বাঙালির ক্রিকেটপ্রেম- দেশপ্রেম-নারীপ্রেম
প্রকাশ | ১৩ অক্টোবর ২০১৬, ২৩:৩১
ক্রিকেটে বাংলাদেশ বেশ ভালো করছে। দেশের ক্রিকেটের উন্নতিতে আমরা সবাই খুশি। রাস্তায় বিশাল বিলবোর্ড জুড়ে ক্রিকেটারদের ছবি। বাংলাদেশ জিতলে আনন্দ মিছিল, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে, স্ট্যাটাসে-টুইটে.. আনন্দ প্রকাশ করি। কিন্তু মাঝেমাঝে আনন্দ প্রকাশ করতে গিয়ে আমরা বাড়াবাড়ি করে ফেলি না তো? ম্যাচ জিতেছি এটা নিয়ে স্ট্যাটাস দিতে গিয়ে ‘ভইরা দিছি, বাঁশ দিছি, চুইদা দিছি’ এই জাতীয় শব্দ ব্যবহার করে নিজেদেরকেই ছোট করছি না তো? নিজের দলের প্রশংসা করতে অন্য দলকে অপমান করতে হবে কেন? ভদ্র ভাষায় কি আনন্দ প্রকাশ করা যায় না?
এখন হয়তো অনেকে বলবেন, ‘অন্যদেশ আমাদের নিয়ে বাজে মন্তব্য করে, আমাদেরকে ছোট ভেবে হেয় করে, বিড়াল বলে অপমান করে, সেটা নিয়ে তো কিছু বলছেন না’।
– আমরা যখন ছোটদল ছিলাম, তখন আমাদেরকে তারা ছোট হিসেবে নিয়েছে, এখন আর আমরা ছোট দল নই, আগে হয়তো বিড়াল বলেছে, কিন্তু এখন আমরা মাঠে প্রমাণ করে দিয়েছি যে, আমরা বিড়াল নই। আমাদেরকে ছোট ভাবার ফল তো তারা হাড়েহাড়ে পেয়েছে। আমরা নিজেদেরকে প্রমান করব মাঠে। মাঠের বাইরে নোংরামি করে নিজেরা ছোট হবো কেন?
আবার ওয়েস্ট ইন্ডিজ এর সাথে যখন বাংলাদেশ হেরে গেলো, ৫৮ রানে অল আউট হল, সেবার আমরা কিনা ওয়েস্ট ইন্ডিজ দলের গাড়িতে ইট পাটকেল ছুঁড়া শুরু করলাম? আমন্ত্রিত দলকে এভাবে অপমান করে, জাতি হিসেবে নিজেরাই অপমানিত হলাম।
আগে জানতাম, একদেশ আরেকদেশকে খেলতে আমন্ত্রন জানায়। খেলার মাধ্যমে এক দেশের সাথে আরেক দেশের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের সৃষ্টি হয়। এখন চারপাশের অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে, খেলার উদ্দেশ্য বুঝি, জাতিগত বিদ্বেষ ছড়িয়ে, দেশে দেশে যুদ্ধ লাগানো!
নিজেদের আনন্দ প্রকাশের সীমা নিয়ে লিখতে গেলে, মুর্খের দলেরা আসে দেশপ্রেম শেখাতে। এসব দেশপ্রেমীদের দেশপ্রেম কি কেবল ক্রিকেটের বেলায়? দেশের কোন কাজে তো এদের দেশপ্রেম দেখা যায় না।
ঠিক যেমন দেশে হত্যা-ধর্ষণ-চুরি-ডাকাতি-ঘুষ-দুর্নীতি এসব কোন কাজেই ধর্ম যায় না, এসব নিয়ে ধার্মিকদের কথা বলতে দেখা যায় না, অনুভূতি ও আহত হয় না। কেবল নাস্তিকদের কলমের আঘাতেই নাকি অনুভূতি-টনুভূতি সব একাকার হয়ে যায়!
এসব পার্ট টাইম দেশপ্রেমিক আর ধার্মিক নিয়েই তো বাংলাদেশ চারবার দুর্নীতিতে চ্যাম্পিয়ন হল, এখন চ্যাম্পিয়ন না হলেও খুব বেশি যে পিছিয়ে আছে তা নয়, দুর্নীতি হত্যা ধর্ষন সবই ঠিক মতই চলছে, এসব খুনী-ধর্ষক-চোর-ডাকাতরাই আবার নাস্তিক মুক্ত বাংলাদেশ চায়!!
আমার এর আগে ক্রিকেট নিয়ে একটি স্ট্যাটাসে, পুরুষ ক্রিকেট দল বলেছিলাম বলে অনেকেই আমার উপর ক্ষেপেছেন। আমি নাকি খেলার মধ্যে লিঙ্গ নিয়ে আসছি। তো বাংলাদেশে যে শুধু ছেলেরাই ক্রিকেট খেলে না, মেয়েদেরও একটা ক্রিকেট দল আছে সে খবর আমরা ক’জনে রাখি? মেয়েদের খেলার কথা বলতে গেলে তো অবশ্যই ‘নারী ক্রিকেট দল’ উল্লেখ করতে ভুলি না, তবে পুরুষ দলের বেলায় আপত্তি কেন? না, ক্রিকেটে লিঙ্গ আমি আনছি না, সমস্যা তো গোড়াতেই, আমি শুধু আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছি।
নব্বই এর দশকে তসলিমা নাসরিন তার একটি লেখায় নারী-পুরুষ একসাথে ক্রিকেট টীম করার কথা বলেছিলেন। নারী-পুরুষ-ভিন্ন লিঙ্গ সবাই একসাথে খেলতে পারলে তো ভালোই হত। সেটা যদি সম্ভব না হয় অন্তত দেশের পুরুষ ক্রিকেটারদের সমান সুযোগ সুবিধার কিছু অংশ ও যদি নারী ক্রিকেটাররা পেতো তাহলেও কিছুটা স্বস্তি পেতাম। কিন্তু হায়! আমাদের জাতীয় দলের নারী ক্রিকেটারেরা পুরুষ ক্রিকেটার ন্যায় অন্য দেশের সাথে খেলে দেশের জন্য সম্মান নিয়ে আসলেও, নারী পুরুষ লিঙ্গ বিভেদে মহিলা ক্রিকেটাররা সম্মান পায় কতটুকু- ভেবেছেন কি কখনো?
জাতীয় দলের মেয়েদের ক্রিকেট টিভিতে দেখানো হয় না। অথচ পুরুষদের ঘরোয়া লীগের খেলা আমাদের বাংলাদেশ টিভি সহ আরও কিছু বেসরকারি টিভি সরাসরি সম্প্রচার করে। পুরুষ দলের ক্রিকেটাররা এত সুবিধা পেয়ে ও স্পট ফিক্সিং করে, তারা খেলার আইন অমান্য করে। নারী দলের বিরুদ্ধে এসব অভিযোগ না থাকলেও তাদের আন্তর্জাতিক খেলা গুলোও টিভি চ্যানেলে স্থান পায় না। কে জিতল কে হারল এইসব, টিভি তো দুরের কথা পত্রিকার পাতার ও অনেক নিচে স্থান পায়।
ফেইসবুকে বাংলাদেশ পুরুষ ক্রিকেটারদের কত ফ্যান পেইজ, হাজার হাজার লাইক। অন্যদিকে নারী ক্রিকেটারদের মধ্যে সালমা খাতুনের নামে একটি মাত্র পেইজ আছে যেটাতে লাইকের সংখ্যা এক হাজারের বেশি না। নারীদের ক্রিকেট নিয়ে কিছু লিখলে সেখানে যেসব কমেন্ট আসে, সেসব দেখেই বুঝা যায়, নারীদের যৌনবস্তু ছাড়া আর বিশেষ কিছু ভাবে না।
নারীর প্রতি দৃষ্টি ভঙ্গির কথা আর নতুন করে কি বলব! বিশ্বসেরা অলরাউন্ডার সাকিব আল হাসানের স্ত্রী- ইঞ্জিনিয়ার শিশির, খেলা দেখতে গিয়ে ইভটিজিং এর শিকার হলেন, নাসির হোসেন তার ছোট বোনের সাথে তোলা একটি ছবি তার পেইজে পোস্ট করে তার বোনকে নিয়ে হাজার হাজার নোংরা কমেন্ট উপহার পেয়েছেন। সাকিবের স্ত্রী হোক, নাসিরের বোন হোক, ক্রিকেটার সালমা খাতুন হোক কিংবা অন্য কেউ..সবই তো এক, সমাজের অধিকাংশ পুরুষের কাছে এরা কেবলই যৌন বস্তু।
মাঝে মাঝে শুনি, এই ছেলে ওই মেয়ের জন্য পাগল হয়ে গেছে, এত প্রেম, ছেলেরা মেয়েদের এত ভালোবাসে, কবিরা নারী নিয়ে পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা কবিতা লিখে ভালোবাসা জানায়। চারপাশের পুরুষগুলোর নারীর প্রতি এমন দৃষ্টি ভঙ্গি নিয়ে যখন নারী প্রেম দেখি, তখন তসলিমা নাসরিনের লেখা একটি কথাই মনে পড়ে, ‘নারী তুমি সতর্ক হও। তোমার দিকে ধেয়ে আসা পুরুষেরা মূলত আসে অবাধ কাম ও অনিয়ন্ত্রিত ক্রোধের কারনে, কর্তৃত্বের ক্রোধ । এ জগত তোমার নারী, এই জগতে তুমি যেমন ইচ্ছা বাঁচো। এই জগত যদি একটি নদী হয়, তুমি নদী জুড়ে সাঁতার কাটো। এই জগত যদি একটি আকাশ হয় তুমি আকাশ জুড়ে ওড়ো। জীবন যদি তোমার হয়, যা আসলেই তোমার, তবে সেই জীবন তুমি যেমন ইচ্ছে যাপন করো। তোমার কর্তৃত্ব তুমি নাও নারী।’
লেখক: আহবায়ক, তসলিমা পক্ষ