আমরা গ্ল্যামারের সঙ্গী হই, লড়াইয়ের নয়

প্রকাশ : ২৫ নভেম্বর ২০১৮, ২৩:৩৫

ষষ্ঠ বারের মতো ৪৮ কেজি বিভাগে বক্সিং এ বিশ্বচ্যাম্পিয়ান হলেন মেরি কম। ইউক্রেনের প্রতিদ্বন্দ্বী হানা ওখোতাকে ৫-০ সেটে উড়িয়ে দিলেন মেরি। টিভির পর্দায় ঝলকটা দেখেই ভাবলাম, ফেসবুকে একটা অভিনন্দন বার্তা দিয়ে পোস্ট দিই। বুঝিয়ে দিই, আমি কতোটা আপ-টু-ডেট। 

খুলে ফেললাম ফেসবুক, ভাবলাম মেরি কমের ছবি দিয়ে লিখি  ‘যে যেখানে লড়ে যায়, আমাদেরই লড়া’। পরে কেমন জানি গ্লানিবোধ হলো! আসলে তো লড়াইয়ের সঙ্গী আমরা নই। আমরা জেতার সঙ্গী। আমরা কখনোই লড়াইয়ের পথে সহযাত্রী হতে পারিনা,পারি জয়ের ভাগীদার হতে। তাইতো জানতাম না কবে, কোথায় এই প্রতিযোগিতা শুরু হলো। জানতাম না জাস্ট আগের রাউন্ডে কাকে হারিয়েছেন মেরি কম। 

খবরকাগজে ছিলো খবর,কিন্তু উৎসাহ ছিল না তাতে। মেতে ছিলাম মহা নাগরিক আলাপ-চারিতায়। এইসব ভাবতে ভাবতে চ্যানেল ঘোরালাম,অন্তত একটু ক্লিপিং দেখি। এক ঝলক দেখলাম। আপার কাট, লোয়ার কাট,ফ্রি হিট গুলো যেনো আমাদের মুখেই পড়ছে। ওহঃ পাঞ্চ! সে কী জোর! দাঁড়াতেই পারছেন না প্রতিদ্বন্দ্বী। যারা ভাবে শক্তি মানে পৌরুষ, তারাও বক্সিং রিং এ মেরিকে দেখে থমকে গিয়ে দ্বিতীয়বার ভাববেন, আসলেই কী শক্তি মানে পৌরুষ! ঘুষিগুলি আছড়ে পড়ছিল তাদের মুখেও , যারা ভাবেন ঘর সংসার সন্তান সামলে আর কিছু করা যায় না। দেখিয়ে দিলেন তিনি মাতৃশক্তি কাকে বলে। যারা ভাবেন ৩৫ বছরে আর যাই হোক খেলায় সফল হওয়া যায়না। দেখালেন তিনি, চেষ্টা আর ইচ্ছা থাকলে বয়সটা শুধুই সংখ্যা মাত্র।

পুরস্কারের মঞ্চে তিনি পদক উৎসর্গ করলেন দেশবাসীকে। বললেন, যারা সবসময় আমায় সমর্থন করেন,উৎসাহ দেন,তাদের দিলাম এই পদক। ভাবছিলাম, উনি হয়ত জানেন না আমার মতো কতো মানুষ আছেন, যারা খবরই রাখেন না মেরির উঠে আসার দিনগুলির কথা। স্পন্সরের দরজায় দরজায় ঘুরে বেড়ানোর ইতিহাস, জানেন না কী প্রতিকূলতা জয় করে এই জায়গায় পৌঁছতে হয়েছে ওই পাহাড়ি কন্যাকে। তার বাড়ির খাড়াই পথের চেয়ে অনেক দুর্গম ছিলো সে পথ। আমরা জেনেছি কবে?তাকে নিয়ে সিনেমা বেরোনোর পর। এও জেনেছি তার চরিত্রে অভিনয় করার জন্য প্রিয়াঙ্কা চোপড়া যে পারিশ্রমিক নিয়েছিলেন তা মেরির সারা জীবনের রোজগারের ডবল এর বেশি।

ভাবা যায়! ভাবা যায়,কারণ আমাদের কাছে লড়াইয়ের চেয়ে গ্ল্যামারের দাম অনেক বেশি। তাই আমরা গ্ল্যামারের সঙ্গী হই, লড়াইয়ের নয়। এর পরেও তিনি পদক উৎসর্গ করেন দেশবাসীকে। আমরা গর্ব করি তার জয়ে,কিন্তু রোল মডেল করি গ্ল্যামারাস ক্রিকেটারদের। অখ্যাতির অন্ধকারে ডুবে যান মেরি কমরা। এরপরে কি আর গর্ব করা সাজে?

হ্যাঁ সাজে, কারন আজও অবহেলাকে উপেক্ষা করে আমাদের দেশে গড়ে ওঠেন মেরি কম। জয় করেন বিশ্ব। আকাশে উড়িয়ে দেন আমাদের পতাকা। যে জাতীয় সঙ্গীত বেজে ওঠে তা আমাদেরই জাতীয় সঙ্গীত। বুকের মধ্যে ঢেউ ওঠে তার ছন্দে কেউ না কেউ নতুন করে উঠে দাঁড়ানোর শক্তি পান তাকে দেখে। অবহেলিত মেয়েদের প্রেরণা দেন তিনি। তাকে নিয়ে গর্ব তো করতেই হয়। সোনার মেয়ে তোমায় সোনালী অভিনন্দন। মেরি কম, হামারি কম।

লেখক: শিক্ষক, হুগলী, পশ্চিমবঙ্গ।

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত