নারীর লড়াই বিজয়প্রাপ্ত হবেই

প্রকাশ | ০৮ অক্টোবর ২০১৬, ১৫:৪৮

(১) 
খাদিজা নামে মেয়েটা এখনো হাসপাতালে। ডাক্তাররা এখনো নিশ্চিত বলতে পারছেন না খাদিজা বিপদ কাটিয়ে উঠতে পেরেছে কিনা। আফসানার খুনি ঘুরে বেড়াচ্ছে মুক্ত বাতাসে। কুমিল্লায় তদন্ত আটকে আছে কী জানি কার ভয়ে। নারীর প্রতি অন্যায়ের লিস্ট করতে ইচ্ছা করছে না। তাতে কেবল লজ্জা বাড়ে ভয় বাড়ে গ্লানি বাড়ে আর এক ধরনের ভীতি এসে ভর করে। তবে কি মৃত্যুর আগে পর্যন্ত এইসবই দেখে যাবো? না হতাশ হইনা। জানি নারীরা লড়ছে। সকল ন্যায়সঙ্গত লড়াই শেষ পর্যন্ত বিজয়ী হয়। নারীর লড়াইও বিজয়প্রাপ্ত হবেই। শুধু এইটুকু ভেবে আফসোস হয় যে আমার জীবিতকালে আমি হয়তো দেখে যাবো না নারীকেও সমাজে মানুষ বিবেচনা করা হচ্ছে।

চারপাশে এইসব দেখে ঘৃণা ক্রোধ বিবমিষা মিলিয়ে একটা মিশ্র বাজে অনুভূতি হয়। জিহ্বা বিস্বাদ হয়ে যায়। এই যে আজ সকালে ডোনাল্ড ট্রাম্পের একটা ভিডিও টেপ বের হয়েছে- এই তো নারীর প্রতি সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি। নারী কেবল ভোগের পণ্য। শিকার করার মতো প্রাণী।

ডোনাল্ড ট্রাম্পের ভিডিওটা দেখেছেন? এগুলি কি ডোনাল্ড ট্রাম্পেরই কথা? আমাদের চারপাশের লক্ষ কোটি পুরুষও কি একই ভাষায় কথা বলে না? আমি তো এইরকম কথা অজস্র বার শুনেছি। আমার বন্ধুদের মুখেই, আমার প্রিয় বাংলা ভাষায়ই, একই কথা- ‘কোনভাবে ভোদায় হাত দিতে পারলেই হয় দোস্ত, এরপর আর না করতে পারে না’। ডোনাল্ড ট্রাম্প তো এই কথাই বলেছে। আমার বন্ধুরা কি নারীর স্তন নারীর অঙ্গ প্রত্যঙ্গ নিয়ে একই ভাষায় কথা কথা বলে না? নারীকে প্রতারণা করার কত কায়দা- সেগুলিকে কি আমরা আমাদের এই ঢাকা সমাজেই স্মার্টনেস হিসাবে বিবেচনা করি না?

(২) 
বয়স বেড়েছে বলে কিনা জানিনা। এখন চট করে আবেগে আক্রান্ত হয়ে পরি। চোখে পানি চলে আসে। টেলিভিশন দেখতে গেলে, কথা বলতে গেলে নানান প্রসঙ্গে কান্না চলে আসে। আমার মেয়েরা, ওরা কেমন করে জানি না টের পেয়ে গেছে যে ওদের পিতা একটু ছিঁচকাঁদুনে ধরনের মানুষ। টেলিভিশনে একটা সাহসী মেয়ের কথা দেখাচ্ছে হয়তো, আমার বড় মেয়ে চোখ ত্যাড়া করে আমার দিকে তাকায়, ‘পাপা আর ইউ ক্রাইইং?’ আমি আড়াল করি। ‘নো নো, আ’ম নট ক্রাইইং। চশমাটা পুরানা হয়ে গেছে, চোখে অসুবিধা করছে।’

এই খাদিজা মেয়েটাকে যেদিন সিলেট থেকে ওরা নিয়ে আসছিল সেই সময়েই মাহমুদা খাঁ ঘটনা জানিয়ে ফেসবুকে একটা পোস্ট দিয়েছে। কি মনে করে সেই পোস্টে আমাকে ট্যাগও করেছিল ওরা। ঘটনার প্রতিবাদ করে সাথে সাথেই কি একটা পোস্ট লেখা দরকার ছিল না? ছিল তো। আমি লিখতে পারিনা। কি লিখবো? কাজটা অন্যায় হয়েছে? এই কথা কি আমাকে ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে লিখে বলতে হবে? বদরুলের শাস্তি চাই লিখবো? বদরুলের শাস্তিও কি দাবী করেই আদায় করতে হবে? আমি এইসব কিছু লিখতে পারিনা। আমার চোখ ভরা পানি।

এই মেয়েটা যে আজকে মৃত্যুর সাথে লড়ছে, সে কেবল তার নারী জন্মের দায় শোধ করছে। ওরে ফুরি, তুই তো মেয়ে হয়ে জন্মেছিস, তোর কি সেই অধিকার আছে যে তুই না বলবি? তোর এই বাঙালী মুসলমান সমাজ তোকে পুর্নাঙ্গ মানুষ বিবেচনা করে? করে না তো। যদি বাঁচতে চাস তোকে এইরকম কোপ খেয়েই বাঁচতে হবে। পুরুষ তোকে কোপাবে, চাপাতি দিয়ে কোপাবে, কথা দিয়ে কোপাবে, আহত করবে, ক্ষতবিক্ষত করবে। বাসে ট্রেনে জনসমাবেশে সুশিক্ষিত ‘আধুনিক পুরুষ’ তোর শরীরের এখানে সেখানে চেপে ধরবে। এইসব নিয়েই তোর নারী জীবন, এই জীবন মেনে নিয়েই বাঁচবি?

(৩) 
না। মেয়ে তোকে মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়াতে হবে। দাঁড়াচ্ছেও আমাদের মেয়েরা। এইটাই আশার কথা। আমাদের মেয়েরা মাটিতে পা ঠুকে জানান দিচ্ছে, না, আমিও মানুষ। এই জীবন আমার এই শরীর আমার এই সমাজ এই সবই আমার। আমার ইচ্ছা। আমার জীবন চলবে আমার ইচ্ছায়, তোমার বেঁধে দেওয়া নিয়মে নয়। নারীর প্রতি যে অন্যায় হয় তাঁর বিরুদ্ধে ওরা কথা বলছে।

উইম্যান চ্যাপ্টার নামে একটা পোর্টাল করেছেন সুপ্রিতি ধর আর ওঁর বন্ধুরা। মাথা নত হয়ে আসে। সেখানে মেয়েরা লিখছেন মেয়েদের কথা। আশার কথা প্রতিবাদের কথা অন্যায়ের কথা অধিকারের কথা। আমি ওদের সেইসব লেখা পড়ি, আশান্বিত হই, উদ্বেলিত হই। মেয়েরাই লিখছেন ওদের কথা। এবং অসংখ্য মেয়েরা সেটা পড়ছে। অনলাইনেই পড়ছে, শুনতে পেলাম কথাও কোথাও মেয়েরা উইম্যান চ্যাপ্টার থেকে লেখা প্রিন্ট করে নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগি করে পড়ছে। শুনে ভাল লাগে, মেয়েরা লড়াইয়ে অংশ নিচ্ছে- কেননা উইম্যান চ্যাপ্টার তো লড়াইয়েরই আরেকটা ফ্রন্ট।

শুধু উইম্যান চ্যাপ্টার না। সমাজের অন্যত্রও মেয়েরা লড়াই করছে। আর মেয়েদের লড়াইটা অপেক্ষাকৃত বেশী কঠিন। নারীকে লড়তে হয় দুই ধরনের বৈষম্যের বিরুদ্ধে। একটা তো হচ্ছে সমাজের সধারণ বৈষম্য অসঙ্গতি আর অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াই- যেটা সব মানুষের লড়াই। এর সাথে আছে নারীরই প্রতি বৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়াই- যেটা একান্তই নারীর লড়াই। আর আদিবাসী পাহাড়ি বা হিন্দু নারীর লড়াই তো আরও কঠিন। আশার কথা হচ্ছে সব ক্ষেত্রেই নারীরা লড়ছে। বিভিন্ন ক্যাম্পে বিভক্ত হয়ে লড়ছেন বটে, কিন্তু একটা জায়গায় ঠিকই সকলের ঐক্যও আছে।

(৪) 
নারীর এই লড়াইটা বিশ্বব্যাপী। সে তো আর বলে বুঝানোর কিছু নাই। একজন বাসযাত্রী নারীর অবস্থা এখানে আমাদের এই ঢাকা শহরে যেরকম ওয়াশিংটন ডিসিতেও একইরকম। একটি কলেজ পড়ুয়া নারীর অবস্থা এখানে এই ঢাকাতে যেরকম বা সিলেটে বা কুমিল্লায় যেরকম, নিউইয়র্ক লন্ডন নয়াদিল্লী বা লন্ডনেও একইরকম।

এবং আমি আপনাদের বলি- ঐ আমেরিকার ডোনাল্ড ট্রাম্প আর আমাদের সিলেটের বদরুল এদের মধ্যেও কোন মৌলিক পার্থক্য নাই। এদের চেহারা ভাষা রাজনৈতিক বা সামাজিক অবস্থান সেরকমই হোক, একজন হয়তো ছাত্রলীগের নীচের দিকের নেতা আরেকজন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী- একটা জায়গায় এরা দুইজনই এক ও অভিন্ন এবং পরস্পরের ভাইঃ এরা দুইজনেই মেল শভিনিস্ট পিগ, পুরুষবাদী শুকরের দল।

মেয়েরা, এদেরকে লাথি মারতে শিখুন। নিজের জীবন নিজের পছন্দে যাপন করুন।

ইমতিয়াজ মাহমুদ এর ফেসবুক থেকে