জাগো নারী জাগো বহ্নিশিখা
প্রকাশ | ০৮ মার্চ ২০১৯, ২০:২৭
মা বলতেন, কথা শিখতে খুব একটা দেরি হয়নি আমার। বরং সমবয়সীদের থেকে একটু বেশিই তাড়াতাড়ি। তারপর অনর্গল। সবার স্নেহ মিশ্রিত প্রশ্রয়ে আর অতিরিক্ত ডানপিটে স্বভাবের কারণে দুমদাম মুখের উপর কথা বলার অভ্যাসটা তৈরী হয়ে গিয়েছিল অজান্তেই। সবাই বলতো মুখফোঁড়।
তখনও মেয়েবেলার দিনগুলো এখনকার মতো এতটা সংকুচিত হয়ে যায়নি। সাত-আট বছরের মেয়ে শিশুকে নিয়ে অভিভাবক একপ্রকার নিরুদ্বিগ্নই থাকতো বলা চলে। মায়ের অফিস আটটা থেকে আড়াইটে। স্কুল ছুটির দিনগুলো স্বর্গীয়। কোনমতে পেটে চারটে চাপিয়ে সারাটা দিন দস্যিপানা। ছ’ সাত জনের তুমুল দাপটে কলোনীর বরই গাছের পাতাগুলো আতংকিত। গোল্লাছুট-দাড়িয়াবান্ধার বিরতিতে এ গাছ থেকে ও গাছ।
অধিকাংশ পরিবারের আলাদা কিচেন গার্ডেন ছিল । আমরা বলতাম “ক্ষেত”। পালা করে এক একজনের ক্ষেতে হামলা করে সদ্যতোলা টমেটো, পেঁয়াজ, ধনেপাতা মিশিয়ে কলাপাতায় অভিনব এক সালাদ খেয়ে অতিরিক্ত ঝালে তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলতে তুলতে দলবল সমেত কারও সদ্য গজানো পালং এর বেড মাড়িয়ে ফেলে অনুশোচনায় ভুগতাম।
দস্যিপানার চোটে প্রায়শই আমার ফ্রকের পিছনের বোতাম একটা দুটো করে ছিঁড়তে ছিঁড়তে নাই হয়ে যেত, পেছনের বেল্টের দুটোর সহাবস্থান কদাচিৎ দেখা যেত। মা চরম বিরক্ত হয়ে দুমাদুম কয়েক ঘা লাগিয়ে হয়ত সেলাই করে দিতো। কিন্তু ঘটনাগুলো এতটাই পৌনঃপুনিক, যে আমার পিঠের অধিকাংশ স্থান মোটামুটি দৃশ্যমান থাকত। অবশ্য তখনকার মানুষগুলোর মানসিক অসুস্থতা এতটা তীব্র পর্যায়ে যায়নি যে ওটাকে একটা শিশুর শরীর ছাড়া অন্য কোন কিছু বলে ভাববে।
আমাকে প্রায়শই দেওয়ালে উঠতে হতো, তাসকিন-বাবুদের কাছে আমার সক্ষমতা জাহির করার প্রসঙ্গে। মাদার গাছের ডালে বা মসজিদের ছাদে পাখির বাসায় পাখির ডিমগুলো দেখে রাখার মহান দায়িত্বগুলো চরম নিষ্ঠার সাথে পালন করতে হতো।
এসব কাজে আমার ফ্রকের ঝুলগুলো নিদারুণভাবে শত্রুতা করতে শুরু করেছিলো। একবার আমার নতুন কেনা হলদে রঙা চিকেন কাজের ফুলতোলা ফ্রকের ঝুলের পুরোটাই পিএমজি স্কুলের উঁচু দেওয়ালে লটকে গেল চরম বিশ্বাসঘাতকতায়। আমি পুচ্ছছাড়া ময়ুরের মতো দেওয়াল থেকে নামতে কোরাস কন্ঠে সেকি হাসির রোল! ঈশ্বরের প্রতি ছল ছল অভিমান। ইস্! আমি যদি ছেলে হতাম!
দিন গড়ালো। ফ্রকের ঝুলের আকার বৃদ্ধি পাওয়ার সাথে যোগ হলো অনুষঙ্গ। কয়েক প্রস্থ পোশাকের গ্রন্থিতে টানা হলো লক্ষণরেখা। ভুঁইফোড় স্বভাবটি শেষ হলেও মুখফোঁড় বদলালো না।
গুরুজনেরাও বলতো মেয়েমানুষের মুখ যত বন্ধ, সংসার ততই শান্তির। জোরে হাসবে না, গলা তুলে কথা বলবে না, মুখের উপর কথা বলবে না, ধুপধাপ শব্দ করে চলাফেরা করবে না, খাওয়ার সময় শব্দ হবে না কত কি! ঈশ্বরকে বললাম, ইস্ আমি যদি ছেলে হতাম!
আশপাশের পারিপার্শ্বিকতা চোখে আঙুল দিয়ে এই ব্যবধানটা স্পষ্ট করতে শুরু করেছিল। আমার সমবয়সী স্কুলফেরত ছেলেগুলো পাড়ার মোড়ে সাইবার ক্যাফেতে বসে নেটে গুগল সার্ফিং করতো। আমরা তখন বাড়ির ছাদে বাগানে জল দিতে দিতে পরদিন ক্লাসের পদার্থবিজ্ঞানের ইকোয়েশন সমাধানের চিন্তায় হাবুডুবু খেতাম। তখন ক্ষণিকের জন্য মনের কোণে উঁকি দেয়। ইস্ ... আমি যদি ছেলে হতাম!
দু' বোন একসাথে স্কুল কলেজ থেকে ফিরতাম। পাড়ার মোড়ে চায়ের দোকানের চোখগুলো অস্বস্তি তৈরীর জন্য যথেষ্ঠ ছিল। বাসার সামনে অচেনা লোকজনের মোটর সাইকেলের মহড়া মা বাবার কপালের ভাঁজকে দীর্ঘায়িত করতো। তারউপর শুভাকাঙ্ক্ষীদের দিনরাতের পরামর্শ। দুই দুইখান মেয়ে ঘাড়ের ওপর, দেখতে ভাল, কোনখান দিয়ে কোন বিপদ ঘাড়ে চাপে, সময় থাকতে বিয়ে দেওয়াটাই যুক্তিযুক্ত। পড়াশোনা তো বিয়ের পরেও করানো যায়। দিদির প্রচন্ড অনশন, ধর্মঘট, কান্নাকাটি, হল্লাহাটি সত্ত্বেও মাত্র উনিশ বছর বয়সে ওর বিয়ে হয়ে যায়। অথচ কি অসম্ভব সৃজনশীল ছিল ও! তখন আফসোস... আমরা কেন ছেলে হলাম না!
ছেলে হয়ে ওঠার জন্য প্রাণপণ সংগ্রাম শুরু করি। নিজের অবস্থানের বিপরীতে গিয়ে সবসময় নিজেকে অতিক্রম করার চেষ্টা করি। নিজের যতটুকু অর্জিত বিদ্যা, সৃজনশীলতা, একাগ্রতা দিয়ে পায়ের নীচে একটা অবলম্বন খুঁজতে থাকি। যেখান থেকে দাঁড়িয়ে অন্তত উঁচু গলায় কথা বলা যাবে। পেয়েও গেলাম। ছোটখাট, মাঝারি সম্মানজনক চাকরী। অর্থনৈতিক স্বাধীনতা সাথে কিছুটা আত্মবিশ্বাস। যদিও সেটা মেরুদন্ড শক্ত করার মতো যথেষ্ঠ ছিল না। সংসার, সন্তান, পেশা সামলে নিজেকে সমৃদ্ধ করতে থাকি। কারণ মনে হয় মেয়ে হিসেবে পথ চলাটা অতটা সহজ নয়। নিজেকে আরও বেশি সমৃদ্ধ করতে হবে নিজের জায়গা তৈরী করতে গেলে। সময়ের সাথে নিজের যোগ্যতা অনুযায়ী কর্মস্থল বদলালো। চাকরী পেলাম একটা, দুটো, চারটে।
সেখান থেকে দেখছিলাম তৃণমূল মেয়েদের অবস্থান। আজ হয়তো আমার অনেক সহকর্মীই আমার সাথে একমত হবেন না। তাদের হয়ত কোন স্ট্রাগলই করতে হয়নি, বা করতে হয়েছে আমার থেকে বেশি। চেয়েছিলাম অন্যদের রাস্তাগুলো যাতে আমাদের থেকে একটু মসৃণ হয়। অভীষ্ট লক্ষ্য ছিল সিদ্ধান্তগ্রহণ প্রক্রিয়ায় অংশ নেওয়া। বিসিএস দিলাম। প্রথমবারে ভাইভা বোর্ডে মনে হলো পুঁথিগত বিদ্যার বাইরে আমার জানার অনেক ঘাটতি আছে। যেগুলো হয়তো অনেকে চায়ের দোকানে আড্ডা দিতে গিয়ে শিখে ফেলে। তখনও একবার মনের কোণে উঁকি দিয়েছে... ইস্!
নিজের ঘাটতিগুলো অনুধাবন করতে পারাটাও এক ধরনের সৃজনশীলতা। নারীদেরকে নিজেকে অতিক্রম করতে হয় নিজেরই অনুপ্রেরণায়। কারণ একবার ব্যর্থতার অন্তরালে হাজারো উৎসুক হাত অপেক্ষা করে করতালি দেবার জন্য। নিজেকে নিজে পুরস্কৃত করতে হয়, অনুপ্রাণিত করতে হয়।
আজ এই নারীর ক্ষমতায়নের যুগে পুরুষের সাথে সমান তালে প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে, অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছে ক'জন নারী পারছেন সিদ্ধান্তগ্রহণ প্রক্রিয়ায় অংশ নিতে? অথবা পৌঁছালেও তাদেরকে দেওয়া হয় না সিদ্ধান্তগ্রহণের অধিকারটুকু। তবে আশার বাণী এটাই যে লক্ষ্য অর্জনের দাঁড়ি অন্তত ছুঁতে পেরেছেন ক'জনা।
সমানাধিকার অর্জনের লক্ষ্যে যে গন্তব্য ছিল এখন সেটা #Balanceforbetterment.
এই ব্যালেন্সটা আসলে কাদের স্বার্থে সেটা ভেবে দেখা প্রয়োজন। উনিশ শতকের শুরুতে যখন নারী শিক্ষা, নারী স্বাধীনতা বিশেষ গুরুত্ব পেতে শুরু করলো মূলতঃ পুরুষেরাও যোগ্য সহধর্মিনীরই প্রয়োজনে। তারা এই প্রথমবারের মতো স্ত্রীদের সঙ্গে তাদের যোগাযোগের একটা অভাব অনুভব করলেন। বেগম রোকেয়া, সিমোন দ্য বোভেয়ার গলা তুলেছেন, প্রতিবাদ করেছেন, ধরেছেন নারী মুক্তির ঝান্ডা। পরিবর্তন এসেছে, তথাকথিত সমতাও অর্জিত হয়েছে কিন্তু বাটখারাটা এখনো পুরুষেই হাতে। Equality এর থেকে balance-টা অনেক বেশি বাণিজ্যিক । তাই নারী উন্নয়ন যতটা না সামাজিক উন্নয়ন সাধন করছে তার চেয়ে বেশি সাহায্য করছে পুরুষতন্ত্রের বাণিজ্যিক প্রচারণায়।
আশেপাশের সবাইকেই তো দেখি নারীবান্ধব! তাহলে দেশে এতো নারী নির্যাতন করে কারা? আর কর্মক্ষেত্রে, শিক্ষাক্ষেত্রে নারীদের অবমাননা করেই বা কারা? অবশ্য balance তারা ঠিকই maintain করেন কথায় আর প্রচারে।
এখন আর নিজেকে নারী বলে আফসোস হয় না। সত্ত্বাকে ধারণ করে যে নারী কিনা হয় অন্তঃসত্ত্বা, সে নারীর সৃজনশীলতা নিয়ে সন্দেহের কোন অবকাশ নেই। এই নারীরাই পারবে সকল 'না' কে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে বুক ফুলিয়ে এগিয়ে চলতে। বাণিজ্যিকীকরণ হোক আর প্রচারণাই হোক এ সুযোগে নিজের গলাটা তো তুলতে পারছে। নিজেদেরকে নিয়ে ভাববার অবকাশ পাচ্ছে। শুধু দরকার চিন্তার আকাশটাকে একটুখানি প্রসারিত করবার। নিজের সৃজনশীলতাকে আরেকটুখানি জাগিয়ে নেওয়া ।
জাগো নারী জাগো বহ্নি-শিখা।
জাগো স্বাহা সীমন্তে রক্ত-টিকা।।
দিকে দিকে মেলি’ তব লেলিহান রসনা,
নেচে চল উন্মাদিনী দিগ্বসনা,
জাগো হতভাগিনী ধর্ষিতা নাগিনী,
বিশ্ব-দাহন তেজে জাগো দাহিকা।।
ধূ ধূ জ্ব’লে ওঠ ধূমায়িত অগ্নি,
জাগো মাতা, কন্যা, বধূ, জায়া, ভগ্নী!
পতিতোদ্ধারিণী স্বর্গ-স্খলিতা
জাহ্নবী সম বেগে জাগো পদ-দলিতা,
মেঘে আনো বালা বজ্রের জ্বালা
চির-বিজয়িনী জাগো জয়ন্তিকা।।
লেখক: অতিরিক্ত পুলিশ সুপার