গল্পটা আমাদের!
প্রকাশ | ১৮ আগস্ট ২০১৬, ২৩:৫৫ | আপডেট: ১৯ আগস্ট ২০১৬, ০০:২৮
গল্পটা এভাবেও শুরু হতে পারতো, ‘সে অনেক কাল আগের কথা। এক দেশে ছিলো এক রাজকন্যা…’ কিন্তু নাহ। আমি কখনোই রাজকন্যা ছিলাম না। বড়জোড় ঘুটেকুড়ানী বলা যেতে পারে আমাকে। আর ঘুটেকুড়ানীদের উদ্ধার করতে কোন রাজপুত্র সাদা ঘোড়ায় চড়ে আসে না।
এই ঘুটেকুড়ানীর জীবনেও একদিন এইচ এস সি পরীক্ষার রেজাল্ট নামক বস্তুটি এসেছিলো। রেজাল্টের পর আমার সবচাইতে প্রিয় মানুষটা, আমার মা ফোন করে শুধু বললেন, ‘তুই আগে কেন বলিস নাই আমারে যে তুই এই রেজাল্ট করবি? আগে থেকে বইলা রাখলে আমি বিষ খেয়ে প্রাণ দিয়া দিতাম। মাইনষের কাছে আর মুখ দেখানো লাগতো না তাইলে’। “হুম, ক্লাস ওয়ান থেকে কন্টিনিউয়াস্লি ক্লাসে ফার্স্ট হয়ে আসা, ফাইভে এইটে বৃত্তি পাওয়া, ভাষা প্রতিযোগ গণিত অলিম্পিয়াডে প্রাইজ পাওয়া-সর্বোপরি মহাকাশ বিজ্ঞানী হতে চাওয়া এই আমার ৩.৮ রেজাল্টটা ভয়াবহ একটা বিপর্যয়ই ছিলো। বাবার সাথে ভয়ে কথাই বলিনি ছ’মাস। আমি জানতাম, বাবা শুধু আফসোস করছিলো, মেয়েদের লেখাপড়ার পেছনে টাকা পয়সা ঢালাই মস্ত বড় ভুল। আত্নীয়-স্বজনের সেকি আফসোস; হাস-মুরগি সবাই এ প্লাস পাইলো আর তুই পাইলি না।
উফফ… সেই অসহনীয় মুহূর্তগুলো। চোখের সামনে বুয়েটের দরজা বন্ধ হয়ে গেলো। সবাই কথা বার্তা বলছে যে কোন কলেজে ডিগ্রিতে ভর্তি করিয়ে দিবে নাকি বিয়ে দিয়ে দিবে কোন দুবাই ওয়ালার সাথে। আমি তখন ঢাকায়, খালার বাসায় থেকে কোচিং করি। খালা শুধু একবার এসে জিজ্ঞেস করলো, রেজাল্ট কি ভুল আসছে? আমি বললাম, না। ঢাবিতে পরীক্ষা দিতে পারবি? হিসেব করে দেখলাম, ম্যাট্রিক-ইন্টার মিলিয়ে ঢাবিতে পরীক্ষা দিতে লাগে ৮ পয়েন্ট, আমার আছে ৮.২৫। বললাম পারবো। খালার ছোট্ট বাসা। জায়গা নাই, রাতে কাজের মেয়ের সাথে বিছানা করে ঘুমাই। খালার শ্বশুড়ের ক্যান্সার। খালার বাসায় থেকে চিকিৎসা হয়। লোকজনে বাসা গমগম করে, বসার জায়গাটা পর্যন্ত নাই। সন্ধ্যা থেকে সবাই টিভি দেখে, পড়ার কোন জায়গা নাই টিভি রুম ছাড়া। কিভাবে কি করেছিলাম ডিটেইল বলতে গেলে মহাকাব্য হয়ে যাবে। তাই সংক্ষেপে বলি-কেউ বিন্দুমাত্র সহানুভূতিটুকুও দেখায়নি ১৭ বছরের আমাকে। সবাই বার বার বলেছে আমাকে দিয়ে কিচ্ছু হবে না। আর আমি ছয় মাস কান বন্ধ করে ছিলাম। প্রতি মুহূর্তে হেরে যাবার ভয় কুড়ে কুড়ে খেতো আমায়। ছয় মাস মা বাবার মুখ দেখিনি, বাড়ি যাইনি তিক্ত কথার ভয়ে। আমি ছাড়া আমার কেউ ছিলো না।
খুব ক্যাল্কুলেটিভ হয়ে যাই হঠাৎ করে। আমি স্টাডি করে দেখলাম ঢাবিতে যারা প্রথম হয়ে তারা লিখিত পরীক্ষায় পায় ৯০। অর্থাৎ আমার রেজাল্টের মার্কিং খারাপ হলেও লিখিততে যদি প্রথম হতে পারি তাহলে একটা চান্স থাকবে। ডি ইউনিটে বিষয় ছিলো বাংলা, সাধারণ জ্ঞান, ইংরেজি। হিসেব করে বের করলাম কোনটাতে কতো পেতে হবে। এরপর কোন বিষয়ের কোন টপিক কদ্দুর পড়তে হবে। গ্রাম থকে আসা এই আমাকে এইসব কিন্তু কেউ শিখিয়ে দেয় নি। শুধু চিন্তা করতাম, আমার সর্বোচ্চটা দিলে আসলে কদ্দুর যাওয়া যায়। তীব্র মানসিক চাপে আমি অসুস্থ হয়ে যেতাম কিন্তু হাল ছাড়িনি। ঘ ইউনিটের পরীক্ষার সাতদিন পর রেজাল্ট হয়েছিলো। সেই সাতদিন আমি শুধু প্রশ্ন মিলিয়ে কাটিয়েছি। অবশেষে রেজাল্ট পাবলিশ হলো। আমার এক আন্টি ফোন করে বললো আমার নাকি ঢাবিতে হয়নাই। আমি কষ্ট পেলাম না। শুধু অবাক হয়ে ভাবছিলাম, পোলাপাইনের পরীক্ষা কতো ভালো হইসে যে আমার আসেই নাই। আমার মা ঠাস করে গালে একটা চড় বসিয়ে বললো, এখন এতো কান্নাকাটি, এইগুলা আগে মনে ছিলো না? হঠাৎ আমার ছোট ভাই বললো আপুনি রোল নাম্বার টা বলো তো, আমি একটু নেট এ দেখি। দেখে বললো এসেছে…ভাইভা ফেস করলাম ৩.৮ পাওয়া এই আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগে যেদিন চান্স পেলাম প্রথম বারের মতো সেদিন আমি অঝোর ধারে কাঁদছিলাম।
আমি কোন তত্ত্বকথা বলবো না। শুধু বলবো, লাইফটা প্রথমতো তোমার এবং শুধুই তোমার। যতোক্ষণ পর্যন্ত তুমি তোমাকে হারতে দিচ্ছোনা, পুরো পৃথিবীর কারো সাধ্য নাই যে তোমাকে হারায়। জাস্ট কিপ দ্য স্পিরিট। কিপ ফাইটিং।
উযমা তাজ্বরিয়ান স্বপ্নীল’র ফেসবুক থেকে