মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও সমাজের অগ্রগতির চিহ্ন
প্রকাশ | ২৬ জুলাই ২০২০, ১৪:২৮
একটি সমাজ কতখানি আধুনিক ও পরিণত; চিন্তা, চেতনা, মননে ও চর্চায় কতটা অগ্রসর; তা বোঝার অনেক পরিমাপ রয়েছে। যেমন, সেই সমাজে নারীর স্বাধীন ও নির্বিঘ্ন চলাফেরা করার পরিবেশ আছে কি-না। মানুষের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা আছে কি-না। নেই? সামাজিক, রাজনৈতিক ব্যঙ্গবিদ্রুপের যথেষ্ট সুযোগ আছে কি-না? সর্বোপরি সমাজে আইনের শাসন নিশ্চিত কি-না? আপাতত এসবের আলোকে বিবেচনা করলেও, কোন সমাজ যদি উৎরে যায়, তো ভালো; নয়তো ধরে নিতে হবে সেই সমাজকে আরও বহুদূর হাঁটতে হবে। অর্থাৎ সভ্যতার পথে তাদের যাত্রা এখনও শেষ হয়নি। প্রশ্ন হচ্ছে, আমাদের সমাজের অবস্থান কোথায়? উত্তরটা কম-বেশি সবারই জানা।
করোনা মহামারীকালে তো এই প্রশ্নও উঠছে যে, সভ্যতার নিরবিচ্ছিন্ন যাত্রায় মানুষ কতটা সভ্য পন্থা অনুসরণ করেছে? বিলাস-ভোগের নিরন্তর উদ্দামতায় মানুষ্ই বরং ধ্বংসের কারণ হচ্ছে পুরো বিশ্বসংসারের! সুতরাং বিশ্বের তাবৎ জ্ঞানী-গুণীজনকে নতুন করে এখন ভাবতে হচ্ছে, প্রগতির পথের এই যাত্রায় মানুষ কী কী ভুল করেছে। কী কী ভুল তাকে শোধরাতে হবে। যদি তারা তাদের সভ্যতা টিকিয়ে রাখতে চায়।
এসব গবেষণা আর জ্ঞানের চর্চার প্রথম শর্ত হলো, বিদ্যমান অবস্থাকে প্রশ্ন করা। সেসব সমাজে বিদ্যমান সভ্যতা-সংস্কৃতি-জ্ঞানের রীতিমাফিক চর্চার বিপরীতে মত প্রকাশের স্বাধীনতা আছে, সে সমাজই এগিয়েছে। ইতিহাস তাই সাক্ষ্য দেয়। যারা তা করতে পারেনি, তারা পেছনেই পড়ে রয়েছে। বাংলাদেশের সমাজে কোন কালেই প্রশ্ন করার সংস্কৃতিকে উদারভাবে স্বাগত জানানো হয়নি। এখানে সমালোচনাকে ভালোভাবে গ্রহণ করা হয় না। অথচ হওয়া উচিৎ ছিলো উলটোটা।
এখন তো ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের বদৌলতে এমন এক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে যে, মানুষ স্বাধীনভাবে মত প্রকাশে কুণ্ঠিত। অথচ এই আইনের প্রাসঙ্গিকতা কিছুটা হলেও পরিলক্ষিত হতে পারতো। যদি দেখা যেতো সেটা এমন ব্যক্তি বা গোষ্ঠির বিরুদ্ধে ব্যবহৃত হচ্ছে, যারা মিথ্যা তথ্য রটিয়ে. গুজব ছড়িয়ে ব্যাপক পরিসরে বিশৃঙ্খলা তৈরি করছে বা ঘৃণা ছড়াচ্ছে। কিন্তু বাস্তবে তা কি হচ্ছে? বরং কিছু কিছু ক্ষেত্রে বিশৃঙ্খলা ঠেকাতে গিয়ে প্রকারান্তরে জনসাধারণের স্বাধীনসত্তার উপর খবরদারি হচ্ছে। ভুঁইফোঁড় কিছু নৈতিক পুলিশেরও উদ্ভব হচ্ছে। তারা নানান অজুহাতে অধিকাংশক্ষেত্রেই নিজের ব্যক্তি বা গোষ্ঠীগত স্বার্থে এই আইনের অপব্যবহার করছে।
স্বীকার করতে হবে, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সুযোগ্য কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের আমলে এদেশ অভূতপূর্ব উন্নয়নের সাক্ষী। কিন্তু একই সাথে একথা বলাটাও ভুল হবে না যে, অবকাঠামোগত উন্নয়নের পাশাপাশি মানবিক উন্নয়ন সে অর্থে এখনও হয়নি। যদি হতো তবে এই মহামারীর সময়ে হলেও, দেশে খুন-ধর্ষণ-দুর্নীতি কমতো। সরকারের শত উন্নয়ন ম্লান হয়ে যায়, এসব অন্যায়ের ক্ষেত্রে এখনও আইনের যথাযথ শাসন নিশ্চিত না করতে পারায়। একইভাবে মতপ্রকাশের অধিকার সংকুচিত হয়ে পড়ার বিষয়টিও আসে। টানা তৃতীয় মেয়াদে সরকার গঠনের প্রথম বর্ষপূর্তিতে প্রধানমন্ত্রী দূর্নীতির বিরুদ্ধে তার অবস্থানের কথা দৃঢ়তার সঙ্গে জানিয়েছিলেন। বলেছিলেন- ‘দুর্নীতি বন্ধে জনগণের অংশগ্রহণ জরুরি। মানুষ সচেতন হলে, দুর্নীতি আপনা-আপনি কমে যাবে।‘ সেই ধারাবহিকতায় তিনি নিজ দলের অনেককেও ছাড় দেননি। তাহলে জনগণ ওনার ডাকে সাড়া দিয়ে দুর্নীতি বা যেকোন অন্যায়ের বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলতে পারবে না কেন?
কেন জনসাধারণকে সরকারের সমালোচনা করতে গিয়ে দুইবার ভাবতে হবে? এতে করে সরকারের সুনাম বাড়ে না কমে? সরকারের নির্ধারকদের এসব ভেবে দেখা অত্যন্ত জরুরি। কারণ, বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি আর সমালোচনার পার্থক্য করতে না পারা সার্বিকভাবেই ক্ষতির। বিশৃঙ্খলা রুখতেও যেমন দূরদর্শিতা ও মানবিকবোধ জরুরি; তেমনই সমালোচনা মোকাবেলায়ও এই প্রজ্ঞা জরুরি যে সমালোচনা আদতে কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে ঋদ্ধই করে।
করোনার এই সংকটকালে তো রাষ্ট্রকে আরও বেশি মানবিক হতে হবে। উন্নয়শীল দেশ থেকে সবে নিম্নমধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হলেও, দেশের অনেক বস্তুগত কাঠামোকে মাথায় রেখে জনগণকে অনেক অপ্রাপ্তি হাসিমুখে মেনে নিতে হয়। এই দুর্যোগে মানুষের যে আতঙ্ক আর মানসিক বিপর্যয়ের আশংকা রয়েছে, তাতে ক্ষোভ অনেক ক্ষেত্রেই মাত্রা ছাড়িয়ে যেতে পারে। এই সময়ে নাগরিকদের সমালোচনায় রাষ্ট্রযন্ত্রের খড়গহস্ত হওয়া উচিত হবে না। বিষয়টি অমানবিকও। কারণ এই পর্যায়ে কাউকে মত প্রকাশের জন্য জেল-জরিমানার আওতায় আনা এক অর্থে তাকে জীবনঝুঁকির মাঝেই ফেলা হয়। যেখানে লকডাউনে লোকে বাড়িতে অবস্থান করাটাই সমাধান, সেখানে গ্রেফতার, থানা, পুলিশ, কারাগার মানে পদে পদে করোনা আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি।
কথা হচ্ছে, কে কীভাবে সেই সমালোচনা করছে বা করবে? শিক্ষিত ও বিবেকবোধসম্পন্ন যে কারোর সমালোচনার ভাষা হতে হয় সামাজিক মূল্যবোধের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ। যদিও সমালোচনার ভাষা কোন কাঠামো মেনে চলে না। যেমন গান-কবিতা-নাটক-চলচ্চিত্র নির্মাণের, অর্থাৎ শিল্পের কোন ধরাবাঁধা কাঠামো নেই। তবুও প্রচলিত সমাজব্যবস্থাকে মাথায় রেখে অনেক সময়েই ভাষা ব্যবহারে সংযত হতে হয়। ক্ষেত্রবিশেষে তা যৌক্তিকও বটে এবং তা সমাজ কাঠামোর স্বার্থেই। কারণ, এসব ভব্যতা-সভ্যতার মাপকাঠিও সমাজের প্রয়োজনেই নির্মিত, যা সমাজই নির্মাণ করেছে। তা না মানলে যেমন সমাজ মেনে চলা ব্যক্তিদের ক্ষোভ সৃষ্টি হওয়া স্বাভাবিক, একইভাবে তা না মানার অধিকারও সমালোচকের থাকতে হবে। এসব ক্ষেত্রে সমালোচনাকে বা প্রশ্নকে সংশ্লিষ্ট সমাজ-মানসের উপরেই ছেড়ে দেয়া ভালো। সমাজ চাইলে গ্রহণ করবে, নচেৎ করবে না। প্রত্যাখ্যানযোগ্য হলেও লেখার জবাব লেখা দিয়েই দেয়া যায়। তাই শোভন ও সুন্দর।
লেখা বা সমালোচনার জবাবে হামলা, মামলা, গ্রেফতার, জরিমানা, দণ্ড গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। দুর্ভাগ্যবশত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন সেই অনাকাঙ্খিত প্রবণতাই ক্রমে স্পষ্ট করে তুলেছে। তাই বর্তমানে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিল করার ব্যাপারে সচেতন মহল থেকে যে দাবি উঠছে, তা সরকারের দৃষ্টিগোচরে আসুক এই প্রত্যাশা করি। এই আইনের অনাকাঙ্খিত অধ্যায়গুলোর প্রয়োগ সরকারের অপরাপর সাফল্যকে ছাপিয়ে না যাক। সবার আগে জরুরি, মতপ্রকাশের স্বাধীনতাবিরোধী ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের আওতায় গ্রেফতারকৃতদের অবিলম্বে মুক্তি। সরকারের পক্ষ থেকে এমন ভুমিকাই কাম্য, যা কবি বলে গেছেন- 'নিন্দুকেরে বাসি আমি সবার চেয়ে ভালো।'
লেখক: সহকারী অধ্যাপক, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, গোপালগঞ্জ
প্রথম প্রকাশ: সমকাল, ০২ জুলাই ২০২০