লজ্জা কাটান, সচেতন হোন

প্রকাশ | ০১ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, ২২:১০ | আপডেট: ০১ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, ২২:১৬

-আমার ওইখানে ক্যান হাত দিবেন মানে! কিছুতেই হাত দেওয়া যাবে না। 
-চাচী তোমার জরায়ুমুখে কোন অসুখ আছে কিনা সেইটা দেখতেই হাত দিতে হবে। 
- না না কিছুতেই না! রোগ থাকুক! আপনারে হাত দিতে দিমু ক্যান। 
- চাচী আমরা তোমার মেয়ের মতো না? 
-না না কিছুতেই না!

ভায়া টেস্ট না করিয়ে চাচী দমাদম চলে গেলো। একের পর এক রোগী আসছে ভায়া টেস্ট করাচ্ছে না চলে যাচ্ছে। জরায়ুমুখের ক্যান্সারের প্রাইমারি টেস্ট করাবো তাদের জানানো হয়েছিল। কিন্তু যেই হাসপাতালের বেডে ঢুকছে, শুতে চাচ্ছে না, পেটিকোট তুলতে দিতে চাচ্ছে না, জরায়ুতে হাত দিতে দিচ্ছে না। কারণ একটাই লজ্জা!

শেষ অবধি তাদের ডাক্তার, পঞ্চায়েত নেতাসহ আমাদের ডাক্তার অদিতিদি এবং লাবণীকে এন্তার উঠানের মধ্যে বুঝানো হলো। অনেকেই লাইন ছেড়ে চলে গেলো। আবার দূর থেকে অনেকে শুনে এলোও। যারা থাকল তাদের মধ্যেও অনেকে বেডে এসে ফিরে যাচ্ছিল। একটাই কারণ জরায়ুমুখে হাত দিতে দিবে না কাউকেই!

বাইরে গিয়ে আমি আর আমাদের লোকাল হোস্ট খাইরুন মিলে চিৎকার করে বললাম, "আমাদের সময় নষ্ট কইরেন না! আমরা আপনার জরায়ুমুখে বড় রোগ আছে কিনা টেস্ট করব। শুয়ে পেটিকোট তুলে জরায়ুমুখে হাত দিব। যদি চান তো তাহলেই ঘরে ঢুকবেন।" ওখানে আমাদের আলোকিত আগামী টিমকে বলে দিয়েছি, টেস্টের কাগজ নাই হাতে মানে কোন কম্বল দেওয়া যাবে না। যারা টেস্ট করাবে তারাই কেবল কম্বল পাবে।

এসব সেট আপে কাজ হলো। একে একে দিদিরা, বৌদিরা, নানীরা চাচীরা এলো। শুলো। পেটিকোট তুলল। ডেডিকেটেড নার্স আপু সানজানা সাঞ্জু আর জোৎস্না গল্প করতে করতে টেস্ট করালো। ভ্যাজাইনা স্পেকুলাম দিয়ে টেস্ট করার সময় অনেকেই কেমন ভয় পেতে লাগল। আলাপ সালাপ করে শান্ত করে একে একে ২৫০ জনের ভায়া টেস্ট করালাম আমরা। বাকি ৫০ জনের কারো মাসিক চলছিল, কারো জরায়ুমুখ ১ ডিগ্রি, ২ ডিগ্রী বা তিন ডিগ্রী কলাপস, কেউ গর্ভবতী, কেউ একদমই বয়স কম! টার্গেট ছিল ৩০০ জন নারী চা শ্রমিকের ভায়া টেস্ট করাবো।

টার্গেট ফুলফিল হলো। ৩৫ জন পেলাম যাদের ভায়া টেস্টে স্ট্রংগলি পজিটিভ এসেছে। তাদের প্যাপস স্মিয়ার টেস্টের জন্য ব্যবস্থা নিচ্ছি। হয়তো অচিরেই আবার সাহায্য চাইতে আসব আমার সোশ্যাল নেটওয়ার্কের ভাইয়া আপু বন্ধুদের কাছ থেকে।

কিন্তু কেন নারীরা জরায়ুমুখে হাত দিতে লজ্জা পায়! এই ছোট্ট অঙ্গ নিয়ে লজ্জার সীমা নাই। ডাক্তারের কাছে দেখাতে লজ্জা, রোগ নির্ণয়ে লজ্জা, কথা বলতে লজ্জা! ১২ বছর বয়সেই বিয়ে হওয়া যাওয়া মেয়েদের জরায়ুমুখের সুস্থতা নিয়ে কোন হেলদোল নেই দেখে বিরক্ত হতে হতে ভাবছি, আসলেই কি দেশের ৫০% মেয়েও এই লজ্জা কাটাতে পেরেছে?

দেশের ৫০% মেয়ে কি তাদের জরায়ু নিয়ে ভাবে, জরায়ুমুখের অসুখ নিয়ে কনসার্ন্ড! নাকি খুব গোপন অঙ্গ ভেবে অগোচরে তুলে রেখে দেয়? তারা কি ভায়া করিয়েছে? তারা কি রেগুলার তিন বছর পর পর ভায়া করায়? দ্যাখে কি তার জরায়ু ঠিকঠাক আছে কিনা!

যদি তাই হয় তবে প্রতিবছর ৬০০০ করে নারী কেন এই ক্যান্সারে মারা যাবে! যে ক্যান্সার খুব সহজে ডিটেক্ট করা সম্ভব এবং মুক্তি পাওয়াও সহজ!

আমাদের লাইফস্টাইল অনেক ক্ষেত্রেই জরায়ুমুখের ক্যান্সারের কারণ হতে পারে! তাই নিয়মিত তিন থেকে ৫ বছর পরপর ভায়া করানোটা আমাদের কর্তব্য। ভায়া পজিটিভ এলে ঠান্ডা মাথায় গাইনীর ডক্টরের সঙ্গে যোগাযোগ করা প্রয়োজন। নিজের প্রজনন অঙ্গ নিয়ে লজ্জা পান, কিন্তু সুস্থতার দিকেও খেয়াল রাখেন।

গত ২১ থেকে ২৭ জানুয়ারি ছিল সার্ভিক্যাল ক্যান্সার এওয়ারনেস উইক। আমরা খুব লাকি যে, এবারে এই রকম একটা প্রোগ্রাম দিয়ে বছরকার যাত্রা শুরু করেছি। আমাদের টার্গেট চা বাগানের সব নারী শ্রমিককে ভায়া টেস্টের অধীনে আনা পাশাপাশি ভায়া পজিটিভদের প্রয়োজনীয় চিকিৎসা দেওয়া।

কিন্তু চা বাগানের নারীদের পাশে আমরা স্বেচ্ছাসেবক হয়ে আছি। কিন্তু দেশের সব নারীর পাশে এভাবে থাকা সম্ভব নয়। তাই আপুদের বলতে চাই, লজ্জা কাটান, ভায়া করুন, জরায়ুমুখের ক্যান্সার নিয়ে সচেতন হন।

কারণ পৃথিবীতে এইটিই দ্বিতীয় ক্যান্সার যেটাতে সবচেয়ে বেশি নারী মারা যান। কেবল একটু অসতর্কতার অভাবে! কেবল একটু লজ্জা লাগার কারণে! কেবল না জানার অভাবে।

মারজিয়া প্রভার ফেসবুক থেকে