো কাছ "ডিম" গ্রহণ করতে হয়। ডিম গ্রহণ করার পদ্ধতিটি ল্যাবরেটরি নির্ভর। এই ব্যবস্থায় ল্যাবরেটরিতে "ডিম্বাণু"র মধ্যে স্পার্ম প্রবেশ করিয়ে দেয়া হয়। এতে করে এম্ব্রো (ভ্রূণ) জন্ম লাভ করে। সেই ভ্রূণ পরবর্তীতে মানব দেহে প্রবেশ করানো হয়। এই ব্যবস্থাকে বলে "ইনভেট্রো ফার্টিলিটি" কিংবা আইভিএফ।
আমি কেন এই আইভিএফ প্রসঙ্গ টেনে আনলাম? কারণ এখনকার যুগে অনেক পরিবার সন্তানহীনতা সমস্যায় ভুগছেন। এই সমস্যায় অতীতে নারীদের তালাকপ্রাপ্তা হতে হতো; অথবা সতীনের ঘর করতে হতো। এমন কি কেউ জানতেও পারতো না, সমস্যাটি কার? স্ত্রী'র না স্বামীর? সব দোষ নারীর কাঁধে চাপিয়ে দেয়া হতো। অনেক সময় পীরের পানিপড়া খেলে সন্তান হবার কথা জানা যেত। কিন্তু আজকাল ডিএনএ টেস্ট আসার পর পীরেরা এখন আর আগের মতো পাইকারি দরে "বাবা" হতে পারছেন না।
আমি বেশ কিছু বাঙালি পরিবারের কথা জানি, তাদের ক্ষেত্রে সমস্যা "স্বামী'র"। এক্ষেত্রে তাদের কারো না কারো কাছ থেকে স্পার্ম ডোনেশন নিতে হবে। কিন্তু স্বামী মহাশয় রাজী হচ্ছেন না। পক্ষান্তরে অনেক বাঙালি পুরুষ কিন্তু তাদের স্ত্রী'র সমস্যা হলে আরেকজন নারীর কাছ থেকে "ডিম" নিতে সমস্যা বোধ করেন না। কেন? সমস্যাটি কি পুরুষতান্ত্রিক?
আমরা ছিলাম, "নো ব্রা দিবস" এর আলোচনায়। কেউ কেউ রসিকতা করে বলতেই পারেন, 'এখন যদি পুরুষরা "নো জাঙ্গিয়া দিবস" পালন করে তাহলে কেমন হবে?' কিছুই হবে না। আন্দোলন তারাই করে, রাজপথে তারাই নামে যারা ভিক্টিম হয়; যারা শোষিত হয়।
কিছুদিন আগে সুইডেনে জন্মহার বাড়ানোর জন্য গর্ভপাত নিষিদ্ধ করে আইন করার প্রস্তাব উঠেছে। সুইডেনের নারীরা সেই আইনের বিরুদ্ধে রাজপথে নেমেছে। এখনও সেখানে আন্দোলন চলছে এবং চলবে। কারণ সুইডেনের নারীরা প্রকৃত নারীবাদের প্রবক্তা। তারাই প্রথম নারীর প্রতি বৈষম্যের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছিল এবং দাবি আদায় করে ছেড়েছিল। সুইডিস নারীরা এক সময় মাতৃত্বকালীন বেতন-ভাতা’র দাবিতে আন্দোলন করেছিল। তারা ধর্মঘট করেছিল আর দাবি তুলেছিল যে গর্ভকালীন সময়ে যদি তাদেরকে বেতন-ভাতা না দেয়া হয়, তাহলে তারা আর “মা” হবে না। তারা বজ্রকন্ঠে বলেছিল, ‘আমরা সন্তান জন্মদান করি শুধুমাত্র আমাদের প্রয়োজনে না, আমরা রাষ্ট্রের প্রয়োজনেও সন্তান জন্মদান করি। সুতরাং মাতৃত্বকালীন সময়ে আমাদের দায়িত্ব রাষ্ট্রের নিতে হবে।“ রাষ্ট্র তাদের দাবি মেনে নিয়েছিল।
বাংলাদেশের নারীরা হাজারো সমস্যায় জর্জরিত। বাংলাদেশের নারীদের মুক্তির উপায় কি? অনেকেই এক কথায় বলবেন, “শিক্ষা”। আমিও আপনাদের সাথে একমত। শিক্ষায় মুক্তি এনে দিবে। তবে সেই শিক্ষা হতে হবে জ্ঞানচক্ষুউন্মোচনমুখী। কুসংস্কারাচ্ছন্ন শিক্ষা উল্টোদিকে নিয়ে যেতে পারে। সেদিকে নজর দিতে হবে।
ইদানিংকালে বাংলাদেশে নারী শিক্ষার অগ্রগতি বেশ লক্ষণীয়, এসএসসি, এইএসসি তে মেয়েদের ফলাফল রীতিমত ঈর্ষনীয়। কিন্তু একটু ভেবে দেখেছেন? কলেজ কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এখনো ছেলেদের আবাসিক হলের তুলনায় মেয়েদের হলের সংখ্যা কত কম? কারণ কি? স্কুল পর্যায়ে আমাদের দেশে নারী শিক্ষা ব্যাপকভাবে উন্নতি করেছে কিন্তু তারপরেই শুরু হয় ঝরে পড়ার মিছিল। কেন হচ্ছে? অনেকেই এখনো বলেন, ‘মেয়েদের পড়ানো অপেক্ষাকৃত ব্যয়বহুল। মেয়েদের অনেক কিছু লাগে।‘ অন্যদিকে মেয়ে সন্তানদেরকে এখনও আমাদের সমাজ অর্থকরী মনে করে না। মেয়েদের পিছনে শিক্ষার বিনিয়োগকে অলাভজনক মনে করে। এই ভ্রান্ত বিশ্বাসের পরিবর্তন ছাড়া নারীদের প্রকৃত উন্নয়ন সম্ভব নয়।
লেখক: কথাসাহিত্যিক, একাডেমিক।
[প্রথম প্রকাশ: সিলেটটুডে২৪.কম]