ভারতলক্ষ্মী সেহগল: ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের এক লড়াকু সেনাপতি

প্রকাশ : ২৪ অক্টোবর ২০১৮, ২১:০৫

মাথার ওপর দিয়ে সাঁ করে উড়ে গেলো একঝাঁক ফাইটার প্লেন। দূরে শোনা যাচ্ছে সেনাবাহিনীর কুচকাওয়াজের নির্দেশ। পড়ন্ত বিকেলে পশ্চিম আকাশ রাঙিয়ে সূর্য ঢলে পড়ছে সন্ধ্যের কোলে। পখির দল ফিরে আসছে গৃহের পানে।

নিজেদের গৃহ,ও আপনজনদের থেকে অনেক দূরে বার্মার রুক্ষ পাহাড়ের ওপর বসে সামরিক সাজে সজ্জিত দুই তরুন তরুণী। অস্তগামী সূর্যের পানে তাকিয়ে ছেলেটি মেয়েটিকে বলল,পারবে সারাজীবন আমার সাথে চলতে? ছোট্ট করে ঘাড় কাত করলো মেয়েটি। তার দীঘল চোখের পানে চেয়ে ছেলেটি জিজ্ঞাসা করলো, আমার চেয়ে ভালোবাসো আর কাউকে? যার জন্য আমাকে ত্যাগ করতে পারো? এবারও ঘাড় কাত করলো মেয়েটি। অস্ফুটে বলল,দেশের জন্য সব ছাড়তে পারি। ছেলেটি আলতো করে মেয়েটির হাত দুটো ধরে বলল, এক স্বাধীন দেশ উপহার দেবো তোমায়। মেয়েটি বলল না, দেশ থাকুক সবার। আমি চাই শুধু......। সন্ধ্যের আকাশের নিচে কতো সংকল্প লেখা হলো নীরবে।

ছেলেটি বলল চলো, ক্যাপ্টেনকে বলি আমাদের পরিকল্পনা। মাথা নিচু করে মেয়েটি বলল, না তা হয়না। যিনি দেশের জন্য চাকরি, কংগ্রেসের সভাপতির পদ, পরিবার, এমনকি দেশও ছেড়ে দিলেন, মৃত্যুকে আলিঙ্গন করতে উদ্যত হলেন। তার সংকল্পের সামনে নিজেদের জীবন নিয়ে ভাবাও পাপ। স্বপ্ন থাক বুকের ভিতর, পরম যত্নে। আগে দেশবাসীর স্বপ্ন পূরণ করার পণ নিই। বন্দুক তুলে নিলেন দুজনে। ফিরে চললেন কুচকাওয়াজের শব্দ লক্ষ্য করে।

কে এই কন্যা? ঘর বাঁধার আগে দেশকে বাঁধন মুক্ত করার স্বপ্ন দেখেন যিনি। তার নাম লক্ষ্মী স্বামীনাথন।

প্রথম জীবন: লক্ষ্মী স্বামীনাথন মাদ্রাজের এক উদার সমাজসেবী পরিবারের কন্যা। ছোট থেকেই অত্যন্ত মেধাবী আর সমাজদরদী। মা ছিলেন স্বাধীনতা সংগ্রামী এবং সমাজকর্মী। তাই মায়ের আদর্শ অনুপ্রেরনা যুগিয়েছিল তাকে।

শিক্ষা জীবন: লক্ষ্মী ১৯৩৮ সালে মাদ্রাজ মেডিকেল কলেজ থেকে ডাক্তারি পাশ করলেন। এরপর পি রাও নামে এক পাইলটকে বিবাহ করেন এবং পরে বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটে। ভাগ্যদেবী বোধহয় তাই চেয়েছিলেন। তা না হলে তো অসমাপ্ত থেকে যেতো ওই প্রেম কাহিনী, অসমাপ্ত থেকে যেত ডাক্তার লক্ষ্মী থেকে ক্যাপ্টেন লক্ষ্মী হয়ে ওঠার ইতিহাস, অসমাপ্ত থেকে যেতো সুভাষচন্দ্রের ঝাঁসির রানী বাহিনী।

কর্ম জীবন: ভগ্নহৃদয়ে তিনি নিজেকে নিয়োজিত করেন আর্তের সেবায়। সেই সময় চাকুরী মিলল সিঙ্গাপুরের হাস্পাতালে। ঘরকে বিদায় দিয়ে তিনি চললেন সিঙ্গাপুর। ২য় বিশ্বযুদ্ধে ১৯৪২ সালে জাপানের হাতে পতন হলো সিঙ্গাপুরের। হাসপাতালগুলিতে তখন আহত যুদ্ধবন্দিদের ভিড়। তাদের অধিকাংশই ভারতীয়। ব্রিটিশের সেনাবাহিনীতে যুদ্ধ করতে এসে বন্দী। ব্রিটিশ ঝেড়ে ফেলেছে নেটিভ সৈন্যদের সব দায়।

অসহায় বন্দীদের মধ্যে ধিকধিক করে জ্বলছে ক্ষোভের আগুন। ব্রিটিশের বিরুদ্ধে লড়তে চায় তারা। শিক্ষা দিতে চায় ব্রিটিশকে ।সেই সময় দক্ষিণপূর্ব এশিয়ায় জাপানের হাতে বন্দী ভারতীয়দের নিয়ে সেনাদল গঠনের উদ্যোগ নিচ্ছেন রাসবিহারী বসু,ক্যাপ্টেন মোহন সিংরা। চিকিৎসার সাথে সাথে ভারতের মুক্তির জন্য বন্দী সেনাদের উৎসাহিত করতে শুরু করেন লক্ষ্মী।

রাজনৈতিক জীবন: এরপর দ্রুত পট পরিবর্তন হতে থাকে রাজনীতির। ১৯৪৩ এর জুলাই মাসে সুভাষচন্দ্র সিঙ্গাপুরে আসেন এবং আজাদ হিন্দ বাহিনীর দায়িত্ব তুলে নেন নিজের হাতে। ঢেলে সাজান বাহিনীকে। কূটনৈতিক দক্ষতায় আদায় করেন জাপানের সাহায্য। তিনি দেখেন দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার প্রচুর নারী যুদ্ধে যোগদানে আগ্রহী।কিন্তু নারী বাহিনী গড়লেই তো হবেনা।দেশপ্রেম বা আবেগ দিয়ে যুদ্ধজয় হয়না। চাই সঠিক প্রশিক্ষন, চাই যোগ্য নেত্রী বা সেনাপতি।

নারীবাহিনীর পরিকল্পনার খবর গেলো লক্ষ্মীদেবীর কানে। তিনি এগিয়ে এলেন, যোগাযোগ করলেন সুভাষচন্দ্রের সাথে। ডাক্তারি অ্যাপ্রন ছেড়ে সজ্জিত হলেন সামরিক পোশাকে,সার্জারি ছুরি ছেড়ে হাতে নিলেন বেয়নেট। ডাক্তার লক্ষ্মী হয়ে উঠলেন ক্যাপ্টেন লক্ষ্মী। দ্রুত শিখে নিলেন বন্দুক চালানো, ঘোড়ায় চড়া, পাহাড় বেয়ে যুদ্ধ করার কৌশল। তার আহ্বানে সাড়া দিয়ে,আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে নারীরা যোগ দিতে লাগলেন আজাদ হিন্দ বাহিনীতে।

১৯৪৩ এর ২১শে অক্টোবর জাপানের অনুমোদনে সিঙ্গাপুরে গঠিত হলো আজাদ হিন্দ সরকার। নেতাজী হলেন তার প্রধানমন্ত্রী। পরদিন ২২শে অক্টোবর তিনি গড়ে তুললেন ঝাঁসির রানী বাহিনী। যার সেনাপতি হলেন লক্ষ্মী স্বামীনাথন। এশিয়ার প্রথম নারী বাহিনীর সেনাপতির দায়িত্ব কী মুখের কথা। প্রশিক্ষণ চলতে লাগলো জোর কদমে। লক্ষ্মীর প্রেরণায় উৎসাহে বাহিনীর প্রতিটি নারীই তখন ঝাঁসির রানী। দেশ মুক্তির আদর্শে অবিচল।

দেশপ্রেমের এই উত্তাল সাগরের মাঝে আরেক প্রেম বাসা বাঁধলো লক্ষ্মীর হৃদয়ে। আজাদ হিন্দের এক সেনাপতি প্রেম কুমার সেহগল তিনি। পাথরের মাঝেও ফুটল ফুল। সেই এক নিভৃত সন্ধ্যায় অঙ্গীকার করলেন একসাথে চলার। কিন্তু সবার আগে দেশ, সবার ওপরে নেতাজী। তার স্বপ্নকে সফল করতেই হবে।

১৯৪৪ সাল। রেঙ্গুনে প্রবেশ করলো বাহিনী। নেতাজীর দুই বিশ্বস্ত অনুচর প্রেম সেহগল ও ক্যাপ্টেন লক্ষ্মী সাফল্যের সঙ্গে নেতৃত্ব দিতে লাগলেন আজাদ হিন্দের দুই শাখা আজাদ ব্রিগেড ও ঝাঁসির রানী ব্রিগেডের। বিপদ সংকুল পথ, ব্রিটিশ বাহিনীর গোলাগুলির সামনে লড়াই করার মাঝেও চার চোখের মিলন হয়,একটু হাসি,অনেকটা ভরসা আর স্বপ্ন বোনা হয় সবার অলক্ষ্যে। বিশ্বযুদ্ধে আমেরিকা যোগ দেওয়ার সাথে সাথে ইউরোপে মিত্রপক্ষ সাফল্য লাভ করতে থাকে। জার্মানি ইতালি পরাজয়ের মুখে পৌঁছে যায়। সেই সুযোগে ব্রিটিশ বার্মাতে নতুন করে সমরসজ্জা করে। প্রবল আক্রমনে পিছু হটে আজাদ হিন্দ ফৌজ।

নেতাজী ডাক দেন রেঙ্গুন ছেড়ে দিল্লি চলো। প্রবল উৎসাহে মনিপুর সীমান্তে ঢুকে পড়ে আজাদি সেনা।চলে প্রচণ্ড লড়াই। এবারে পরাজিত হতে থাকে ইংরেজ বাহিনী। প্রতিরোধ গুঁড়িয়ে দখল করে মনিপুরের বিস্তীর্ণ অঞ্চল। ১৪ ই এপ্রিল ১৯৪৫, মনিপুরের কোহিমার কাছে মৈরাং গ্রামে উড়িয়ে দেন তিরঙ্গা পতাকা। ভারতের অভ্যন্তরের অন্তত ১৫০ কিমি অঞ্চলের মানুষ স্বাধীনতার স্বাদ পায়। সেদিন সন্ধ্যায় দুজনের কথা হয় চোখে চোখে,বলতে চাওয়া আর বেশি দেরি নেই। আবার চলে যুদ্ধ, নতুন উদ্যমে। এর মধ্যেই আসে মে মাসের সেই কালো দিন। অন্ধকার গ্রাস করলো যেন ক্যাপ্টেন সেহগলের জীবনকে। ইংরেজদের হাতে বন্দি হলেন লক্ষ্মী। ইংরেজরা তাকে বন্দী করলো, নিয়ে গেলো বার্মার কারাগারের অন্ধকারে।সেহগল অনেক চেষ্টা করলেন, কিন্তু কোন খবর নেই।এদিকে যুদ্ধ ছেড়ে যাবারও উপায় নেই। স্বাধীন দেশ উপহারের সংকল্প মনে পড়ে যায়। চোখ ভিজে আসে অজান্তেই।

বার্মার কারাগারে নির্যাতনে জর্জরিত হতে থাকেন লক্ষ্মী। দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করেন সব। আশায় দিন গোনেন আজাদ হিন্দের চূড়ান্ত জয়ের খবর আসবে। তাকে নিতে আসবে তার প্রেম। এদিকে বর্ষায়, রোগ ও পোকার আক্রমণে, ব্রিটিশের প্রতিরোধে দিশাহারা হয়ে পড়ে বাহিনী। বহু সেনার মৃত্যু হয়। অবশেষে জাপান পরাজিত হলে আত্মসমর্পণ করে আজাদী বাহিনী। কারাগারে বসে পরাজয়ের খবর, নেতাজীর ঘোষিত মৃত্যুসংবাদ শোনেন লক্ষ্মী। দুঃখে ভেঙে পড়েন। জীবনের সব স্বপ্ন চুরমার হয়ে যায় তার। খবর পান আজাদী সেনাপতিদের মৃত্যুদণ্ড নিশ্চিত। বিচার হবে লালকেল্লায়।

১৯৪৬ এর ফেব্রুয়ারি মাসে তাকেও বার্মা থেকে দিল্লীতে আনা হয় বিচারের জন্য। দেখতে পান সেহগল কে। চেহারা ভেঙে গেছে। মাথা নিচু করে ফেলেন লক্ষ্মী। সেহগল বলেন, আমরা হারিনি। দেশ আজ জেগে গেছে নেতাজির মন্ত্রে। দিকে দিকে আজাদী সেনাদের সমর্থনে উত্তাল হয় দেশ। লাহোর-ঢাকা-কলকাতা তিন শহরই অচল হয় ছাত্র বিক্ষোভে। বম্বে থেকে করাচি নৌ বিদ্রোহ ছড়িয়ে পরে দিকে দিকে। কেঁপে যায় ইংরেজ। তৎপর হয় ভারত ত্যাগের জন্য। মুক্তি পান আজাদী সেনাপতিরা। যখন ভারতের স্বাধীনতা কেবল সময়ের অপেক্ষা তখন লক্ষ্মী বাঁধা পড়েন প্রেমের বন্ধনে, পবিত্র বিবাহ বন্ধনে। অনেক বাধা বিঘ্ন কারাগারের অন্ধকার পেরিয়ে ঘর পেলেন লক্ষ্মী।

কিন্তু এ লক্ষ্মী তো গৃহলক্ষ্মী নন। ইনি ক্যাপ্টেন লক্ষ্মী। সুভাষের আদর্শে দীক্ষিতা। তাই তিনি বারবার ছুটে গেছেন দেশের টানে, অসহায় পীড়িত মানুষের টানে। দেশভাগের ফলে সব হারানো মানুষদের পাশে দাঁড়ান। তাদের উন্নয়নের জন্য অর্থ, শ্রম, চিকিৎসাবিদ্যা সর্বস্ব দিয়ে সাহায্য করেন।

সমাজতন্ত্রের চেতনা বুকে নিয়ে ১৯৭১ সালে কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য হন ও রাজ্যসভার মেম্বার হন। শ্রমিক ও নিপীড়িত মানুষের জন্য সোচ্চার হন সংসদে। ভুপালের গ্যাস দুর্ঘটনার সংবাদ পেয়ে ছুটে যান সেখানে। চিকিৎসক দলকে নেতৃত্ব দিয়ে বহু মানুষের প্রান বাঁচান। শিখবিরোধী দাঙ্গার সময় মৃত্যুভয় তুচ্ছ করে ছুটে যান কানপুরে। সম্প্রীতির পরিবেশ ফেরাতে প্রচার চালান।

মৃত্যু: লক্ষ্মী সেহগল এমন একজন,যিনি দেশকে স্বাধীন করেই ক্ষান্ত হননি । ক্ষুধা দারিদ্র অশিক্ষা সবের বিরুদ্ধেই লড়ে গেছেন জীবনভর। নেতাদের মূর্তি হয়, তাদের নামে স্কুল, কলেজ, রাস্তা,বিশ্ববিদ্যালয় কতো কী হয়। এর মধ্যেই ২০১২ সালের ২৩শে জুলাই নীরবে চলে যান তিনি এই পৃথিবী ছেড়ে। আমরা জানতেই পারিনা সেই খবর।

জীবন,যৌবন, দেশের জন্য সব অকাতরে বিলিয়ে দেবার পর নিজের দেহটিও দান করে যান হাসপাতালে। সব দিয়েও তিনি থেকে যান বিস্মৃতির অন্ধকারে। দেশ মনে রাখেনি তাকে। ২৪শে অক্টোবর তার জন্মদিন। যখন বাঙালির ঘরে ঘরে লক্ষ্মীপূজার আয়োজন চলছে, তখন আমরা স্মরন করি সেই লক্ষ্মীকে। যিনি দেবী নন, ক্যাপ্টেন লক্ষ্মী সেহগল। জন্মদিনে শ্রদ্ধা জানাই এই মহান দেশপ্রেমিককে। জয়হিন্দ।

লেখক: শিক্ষক। 

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত