তাতে তো ইসলাম গোল্লায় যায়নি
প্রকাশ | ২৮ জুলাই ২০১৬, ১৮:০৭
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের এমএ প্রথম বর্ষের ছাত্রী আনোয়ারা দাদাকে সঙ্গে করে এসেছিলেন মুসলিম মহিলাদের ধর্মীয় এবং সাংস্কৃতিক জীবনচর্যা সংক্রান্ত একটি প্রোজেক্ট নিয়ে আলোচনা করতে। ওঁরা থাকেন রাজারহাট অঞ্চলে একটি গ্রামে। জানা গেল, ওঁদের গ্রামে একটি প্রাচীন মাজার আছে। সেখানে ফি বছর ওই পীরের জন্মদিন ও মৃত্যুদিনে হয় উর্স। এই উপলক্ষে পিরের মুরিদ বা নিবেদিতপ্রাণ অনুগামী এবং হিন্দুমুসলমান নির্বিশেষে তাঁর ভক্তেরা পীরের সমাধিতে চাদর চড়ান, ধূপ দেন, প্রদীপ বা মোমবাতি জ্বালেন। আর হয় দু’দিন ধরে গানের অনুষ্ঠান। আনোয়ারাদের পরিবারের কেউ গত কয়েক বছর ধরে ওই দরগা বা মাজারের চৌহদ্দি মাড়ায় না। কেন? আনোয়ারার জবাব: ‘পীরের মাজারে শ্রদ্ধা জানানো ‘শেরিকি’ (আল্লার সঙ্গে অন্য কাউকে শরিক করা), ঘোরতর বে-শরিয়তি, ইসলাম-বিরোধী। পিরপুজো তো বটেই, গান শোনা বা গাওয়াও ইসলামে নিষেধ।’
হাজার বছর ধরে পালিত আচার আর ধর্মের মৌলিক ধারণাগুলো কী ভাবে বদলে গেল, বলেছিলেন ওঁর দাদা মুনির। তাঁদের গ্রামে আসা তবলিগিদের কাছ থেকে পাওয়া ধর্মীয় শিক্ষা আর টিভিতে জাকির নায়েকের প্রবচন তাঁদের ইসলামে ‘হারাম’ থেকে দূরে থাকতে শিখিয়েছে। দু’টি আন্দোলন সবচেয়ে গভীর প্রভাব ফেলেছে মুসলমান সমাজে— তবলিগ জামাত আর জাকির নায়েক। তবলিগ জামাত হল মুসলমান সমাজের ‘শুদ্ধিকরণ’ আন্দোলন। বিশ্বের দেড়শোটি দেশে প্রায় পাঁচ কোটি তবলিগি প্রচারক রয়েছেন, পশ্চিমবঙ্গে জেলা থেকে গ্রাম স্তর পর্যন্ত তবলিগের সংগঠন। প্রচারবিমুখ এই সংগঠন প্রায় নিঃশব্দে কাজ করে। আচরণে এবং বিশ্বাসে মুসলমানকে ‘খাঁটি’ মুসলমান করে তোলার লক্ষ্যে এই আন্দোলনে হাজার হাজার শিক্ষিত মধ্যবিত্ত এবং উচ্চবিত্ত মানুষ শামিল। তাদের শিক্ষা— খাঁটি মুসলমানের পক্ষে গানবাজনার মতো ‘বেহুদা’ কাজ মোটে জায়েজ অর্থাৎ অনুমোদনযোগ্য নয়। পীরের দরগা বা মাজারে শ্রদ্ধা জানানো খাঁটি মুসলমান হয়ে ওঠার পথে অন্তরায়।
গান বন্ধ
আর একটি আন্দোলনের নাম জাকির নায়েক। ইতিপূর্বে আর কোনও ধর্মীয় আন্দোলন সম্ভবত মধ্য আয়ের বাঙালি মুসলমানকে এত গভীর ভাবে প্রভাবিত করতে পারেনি, জাকির নায়েক যা করতে পেরেছেন। জাকির নায়েক তাই বাঙালি মুসলমানের কাছে একটি আন্দোলনই বটে। মুসলমানের দৈনন্দিন জীবনের সমস্ত কিছু নিয়ে জাকির সাহেবের সুচিন্তিত মতামত রয়েছে। সঙ্গীত নিয়ে তাঁর মত হল, ‘গান বাদ্য আল্লার কাছ থেকে মানুষকে দূরে সরিয়ে নেয়। তাই আল্লার রসুল গান বাদ্য নিষেধ করেছেন। অধিকাংশ গানই বাস্তবতা থেকে দূরে। গানে থাকে আবেগ। যে যত আবেগ দেখায় সে ততই বাস্তবতা থেকে দূরে সরে যায়।’
ওই টেলি-মৌলানার ইংরেজি, উর্দু বা হিন্দি প্রভাষণ গ্রামের মানুষ বুঝতে পারবে না বলে তা বাংলায় ডাব করে প্রচার করা হয়। টিভিতে দেখলে মনে হবে যেন জাকির নায়েক স্বয়ং বাংলায় ইসলামি প্রবচন শোনাচ্ছেন। বাংলা ডাবিং এবং সম্প্রচার হয়ে থাকে বাংলাদেশ থেকে। পশ্চিমবঙ্গে এমন কোনও মুসলমান অঞ্চল নেই যেখানে টেলিভিশন দেখার পরিকাঠামো আছে কিন্তু ‘পিস টিভি’ পৌঁছয় না। ঘরে ঘরে ‘পিস টিভি’ দেখার ব্যবস্থা করে দেয় স্থানীয় কেবল ব্যবসায়ীরা। এখন জানা যাচ্ছে, এ দেশে পিস টিভির সম্প্রচারের কোনও লাইসেন্স পর্যন্ত নেই। পিস টিভির সম্প্রচার বাংলাদেশে বন্ধ করা হয়েছে, কারণ সে দেশের সরকার মনে করছে জাকির নায়েকের বক্তব্য তরুণদের জঙ্গি ইসলামের পথে নিয়ে যাচ্ছে। জাকির নায়েক নিয়ে এ দেশে সরকার এখনও কোনও চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি। পিস টিভির সম্প্রচার বন্ধ করে যে জাকির নায়েককে আটকানো যাবে না, তা বোধহয় দুই দেশের কোনও সরকারই এখনও বুঝতে পারেনি। পশ্চিমবঙ্গে জাকির নায়েকের টেলি-ভাষণের যে সংকলন-গ্রন্থ (বাংলা অনুবাদে) পাওয়া যায় তার বিক্রি সম্ভবত কোরানের থেকেও বেশি। তা ছাড়া বাংলাতেই জাকির নায়েকের ভাষণ এবং মন্তব্য সংবলিত লক্ষাধিক ওয়েবপেজ আছে। জাকির নায়েকের বাংলায়-ডাব-করা ইসলামের যাবতীয় ব্যাখ্যা এবং তত্ত্ব ইউটিউবে পাওয়া যায়। বহু বাঙালি মুসলমানের কাছে জাকির নায়েক এমন এক জন মানুষ যিনি জীবন ও সমাজের সব সমস্যার সমাধান খুঁজে দিতে পারেন ইসলামের ভিতর থেকে।
কেবল আনোয়ারার পরিবার নয়, বাংলার গ্রামে শহরে হাজার হাজার মুসলমান আনোয়ারাদের মতো করেই ভাবছে। আনোয়ারা হয়তো গান শোনা বা গাওয়া এবং পিরের দরগায় যাওয়ার ব্যাপারে নিশ্চিত সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে। কিন্তু অনেকেই মনে মনে অপরাধবোধে ভোগেন, ‘কী জানি, গান গেয়ে বা গান শুনে গুনাহ্ করছি না তো?’ এই বাংলায় কেউ হয়তো কখনও ফিসফিস করে বলেছিল, ‘গান হারাম’। সেই ফিসফিসানি কবে কানাকানি হয়ে আলোচনা থেকে নির্দেশ হয়ে উঠেছে। সেই নির্দেশ এখন হুঙ্কার হয়ে আছড়ে পড়ছে। এই নিষেধ কেবল ব্যক্তিগত বিশ্বাসেই আটকে নেই, তা প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতিও পেয়েছে। এ রাজ্যে মুসলমান পরিচালিত মিশন এবং অন্যান্য যে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো আছে তার অধিকাংশ জায়গাতেই গান গাওয়া বা শোনা নিষেধ। সেখানে হারমোনিয়াম, তবলা এবং সুরের প্রবেশাধিকার নেই। নাম করা এক মিশনের কর্ণধারকে এ নিয়ে প্রশ্ন করলে জবাব দেন, ‘মুসলমান সমাজের ধর্মীয় দানের টাকায় প্রতিষ্ঠান চালাই, এখানে গানবাজনা ঢোকাই কী করে!’ সুরহীন, সঙ্গীতবোধহীন ‘সফল’ মানুষ গড়ছেন এঁরা। বাংলাদেশের এক ব্লগার লিখেছিলেন, ‘ভাল মুসলমান আর হিংস্র মুসলমানের একটি পার্থক্য হল সাঙ্গীতিক মন থাকা ও না থাকা।’
হাজার বছর ধরে
বারো মাসে তেরো পার্বণের বাংলায় গান তার সাংস্কৃতিক আধার। হাজার বছর ধরে গ্রামের পথে একতারা বা দোতারা বাজিয়ে গভীর দার্শনিক গান গেয়েছে বাউল ফকিরেরা। আমাদের রাখাল, চাষি, মাঝি, সাপ ধরা বেদে থেকে ছাদ পেটানোর শ্রমিক পর্যন্ত প্রতিটি পেশা তার নিজস্ব মৌলিক গানে সমৃদ্ধ। জারি, সারি, মর্শিয়া গান বাংলার একান্ত ঐশ্বর্য। মানুষের প্রাণের গান কি ফতোয়া দিয়ে থামিয়ে দেওয়া যাবে!
দরগা এবং মাজার বিরোধী প্রচারও মাটি পাচ্ছে এ রাজ্যে। যে পিরেরা গ্রামে গ্রামে জলঅচল অপমানিত অত্যাচারিত অন্ত্যজ হিন্দুদের ইসলামে আশ্রয় দিয়ে সম্মানিত করেছিলেন, তাঁদেরই মৃত্যুর পরে সেই কবর ঘিরে গড়ে উঠেছিল এই সব দরগা বা মাজার। যাঁরা সেই পিরের মুরিদ, মাজারে গিয়ে পিরের কবর জিয়ারত তাঁদের কাছে পিতৃতর্পণের সমান। কিন্তু না, তা করা যাবে না। ইসলামের সালাফি মতবাদীদের নির্দেশ: কবর জিয়ারত চলবে না, কারণ তা মূর্তিপূজার নামান্তর। খাঁটি মুসলমান তো কাফেরদের মতো আচরণ করতে পারে না! পিরের দরগায় বা মাজারে হিন্দু-মুসলমান সবাই যায়। এই সব প্রচারের ফলে বহু দরগাতেই মুসলমান ভক্তের উপস্থিতি উল্লেখযোগ্য ভাবে কমেছে। এই সালাফি মতেরই প্রবক্তা এবং প্রচারক জাকির নায়েক।
সালাফি শব্দের আভিধানিক অর্থ অতীতচারিতা, বা পূর্বপুরুষকে নিঃশর্ত ভাবে অনুসরণ। যাঁরা সালাফি মতবাদ চর্চা করেন, তাঁরা ইসলামের নবি ও তাঁর সাহাবিদের অনুসৃত ইসলাম অনুসরণ করতে চান। তাঁদের মতে সেটাই ধর্মের সবচেয়ে নির্ভেজাল রূপ। সালাফিরা মনে করেন, বিধর্মীদের এমন কোন কিছু টিকিয়ে রাখা যাবে না যা মুসলমানের মনে শেরেক (পৌত্তলিকতা)-এর জন্ম দেয়। নিরাকার সাধনায় কোনও বাধা তাঁরা সহ্য করবেন না। তার মধ্যে যেমন আছে মক্কার কাবা, যার দিকে ফিরে বিশ্বের তাবৎ মুসলমান নামাজ পড়ে। মদিনায় মহম্মদের মসজিদটিও তাঁরা ধ্বংস করতে চান, কারণ তা মুসলমানকে আল্লা এবং মানুষের মাঝে তৃতীয় কোনও ব্যক্তির পূজায় লিপ্ত করছে। গত কয়েক বছরে কাশ্মীরে কয়েকটি দরগা ধ্বংস করার চেষ্টা করেছেন সালাফিরা। কেবল বিশ্বাসে নয়, পোশাকে, আচরণে হতে হবে নির্ভেজাল ইসলামের অনুসারী।
মারলে মারবে
তবু, এত কিছুর পরেও তো দেখি, বীরভূমের প্রত্যন্ত গ্রামে দশটি স্কুলপড়ুয়া মুসলিম কিশোরী মঞ্চে উঠে নাচ-গান-অভিনয় করে মায়েদের ওপর অত্যাচারের ছবি ফুটিয়ে তোলে অসামান্য দক্ষতায়, এটা জেনেই যে পাড়ায় ফিরলে মসজিদের মৌলবির কাছে শাস্তি পেতে হবে তাদের। এর আগেও সাজেদা, জলিমা, কুলসুম, তাহিরা একই বিষয়ে পথনাটিকা করে মৌলবির মার খেয়েছে। স্থানীয় মৌলবি, জাকির নায়েক বা সালাফিরা তবু এদের নিরস্ত করতে পারেনি। বাংলার মুসলমানকে এক ছাঁচে ঢালার এই চেষ্টা তো আজকের নয়, উনিশ শতকের ফরাজি ওয়াহাবি আন্দোলন সে চেষ্টা শুরু করেছিল। পারেনি। তার পরেও নামাজ পড়ে, রোজা রেখে, ধর্মের যাবতীয় আকিদা মেনেও পির, ফকির, আউলিয়া আর মারফতিতে মজে রয়েছে বাংলার মুসলমান। মুসলমান তো এক রকমের নয়, কত বৈচিত্র্য তার। বিশেষ করে বাঙালি মুসলমান। তাতে তো ইসলাম গোল্লায় যায়নি। আমার গ্রামের আরমান চাচারা এমনই সব মানুষ। এঁরাই তো সহজ মুসলমান, ‘মডারেট ইসলাম’-এর যথার্থ রক্ষক।
(মেয়েদের নামগুলি পরিবর্তিত)
সূত্র: আনন্দবাজার