মধ্যপ্রাচ্যে নারীকর্মীর কান্না

প্রকাশ : ২৬ জুলাই ২০১৮, ১৬:১০

দেবাশিস সরকার

দারিদ্র্য থেকে মুক্তি আর কিছুটা আর্থিক সচ্ছলতার আশায় মানুষ নিজের পরিবার, দেশ ছেড়ে কাজের খুঁজে ভিন্ন দেশে পাড়ি জমায় অনেক স্বপ্ন নিয়ে। এ রকমই এক স্বপ্নের দেশ সৌদি আরব। অনেক ধনী দেশ। সামান্য কাজ পেলে টাকার কোনো অভাব থাকবে না। দালালরা মিথ্যা প্ররোচনা আর আর্থিক সুবিধার লোভ দেখিয়ে, যতটা না ব্যয় তার চেয়ে বেশি খরচ করিয়ে, জমিজমা বিক্রি করিয়ে কিংবা ঋণের টাকা দিয়ে বিদেশে পাঠাচ্ছে আমাদের সহজ-সরল নারীদের। কিন্তু এ কেমন যাওয়া? সবকিছু হারিয়ে ফিরে এলেও তাদের হারানোর করুণ গল্প আর শেষ হয় না। 

আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) হিসাবে মধ্যপ্রাচ্যে গৃহকর্মীর সংখ্যা প্রায় ২১ লাখ। অস্ট্রেলিয়ার নিউজডট কম (মে, ২০১৮)-এর তথ্যমতে, দশ লাখেরও বেশি নারী গৃহকর্মী সৌদি আরবে কাজ করছে। ইন্দোনেশিয়া, শ্রীলংকা, ইন্ডিয়া, বাংলাদেশ, ইথিওপিয়ার মতো দেশ থেকে নারী শ্রমিকদের সাধারণত সৌদিতে গৃহকর্মী হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে। বাংলাদেশের প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, ৭ লাখের বেশি নারীকর্মী বিদেশে কাজের জন্য আছে। যার মধ্যে প্রায় আড়াই লাখ সৌদি আরবে নারীকর্মী হিসেবে কর্মরত আছে। 

নারী গৃহকর্মী নির্যাতন বিশ্বের বিভিন্ন দেশে চলছে। সংবাদপত্রে প্রকাশিত তথ্য থেকে জানা যায় যে, হংকংয়ে তাদেরকে নির্যাতন করা হচ্ছে, অস্ট্রেলিয়াতেও ১৬ ঘণ্টার বেশি কাজ করানোর অভিযোগ আছে, ইংল্যান্ডে গৃহকর্মীদের একা বাইরে বের হতে দেওয়া হয় না। বিশ্বে প্রায় অর্ধেক গৃহকর্মী কোনো সাপ্তাহিক ছুটি পায় না, নিয়োগদাতারা বেশি সময় গৃহকর্মীদের কাজে লাগিয়ে এবং ঠকিয়ে প্রায় আট বিলিয়ন ডলার আয় করছে। ২০১৬ সালে সংবাদপত্রে প্রকাশিত এক খবরে দেখা যায়, ভারতের এক নারীকে সৌদি আরবে ভিসার মেয়াদ শেষ হওয়ার পরও অবৈধভাবে চাকরিদাতা মালিক জোর করে রেখে দেয় এবং অনেক অত্যাচার করে। তাকে ঘর থেকে বের হতে দিত না, খাবার দিত না। অমানুষিক অত্যাচারের কারণে তাকে এক পর্যায়ে হাসপাতালে ভর্তি করা হয় এবং কিছু দিন পর চিকিৎসাধীন অবস্থায় সেই নারী মারা যায়। 

বাংলাদেশের নারীকর্মীদেরও ভয়াবহ নির্যাতনের কথা এখন আমরা সবাই প্রতিদিন শুনতে পাই। শারীরিক নির্যাতন, যেমন- গরম কিছু দিয়ে ছ্যাঁকা দেওয়া, বৈদ্যুতিক শক দেওয়া, গৃহকর্মীদের দ্বারা অতিরিক্ত সময় কাজ করিয়ে নেওয়া, পাসপোর্ট রেখে দেওয়া, খাবার খেতে না দেওয়া, যৌন নির্যাতন করার পাশাপাশি মানসিক নির্যাতন তো একটা নিত্যদিনের ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। অন্যদিকে নিয়োগকর্তার অনুমতি ছাড়া চাকরি ছাড়াও যাবে না আবার দেশেও ফেরত আসা যাবে না। নিয়োগদাতার অনুমতি ছাড়া অন্য কোথাও কাজ করতে গেলে জরিমানা থেকে শুরু করে এমনকি গৃহকর্মীর নিজ দেশেও পাঠিয়ে দেওয়া হয়। এসব কারণে নির্যাতনের মাত্রা অনেক। তাছাড়া কর্মী-মালিকের বিরুদ্ধে অভিযোগ দাখিল করতে গেলে কর্মীর বিরুদ্ধে তখন চুরির দায়ে মামলা করা হয়। গৃহকর্তারা যখন নির্যাতন করে তখন আসলে সেসব নির্যাতনের রেকর্ড রাখাটা খুবই কঠিন। কারণ এগুলোর বেশিরভাগই ব্যাক্তিমালিকানাধীন বাড়িতে করা হয়ে থাকে। ২০১৮ সালের মে মাসে মিডল ইস্ট আই নামক এক অনলাইন নিউজপোর্টালে বাংলাদেশি নারীদের সৌদি আরবে নির্যাতনের বিষয়ে এক রিপোর্ট প্রকাশ করা হয়, যেখানে ছবিসহ নারী নির্যাতনের ঘটনা বর্ণনা করা হয়। সিএনএন, বিবিসি, হাফিংটোন পোস্ট, হিউম্যান রাইটস ওয়াচের মতো মানবাধিকার সংস্থাগুলো নিয়মিত রিপোর্ট করে যাচ্ছে সৌদির গৃহকর্মীদের এই নির্যাতনের কথা নিয়ে; কিন্তু এতে তেমন কাজ হচ্ছে বলে মনে হচ্ছে না।

এখন প্রতিমাসে বাংলাদেশে শত শত নির্যাতিত নারী ফেরত আসছে। এই বিষয়টি আসলে এখন নারী নির্যাতনের সীমা ছাড়িয়ে দেশের জন্যও অপমানজনক হয়ে গেছে। সৌদিরা জানে যে, আইনগতভাবে কিছু করা যাবে না তাদের বিরুদ্ধে। আমাদের দেশটাকেও এ ধরনের আচরণের দ্বারা তারা যথেষ্ট অপমান করে যাচ্ছে। তবে নির্যাতন বাড়ার ফলে যে নারী শ্রমিক যাওয়ার সংখ্যা কমবে, সেটা হয়তো না। কারণ অনেক নারী শ্রমিক এসব নির্যাতনের কথা জানে না। মিডিয়াতে যেভাবে প্রচার হচ্ছে, সেটা নারী শ্রমিক পর্যন্ত যে পৌঁছাবে সেটা খুব সহজভাবে বলা যাবে না।

প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের দিক থেকে এ ধরনের নির্যাতনের বিষয়কে পুরোপুরি গ্রহণ করা হচ্ছে না। বলা হচ্ছে, তারা খাপ খাওয়াতে পারছে না অথবা অধিকাংশই দেশে এসে গল্প বানাচ্ছে। তবে এ কথা ঠিক যে, খাপ খাওয়ার বিষয়টা অনেকটাই গুরুত্বপূর্ণ। কেননা বিভিন্ন দেশের কাজের সাংস্কৃতিক বিষয়গুলো ভিন্নরকম। আমাদের দেশের নারী শ্রমিকরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই হয় অল্প শিক্ষিত। তবে এটা অজুহাত হতে পারে না। খাপ খাওয়াতে না পারার মানেই কি নির্যাতন সহ্য করা? মোটেও না।

এ বছরের ৩১ মে জাতীয় প্রেস ক্লাবে সৌদি গৃহকর্মীর ওপর নির্যাতনের প্রতিবাদে এক সংবাদ সম্মেলনে ভয়াবহ নির্যাতনের বিস্তারিত বর্ণনা দেওয়া হয়। অনেক সুপারিশ বাস্তবায়নের কথা বলা হয়; কিন্তু যে জিনিসটা খুব গুরুত্বপূর্ণ এবং সবচেয়ে ভয়ানক সেটা হচ্ছে যে, ফেরত আসা নারীদের তাদের পরিবার গ্রহণ করছে না- এ রকম খবর পত্রপত্রিকায় আসছে। এই ভয়াবহ সমস্যার সমাধান কী? অথচ চাকরি করে কিছু টাকা আয় করার মাধ্যমে পরিবারের সচ্ছলতা এনে দেওয়ার জন্য যে নারী তার দেশ-পরিবার ছেড়ে অচেনা এক দেশে পাড়ি দিয়েছিল, আজ তার সেই পরিবারেই তাকে নিগৃহীত হতে হচ্ছে। এর চেয়ে ভয়ঙ্কর আর কী হতে পারে! একজন নারী হিসেবে আমাদের সমাজে এমনিতেই অনেক ধরনের কষ্ট, বৈষম্য, সুযোগের অভাবের মধ্যে যেতে হয়। তার মধ্যে আবার এ ধরনের ঘটনা তাদের বেঁচে থাকার জন্যই হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাহলে দেখা যাচ্ছে, দেশে আসার পরও তারা পরিবার ও সমাজ থেকে বিচ্ছিন্নই থেকে যাচ্ছে। সৌদি-ফেরত নারীদের কষ্টের শেষ কোথায় তাহলে? দেশে এলেই কি কষ্ট শেষ হয়ে যাচ্ছে? এত সব নির্যাতন সহ্য করে যখন শান্তির জন্য যুদ্ধ করে নিজ পরিবারে ফেরত আসে, তখন এ ধরনের অনিরাপত্তা বাঁচার শেষ আশাটুকুও কেড়ে নেয়। 

নির্যাতিত নারীরা যখন বাংলাদেশের বিমানবন্দরে আসে, তখন আবার তাদের সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়, যেটা আবার ভিডিওতে ধারণ করে বিভিন্ন যোগাযোগমাধ্যমে প্রচার করা হয়। আর এ ধরনের প্রচারণা একদিকে যেমন ভুক্তভোগীর ব্যক্তিগত গোপনীয়তা ভঙ্গ করছে, ঠিক অন্যদিকে বিভিন্ন সামাজিক ও পারিবারিক দৃষ্টিকোণ থেকে তাদেরকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দিচ্ছে। তাই এ ধরনের প্রচারণার ক্ষেত্রে আমাদের আরও সচেতন হওয়া দরকার।

রেমিট্যান্স আমাদের অর্থনৈতিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে ব্যাপক ভূমিকা সবসময় রাখছে; কিন্তু সেটা কি আত্মসম্মান বিসর্জনের মাধ্যমে হতে হবে? রেমিট্যান্স আসার কারণে নারীদের আমরা এভাবে ঠেলে দিতে পারি না। যদি মনে করা হয় যে, এই ঘটনাগুলো সম্পর্কে চুপচাপ থেকে জাতির বৃহত্তর স্বার্থে মেনে নেওয়ার মাধ্যমে যে অন্যায় করা হচ্ছে, সেটা মেনে নেওয়া যায় না। সব হারানো নারীদের চিৎকারে ভেসে যাচ্ছে বিবেকের যত নদী। 

বিশ্বায়নের যুগে মানুষকে আর আটকে রাখা যাবে না। যেখানে চাকরির সুযোগ মিলবে, সেখানেই মানুষ যাবে। তাই আমাদেরও সেভাবেই প্রস্তুতি নিতে হবে। সমস্যার ধরনগুলো নিয়ে গবেষণা করতে হবে। প্রতিটি সমস্যার সম্ভাব্য সমাধান বের করার পাশাপাশি পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। সামাজিকভাবে সচেতনতামূলক প্রচারণা চালাতে হবে। সরকারের উচিত, নারীকর্মীরা যাতে বাস্তবভিত্তিক এবং সঠিক প্রশিক্ষণের সুবিধা পায়। ভিন্ন দেশের সাংস্কৃতিক বিষয়গুলো সম্পর্কে যাতে আরও বিশদ জানতে পারে এবং কীভাবে খাপ খাওয়াতে পারে, সেটা সম্পর্কে আরও বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়।

যেসব এজেন্সি নারীদের পাঠাচ্ছে, তাদেরকে আরও স্বচ্ছতার সঙ্গে কাজ করা নিশ্চিত করা প্রয়োজন। ব্যক্তিস্বার্থ না দেখে বরঞ্চ দেশের এবং আমাদের মাতৃসম্মানের কথা চিন্তা করেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে। এ ক্ষেত্রে সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে আরও নিবিড়ভাবে কাজ করতে হবে। শুধু অভিযোগ দাখিল করার ব্যবস্থা না করে তা সমাধানে কার্যকর ব্যবস্থাও নিতে হবে। ফিলিপাইন, ইন্দোনেশিয়া তাদের দেশের নারী শ্রমিক পাঠানোর ক্ষেত্রে কঠোর অবস্থান গ্রহণ করেছে, বাংলাদেশেরও করা উচিত। তাই এখন শুধু সৌদি কিংবা মধ্যপ্রাচ্যের বাজারের দিকে না তাকিয়ে অন্যান্য দেশেও নারীকর্মীদের নিরাপদে কাজ করার সুযোগ সৃষ্টি করে দিতে হবে।

সৌদিরা আমাদের দেশের মানুষের জন্য বিভিন্ন সময় অনেক ধরনের উপহার পাঠায়। কিন্তু আমরা চাই না আমাদের নারীকর্মীরা সৌদি আরবে চাকরি করার জন্য সারাজীবনের কান্না উপহার হিসেবে গ্রহণ করুক। তাই রাষ্ট্রকেই তার সম্মান ধরে রাখার কাজ করতে হবে।

লেখক: গবেষক
ইমেইল: [email protected]
প্রথম প্রকাশ: সমকাল, ২৫ জুলাই ২০১৮

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত