ধর্ষণ মজ্জ্বাগত পুরুষদের মোকাবিলা করেই এগিয়ে যাবে মেয়েরা
প্রকাশ | ০৮ সেপ্টেম্বর ২০১৬, ২১:৩০
দেখলাম সবাই বিরাট বিরক্ত। কেউ কেউ ‘ক্ষমা করো বোনেরা, মেয়েরা’ বলছেন। আমরা ক্ষমা চেয়ে ফেলতে ওস্তাদ। যেকোনো পরিস্থিতিতে ক্ষমা চেয়ে ফেলি। আমাকে এই বিষয়টা অবাক করেনি বরং দৈনিক পত্রিকা ‘প্রথম আলো’ যখন প্রথম তাদের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে এই অসামান্য সাধারণ মেয়েদের কথা তুলে আনলো, তখনই অবাক হয়েছিলাম। পত্রিকাটির জন্য মনে মনে ‘লাভ’ রিঅ্যাক্ট করেছিলাম। আর মনে মনে আশঙ্কায় দিন গুনছিলাম- কবে এদের হ্যারাস করার খবর পাবো। কলসিন্দুর কোন এক অজ-পাড়াগাঁ। আমাদের বালিয়াকান্দির মতো। ইসস এখনও কি মনে পড়ে, গার্লস হাইস্কুলে হ্যান্ডবল খেলা! কল্পনা ব্যানার্জী আমাদের গেম টিচার। একটা মেয়ে ছিল তৃষ্ণা সরকার। বিদ্যুতের গতি। কিন্তু ওই পর্যন্তই। স্কুলের মাঠে বৃহস্পতিবার হাফ ডে হয়ে গেলে কাদা-পানি মেখে, শরীর সামলে বল নিয়ে দৌড়াদৌড়ি। আর তা করতে গিয়ে বুঝতাম, মঞ্চে উঠে গলা কাঁপিয়ে কবিতা আবৃত্তি করা নয় এটা, এর জন্য আলাদা এলেম লাগে। ও পথ মাড়াইনি আর। তৃষ্ণা সরকারও কোথায় কেমন আছে জানি না। এদেশে কত বিদ্যুৎ গতি হারিয়ে যায় পরিচর্যার অভাবে আমাদের গায়েও লাগে না। তবু তো কলসিন্দুরের মেয়েরা আগায়। বালিয়াকান্দির মেয়েরাও। কদিন আগে যখন খুব ব্লগার হত্যা হচ্ছে তখন আমার গ্রামের এক ভাই বালিয়াকান্দির সঙ্গে আরেক গ্রামের মেয়েদের ফুটবল খেলার ছবি ফেসবুকে দিলে গর্বে আমার বুক ভরে যায়। বলি- কোপাকোপি চলবে, দাবায়েও রাখতে পারবে না কেউ। আমরা খোঁজ রাখি না কিন্তু গ্রামের এই মেয়েগুলা তাদের মতো করে নিভৃতেই তো এগিয়ে গেছে। দেশ আর সমাজ তাদের কী উপকারটা করেছে, কী পরিবেশ দিয়েছে তা তো সহজেই অনুমেয়। কিন্তু এতবছর পর আবারও তো চোখের সামনে কোনো এক কলসিন্দুর।
আমরা যখন নারীবাদের কথা বলেছি, ভাঙার কথা মাত্রই চিন্তা করেছি, এগিয়ে যাওয়ার জন্য দৌড় শুরু করেছি অখ্যাত কলসিন্দুরের মেয়েরা ভোররাতে ঘুম থেকে উঠে প্রাকটিস শুরু করেছে। সাধারণ গরিব ঘরের মেয়ে সব। স্কলাসটিকা স্কুলে দেখেছিলাম সুন্দর সুস্বাস্থ্যের অধিকারী মেয়েদের হ্যান্ডবল খেলা। ওরা ইংরেজিতে কথা বলে। ভালো খায়, গায়ের রং এর ঔজ্জ্বল্যে চোখ ধাঁধিয়ে যায়। আর এই মেয়েগুলো সাধারণ। খেতে পায় না ভালোমতো। আমাদের স্পোর্টস টিমের হেড আবদুল্লাহ হীরা ভাই জানালেন, এরা প্রাকটিস ক্যাম্পে ঢাকায় আসতেই চায় কারণ ওই কদিন ভালো খাওয়া-দাওয়া মেলে। তো এই মেয়েগুলাই তো জয়ের আনন্দ এনে দিলো আমাদের। প্রধানমন্ত্রী হাসতে হাসতে বললেন, ‘আমাদের মেয়েগুলা ১০ গোল দেয়, আর ছেলেরা গোল খায়।’ আমরা সাফল্য উদযাপন করলাম। টকশোতে ওদের দেখলাম। নিউজে মেয়েগুলার আধা শুদ্ধ উচ্চারণ অথচ স্মার্ট বক্তব্যে মোহিত হলাম।
কিন্তু তারপর? এটা যে ইতরের সমাজ তা তো ওই বীর পুঙ্গবেরা আবারও প্রমাণ করলো। এ সমাজ চিরকাল নারীর সাফল্য উদযাপন করে, সাফল্যের পেছনে মথ থেকে প্রজাপতি হওয়ার সময়টুকুর দায় নিতে সে রাজী না। এদেশের লোকাল বাসে ওঠার অভিজ্ঞতা যদি জানতে চান কোনো মেয়ের কাছে, সে বলে দেবে তার তিক্ত অভিজ্ঞতা। যেকোনো লোকাল বাসে উঠলে হেল্পার শরীরের স্পর্শকাতর জায়গায় ছুঁয়ে আপনাকে বাসে তুলবে যেন নিজের হাত-পা নাই। এইযে এত হিজাব-বোরকা- আমার কেন যেন ক্ষীণ সন্দেহ হয়, নিজেকে পুরোটা ধর্মের মোড়কে আবৃত করার এইটাও একটা করুণ কারণ। আর অশ্নীল মন্তব্য, সরাসরি বুকের দিকে তাকিয়ে থাকা এসব কোনো কিছুই নতুন নয়- আবহমানকাল ধরে চলছে। এখন ট্রাকশ্যুট পড়া গ্রামের কতগুলা মেয়ে গেলো লোকাল বাসে, তাতে আমি দোষ দেখি না। ওদের ওই গ্রামেই তো থাকতে হবে, এখনই তো কেউ ওদের চলার জন্য গাড়ি দেবে না বা থাকার জন্য এখনই তো ওরা পাবে না শহরের বাড়ি। কিন্তু এই যে বাসের ভেতর অপমানিত, বিদ্ধ হওয়া তার দায় কার?
পাশ্চাত্য সভ্যতায় মেয়েরা সংস্কৃতি জ্ঞানে-বিজ্ঞানে যেখানে এগিয়ে যাচ্ছে, সেই কবে থেকেই সেখানে আমরা কেবল যাত্রা শুরু করেছি। হ্যাঁ, আমাদের মেয়েরা এগিয়ে যেতে শুরু করেছে, কিন্তু এই এগিয়ে যাওয়াটা কতটুকু মুক্ত? পাশ্চাত্যে একটি মেয়ের এগিয়ে যাবার আয়োজন সবাই করছে, পরিবার, রাষ্ট্র, সমাজ। আর আমরা? আমাদের মেয়েরা এক পা ফেলতে গেলেই দুই পা পিছলে যায়। এইভাবে পিছলিয়ে যেতে যেতে তার প্রতিভার বিকাশ আসলে কতটুকু হয়? এখানে মেয়েরা স্বাধীনতার স্বরূপ কতটা অবাধে উপভোগ করতে পারে? কেন এই মেয়েরা জয়ের আনন্দ নিয়ে বাড়ি ফিরতে পারবে না? যে মেয়েগুলো এইসব অশ্নীল শব্দাবলী শুনে শুনে ফিরল বাড়ি, তাদের মনের ভেতর কি একটুও ছাপ ফেলবে না? তাদের পারফরমেন্সেও তো পড়তে পারে ছাপ।
মার্গারিটা মামুনকে নিয়ে আপামর বাঙালির আদেখলাপনা দেখে তখনই বলেছিলাম- এইসব বাঙালির কল্পনাসুখ। অন্যের ধন নিয়ে পোদ্দারি করা। যেখানে ফুটবল খেলে বাড়ি ফেরা যায় না বাজে কথা শোনা ছাড়া, সেখানে রিদমিক জিমন্যাস্টিক। আহ্লাদের আর সীমা নাই!
তাই পুরো এই ঘটনা নিয়ে আমার কোনো বিস্ময় নাই। ক্ষমা চাই বলে-টলে নিজের অনুতাপ কমানোরও কোনো সুযোগ নাই। এই মেয়েগুলো কলসিন্দুরের মেয়ে। গ্রামের সাধারণ মেয়ে। এদের অভিভাবকরা পর্যন্ত টাকার অভাবে আসতে পারেনি তাদের সাথে ঢাকা পর্যন্ত। কিন্তু আমরা, পুরো সমাজটা কি হতে পারতাম না, পারি না তাদের অভিভাবক?
এ সমাজের পুরুষের ইন্দ্রিয়তে এখনও ধর্ষণ মজ্জ্বাগত। তাই কারো কাছে কোনো সাহায্যই আমি অন্তত চাই না। এই ধর্ষণ মজ্জ্বাগত পুরুষদের মোকাবিলা করেই এগিয়ে যাবে মেয়েরা। শুধু একটা অনুরোধ, আগাতে না পারলে ‘মেয়েরা পারে না’ বলে কেউ ধুয়ো দেবেন না। আর অন্যদেশে গিয়ে সফলতা পেলে তা নিয়ে গর্ব করার অধিকারও আমরা আর রাখবো না সেটাও যেন মাথায় থাকে।
সূত্র: পূর্বপশ্চিমবিডি