জলাতঙ্ক নির্মূলে টিকাদান, পারস্পরিক সহযোগিতা বাড়ান

প্রকাশ | ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২০, ১৭:২২ | আপডেট: ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২০, ১৩:০২

ড. মো. মুর্শিদুল আহসান এবং ডা. এম. মুজিবুর রহমান

আজ ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২০। ১৪ তম বিশ্ব জলাতঙ্ক দিবস। ১৮৮৫ সালের ৬ জুলাই ফরাসি রসায়নবিদ ও জীববিজ্ঞানী লুই পাস্তুর জলাতঙ্ক রোগের টিকা আবিষ্কার করেন। ১৮৯৫ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর তিনি মৃত্যুবরণ করেন। জলাতঙ্ক প্রতিরোধে বিজ্ঞানী লুই পাস্তুরের অসামান্য অবদানকে স্মরণীয় করে রাখতে ২০০৭ সালে গ্লোব্যাল এলায়েন্স ফর র‍্যাবিস কন্ট্রোল (GARC) নামক সমন্বয়কারি সংস্থা বিজ্ঞানী লুই পাস্তুরের মৃত্যুদিবস ২৮ সেপ্টেম্বর কে বিশ্ব জলাতঙ্ক দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। এই বিশেষ দিনটি পালনের উদ্দ্যশ্য জলাতঙ্ক রোগ সম্পর্কে সারা বিশ্বের মানুষের মাঝে সচেতনতা গড়ে তোলা এবং রোগটির প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ সম্পর্কিত ধারণা দেয়া। সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে জলাতঙ্ক সম্পর্কিত সকল পদক্ষেপ ও কাজের সন্নিবেশ ঘটিয়ে বছর জুড়ে  বিশ্ব জলাতঙ্ক দিবস উদযাপন স্থানীয়, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিসরে জলাতঙ্ক প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ কার্যাদি পূর্বাপর উপস্থাপনের মাইলফলক হিসেবে কাজ করে। এবারের জলাতঙ্ক দিবসের প্রতিপাদ্য Rabies RABIES: COLLABORATE, VACCINATE অর্থাৎ ‘জলাতঙ্ক নির্মূলে টিকাদান, পারস্পরিক সহযোগিতা বাড়ান’।

জলাতঙ্ক রোগটি প্রায় ৪০০০ বছরের পুরাতন রোগ যার অস্তিত্ব শুধুমাত্র এন্টার্কটিকা মহাদেশ ব্যতীত সকল মহাদেশেই বর্তমান। মানুষসহ সকল উষ্ণ রক্ত বিশিষ্ট প্রাণির স্নায়ুতন্ত্রের মারাত্মক এই রোগটি জুনোটিক (Zoonotic) রোগ অর্থাৎ রোগটি প্রাণি থেকে মানুষে ছড়ায়। র‍্যাবিস (Rabies) নামক ভাইরাস দ্বারা রোগটি হয়ে থাকে। জলাতঙ্ক আক্রান্ত মানুষ ও প্রাণির গলবিলের পেশী বা Pharyngeal muscle এর অবশতার কারণে পানি গিলতে অসুবিধাজনিত ভীতির উদ্রেক ঘটে বলে রোগটিকে বাংলায় জলাতঙ্ক এবং ইংরেজীতে 'হাইড্রোফোবিয়া' (Hydrophobia) বলা হয়। বিশ্বের উন্নত অনেক দেশ যথাযথ পদক্ষেপের মাধ্যমে রোগটিকে শূন্য অথবা প্রায় শূন্যের কোঠায় নিয়ে আসলেও এশিয়া ও আফ্রিকার দেশ গুলোতে এ রোগের সমস্যা এখনও প্রকট। তাই চিকিৎসা বিজ্ঞানীগণ প্রায়শঃই জলাতঙ্ক-কে ‘অবহেলিত রোগ’ বলে থাকেন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা’র (WHO) রিপোর্ট মতে, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ৯৬% মানুষে জলাতঙ্ক সংক্রমণের জন্য কুকুরই দায়ী (Natural Reservoir)।

অসচেতনতা, দারিদ্র্যতা, রাস্তায় উদবাস্তু কুকুরের সংখ্যাধিক্য এবং পোষা কুকুরের টিকা নিশ্চিতকরণে অবহেলার কারণে এই রোগটি বাংলাদেশে প্রাদুর্ভাব হিসেবে বর্তমান। জলাতঙ্কের কারণে অর্থনৈতিক ক্ষতি, উচ্চমাত্রার স্বাস্থ্যঝুঁকি এবং মৃত্যুহার বিবেচনায় পৃথিবীতে বাংলাদেশের অবস্থান তৃতীয়। সম্প্রতি বিখ্যাত বিজ্ঞান সাময়িকী প্রকাশক ন্যাচার গ্রুপের ‘সায়েন্টেফিক রিপোর্টে’ ঢাকার মহাখালীতে অবস্থিত জাতীয় জলাতাঙ্ক নিয়ন্ত্রণ ও নির্মূল কেন্দ্র খ্যাত সংক্রামক ব্যাধি হাসপাতালের জানুয়ারী ২০০৬ থেকে ডিসেম্বর ২০১৮ পর্যন্ত সময়কালের ১৩২৭ জন জলাতঙ্ক আক্রান্ত রোগীর মধ্যে ৪২২ জনের তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষিত গবেষণা নিবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। উক্ত গবেষণা রিপোর্টে দেখা যায় আক্রান্ত রোগীদের মধ্যে ৭০ শতাংশ পুরুষ, ৪৭ শতাংশ শিশু যাদের বয়স ১৫ বছরের কম এবং ৮২ শতাংশ  রোগী গ্রামে ছিলেন। আক্রান্ত রোগীদের মধ্যে শতকরা ৯০ জন কুকুর দ্বারা সংক্রমিত ছিলেন এবং বিড়াল, শেয়াল ও বেঁজী দ্বারা সংক্রমিত ছিলেন শতকরা ৬, ৩ ও ১ জন। এদের মধ্যে ৭৮% রোগী প্রাণির কামড় বা আঁচড়ের শিকারের পর ঝাড়ফুঁকের জন্য ওঝা, ফকির, কবিরাজ ও গ্রাম্য হাতুড়ে ডাক্তারের শরণাপন্ন হয়েছিলেন। অর্থাৎ, যারা কামড় পরবর্তী কোন ব্যবস্থা এবং প্রতিষেধক বা Post Exposure Prophylaxis (PEP) নেননি। আক্রান্তদের মাত্র ১২% চিকিৎসকের শরণাপন্ন হয়ে PEP নিলেও তাদের বেশির ভাগই টিকার কোর্স সম্পন্ন করেননি। এছাড়া গবেষণা রিপোর্ট ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে প্রকাশিত তথ্য থেকে জানা যায়, ২০১০ সাল থেকে বাংলাদেশে জলাতঙ্ক রোগের জন্য (মানুষের ক্ষেত্রে) WHO’র পরামর্শ অনুযায়ী ‘নার্ভ টিস্যু টিকা’র পরিবর্তে ‘আধুনিক টিস্যু কালচার টিকা’ ব্যবহার এবং একই সাথে প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় ও স্থানীয় সরকার বিভাগের প্রত্যক্ষ সহায়তায় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার জুনোটিক ডিজিজ কন্ট্রোল অপারেশন প্ল্যানের অধীনে ব্যাপকহারে কুকুর টিকাদান (MDV) কার্যক্রম শুরু হয়েছে। প্রকাশিত গবেষণাটি নিশ্চিত করেছে যে MDV কার্যক্রম বাংলাদেশে জলাতঙ্ক রোগ নিয়ন্ত্রণে যথেষ্ট ইতিবাচক ভূমিকা রাখছে। ২০১০ সালের পূর্বে প্রতি বছর প্রায় ২৫০০ মানুষ জলাতঙ্ক রোগে প্রাণ হারাতো যা বর্তমানে কমে প্রায় ২০০ শতের কাছাকাছি এসেছে। প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের তথ্য মতে প্রতি বছর জলতঙ্ক আক্রান্ত গবাদি পশুর আনুমানিক সংখ্যা ২৫ হাজার যার অর্থনৈতিক মূল্য অপরিসীম।

জলাতঙ্ক রোগে মৃত্যু অনিবার্য হলেও এ রোগ শতভাগ প্রতিরোধযোগ্য। এই রোগ প্রতিরোধের সর্বোৎকৃষ্ট সমাধান বাহককে (বিশেষত কুকুরকে) টিকাদান। WHO’র মতে জলাতঙ্ক নিয়ন্ত্রণের জন্য কোন নির্দিষ্ট এলাকা/দেশের মোট কুকুরের ৭০% কে টিকা দেয়া গেলে, ঐ এলাকা/দেশের সব কুকুরের শরীরে সম্মিলিত প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে উঠে (Herd immunity)। ফলে জলাতঙ্ক ভাইরাস কুকুর থেকে কুকুরে কিংবা মানুষে সংক্রামিত হতে পারবে না। অর্থাৎ ব্যাপকহারে কুকুর টিকাদান নিশ্চিত করলে মানুষ ও কুকুর উভয়ই নিরাপদ থাকবে। জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার সাথে সামঞ্জস্য রেখে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO), বিশ্ব প্রাণি স্বাস্থ্য সংস্থা (OIE), বিশ্ব খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (FAO) ও গ্লোবাল এলায়েন্স ফর র‍্যাবিস কন্ট্রোল (GARC) সম্মিলিতভাবে বিশ্ব থেকে ২০৩০ সালের মধ্যে হতে সংক্রমিত জলাতঙ্ক শূন্যের কোঠায় নিয়ে আসার ঘোষণা দিয়েছে। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার ২০২২ সালের মধ্যে এ লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য জাতীয় জলাতঙ্ক নির্মূল কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী জানা গেছে এ কার্যক্রমের আওতায় দেশের সকল সিটি কর্পোরেশন, ৬৩ টি জেলা সদর পৌরসভা ও ৩৯ টি জেলার সকল উপজেলায় ১ রাউন্ড, ৭ টি সিটি কর্পোরেশন, সমগ্র নীলফামারী, মানিকগঞ্জ, গাজীপুর, মাদারিপুর ও পাবনা জেলার সকল উপজেলায় ২ রাউন্ড এবং কক্সবাজার সদর পৌরসভা, সাতক্ষীরা সদর পৌরসভা, সমগ্র গাইবান্ধা ও সিরাজগঞ্জ জেলার সকল উপজেলায় ৩ রাউন্ড টিকার কাজ সফলভাবে শেষ হয়েছে। এভাবে টিকাদান প্রাপ্ত মোট কুকুরের সংখ্যা ১৬ লক্ষ ৯৯ হাজার। এটি দেশের অনুমিত মোট কুকুর সংখ্যার ৮০%।

অপরিকল্পতভাবে কুকুর নিধন ও অপসারণ অমানবিক ও প্রাণিকল্যাণ আইন, ২০১৯ পরিপন্থী কাজ এবং এটি কোনভাবেই জলাতঙ্ক প্রতিরোধের সহায়ক নয়। অমানবিক ও অপরিকল্পিত বেওয়ারিশ/পথ কুকুর নিধন ও অপসারণ পরিবেশের ভারসম্যের জন্য ক্ষতিকারক। বরং বিভিন্ন গবেষণা থেকে জানা যায় যে ব্যাপকহারে কুকুর নিধন/অপসারণ পরিবেশে কুকুরের সংখ্যা বৃদ্ধিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। জলাতঙ্কের ভয়াবহতা ও জনস্বাস্থ্য ঝুঁকি কমাতে প্রয়োজন ব্যাপকহারে টিকাদানের পাশাপাশি সুপরিকল্পিতভাবে কুকুরের অভিভাবকত্বের প্রসারণ (Dog Ownership Promotion) এবং জন্ম নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাপণা (Dog Population Management)। কুকুরের কামড়ে আতংকিত হওয়া কিংবা ঐ কুকুরের কোন ক্ষতি করা যাবে না। কুকুর/প্রাণি দ্বারা কামড়ের প্রাথমিক চিকিৎসা হিসেবে ক্ষতস্থানটি অবশ্যই ক্ষারযুক্ত সাবান পানি দিয়ে ২০ মিনিট ধরে ভালোভাবে ধুয়ে ফেলতে হবে। আক্রান্ত ব্যক্তির ভীতি দূর করে পরবর্তী চিকিৎসার জন্য অবশ্যই রেজিস্টার্ড ডাক্তারের শরণাপন্ন হতে হবে। আক্রমণকারী কুকুর কিংবা প্রাণিটাকে নিধন কাম্য নয়। এক্ষেত্রে অবশ্যই রেজিস্টার্ড প্রাণিডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে। মানুষসহ অন্যান্য প্রাণিকে জলাতঙ্ক রোগের প্রকোপ থেকে সুরক্ষা একমাত্র টিকাই দিতে পারে। আমাদেরকে এ ব্যাপারে সচেতন হতে হবে এবং সংশ্লিষ্ট সকল সংস্থা ও ব্যক্তিবর্গের পরস্পরিক সহযোগিতা আরও বাড়াতে হবে। ব্যক্তিগত ও জাতীয় স্বার্থে পোষা কুকুর বিড়ালসহ এলাকার সকল কুকুরে টিকা নিশ্চিত করার মাধ্যমে বিশ্ব জলাতঙ্ক দিবসের প্রতিপাদ্যকে অর্থবহ করতে সকলের উদ্দেশ্যে আমাদের আহ্বান, ‘জলাতঙ্ক নির্মূলে টিকাদান, পারস্পরিক সহযোগিতা বাড়ান’।

লেখক:
ড. মো. মুর্শিদুল আহসান
ন্যাশনাল কনসাল্ট্যান্ট (প্রাণি স্বাস্থ্য-জলাতঙ্ক),  
পিএআরবি প্রকল্প, প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর।

এবং  

ডা. এম. মুজিবুর রহমান
এমডিভি এক্সপার্ট, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।