জাফর ইকবাল, বেঁচে থাকুন ছাব্বিশ লক্ষ বছর

প্রকাশ : ০৮ মার্চ ২০১৮, ১৫:২৬

ভিকারুন কলি

এখন বিংশ শতাব্দি, এইসময় মানুষ জ্ঞান, বিজ্ঞান, চিন্তা-চেতনাকে নিয়ে গেছে বহুদূর। কিছুদিন পর পৃথিবী ছাড়িয়ে মানুষ হয়তো বসবাস করবে অন্য গ্রহে। যোগাযোগ বাড়বে অন্য কোন জীবনের সাথে। বেশিরভাগ পৃথিবীর মানুষদের জীবন অন্যরকম মাত্রা পাবে। তারপরও শুধু কিছু মানুষ রয়ে যাবে মধ্যযুগীয় সমাজের ধ্যান-ধারনা নিয়ে। ধর্মীয় অন্ধতা, মেধাশূন্যতা, কূপমণ্ডূকতায় অন্যের দাস হয়ে জীবন কাটাবে সেসব লোক। কেন জানি মনে শঙ্কা হচ্ছে বাংলাদেশ হচ্ছে সেই জাতি যারা দিনের পর দিন, বছরের পর বছর হয়ে যাচ্ছে মেধাশূন্য, বর্বর, আর কূপমণ্ডূক। তবে কি কবির কথাই সত্যি?-

এই মৃত্যু উপত্যকাই আমার দেশ
এই মৃত্যু উপত্যকা আমারই দেশ। 
অস্বীকার করে আর কতদিন?

নির্লজ্জতার পাহাড়ের নিচে 
চাপা পড়ে থাকা সুবিধাবাদের দেশপ্রেম
তুমি অস্বীকার করবে করো,
আমি দায় অস্বীকার করি না কোনদিন।

ঘাড়ের উপর আততায়ীর উদ্ধত
চাপাতির কসম,
চোখ বুজে থেকে এই প্রলয় হবে না শেষ
তার চেয়ে বরং একমত হও আগে
চিৎকারে বাজুক বাস্তবতার রেশ
বলো, এই মৃত্যু উপত্যকাই
আমার দেশ! আমার দেশ! আমার দেশ!

-- শাশ্বতী বিপ্লব

জনাব জাফর ইকবাল তো কেবল সাধারণ একজন শিক্ষক বা লেখক নন, তিনি জাতির বিবেক। মুক্তচিন্তার ধারক, ধর্মনিরপেক্ষতার পক্ষে একতাবদ্ধ, অসম্প্রদায়িকতার পক্ষে আপোসহীন একজন শিক্ষক। 

শুধুমাত্র দেশের মানুষকে, দেশকে ভলোবেসে তিনি বিশ্বের সেরা দেশের সবচেয়ে লোভনীয় চাকরী ছেড়ে বাংলাদেশে এসেছেন। তার মতো প্রথিতযশা একজন ব্যাক্তি সিলেটের মতো ছোট্ট শহরে নিজের আবাস গড়েছেন। তিনি টাকার লোভ করেননি, বিখ্যাত ইউনিভার্সিটির চাকরীর লোভ করেননি, চাকচিক্যময় জীবন চাননি। তিনি শুধু দেশকে ভালোবেসেছেন, দেশের মানুষের ভালোবাসা চেয়েছেন। এর বিনিময়ে ফয়জুলদের ভালোবাসা হচ্ছে চাপাতির কোপ, এবং কোপের আঘাতে তাকে ক্ষত-বিক্ষত করে হত্যা করা।

তিনি একজন কম্পিউটার বিশেষজ্ঞও বটে। বিদেশের অর্জিত, জ্ঞান, দক্ষতা তিনি অজ্ঞতায় আচ্ছন্ন জাতিকে দিয়ে যেতে চেয়েছিলেন বলেই আমেরিকার মতো উন্নত দেশের সুযোগ- সুবিধাকে পায়ে ঠেলে সিলেট শহরে ছোট্ট এপার্টমেন্ট পরিবারে আবাস গেড়েছিলেন। তোমরা যারা মোহাম্মদ জাফর ইকবাল কে হত্যা করতে চেয়েছ তোমাদের বলছি, তোমরা কি জান ডঃ মুহম্মদ জাফর ইকবালকে? কোন যুগের পৃথিবীতে বাস করো তোমরা? নিজের ভালো তো পাগলেও বুঝে, কিন্তু তোমরা তার চেয়েও অধম, কূপমণ্ডুক।

ফয়জুল কি জানে না তবে তিনি তো শুধু একজন শিক্ষকই নন, তিনি একজন বিখ্যাত লেখকও?

বাংলাদেশে ক'জন লেখক আছে তার মতো জনপ্রিয়? একজন মানুষ শুধু চাইলেই জনপ্রিয় লেখক হতে পারে না। তার জন্য লাগে প্রচন্ড মেধা, সৃজনশীলতা, সততা এবং আবেগীয় অনুভূতি। এধরনের সৃজনশীল, মেধাবী মানুষ যুগযুগ অপেক্ষার পর জন্মায়। তোমাদের মতো কিছু অর্বাচিন তার মতো একজন লেখকের লেখার অসামান্য যোগ্যতার কথাও ভাবলে না?

একইভাবে প্রায় দেড় দশক আগে বই মেলা থেকে ফেরার পথে ছুরির আঘাতে-আঘাতে বিধ্বস্ত হয়েছিলেন হুমায়ুন আজাদ। কোনোরকমে সুস্থ হয়ে ফিরে এসেও কদিন পর চলে গিয়েছিলেন না ফেরার দেশে। অভিজিৎ রায়ের এর মতো বিজ্ঞানমনস্ক গুণী লেখক ও চাপাতির কোপেই হত্যা করা হয়েছে। এসব গুণী, মেধাবী সৃজনশীল মানুষেরা দেশের অংহকার। এদের জন্ম কি প্রতিদিন হয়?

আমাদের দেশকে মেধাশুন্য করার জন্য কিছু মেধাহীন খুনীকে ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে চাপাতি হাতে। আমার প্রশ্ন সরকারের নিরাপত্তা বাহিনীর কছে, চারিদিকের কথিত নিরাপত্তা বেষ্টনির মধ্যে কী করে ঢুকে পড়ে ছদ্মবেশী আততায়ী? জাফর ইকবালের প্রতি হুমকি তো নতুন নয়। সাম্প্রদায়িকতা ও জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে কঠোরভাবে স্পষ্টভাষী জাফর ইকবাল বিভিন্ন সময়ে জঙ্গিদের হুমকি পেয়েছেন। তাহলে কি নিরাপত্তার নামে ভীষণ অরক্ষিত জীবনযাপনই করতেন তিনি? তার মৃত্যু তাহলে সময়ের ব্যাপার মাত্র?

যেদেশের খুনীদের নিজের জাতির পিতাকে হত্যা করতে হাত কাঁপে না, তাদের বংশধরেরা তো রয়ে গেছে। তাদের প্রেতাত্মারা এখনো ছড়িয়ে, ছিটিয়ে আছে বাংলার মাটিতে। প্রেতাত্মারা এখন সাধারন মানুষের মাথার মগজ খায়। ফয়জুল নামক এসব তরুণদের মাথা থেকে বিবেক বুদ্ধি, মমতা সব খেয়ে ফেলেছে তারা। এখন অন্তসার শূন্য ঐ মগজে বাস করে মধ্যযুগীয় বর্বরতা এবং অজ্ঞতা।

সূদুর প্রবাস থেকে শুধু একরাশ হতাশা, আর শঙ্কা নিয়ে দেশের জন্য কষ্ট পাই। সাত সমুদ্দুর তের নদীর পাড়ে বসে প্রিয় মাতৃভূমির জন্য মঙ্গলকামনা ছাড়া আর কি করতে পারি? তবু বলছি, প্রিয় লেখক, প্রিয় শিক্ষক আপনার জন্য একবুক ভালোবাসা আর শ্রদ্ধা। আপনি জাতির বিবেক, যেদিন বিবেককে হত্যা করা হবে, সেদিন জাতিও চাপাতির কোপে ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে। শুনেছি আপনার শরীরে ছাব্বিশটা সেলাই। প্রবাসী বাঙালিদের পক্ষ থেকে আমি প্রার্থনা করছি, আমাদের ভালোবাসায় আপনি ছাব্বিশ লক্ষ বছর বেঁচে থাকুন। ফয়জুলদের বিবেক জাগ্রত হোক, সেটা হলে আমাদের দেশও তখন বেঁচে যাবে অন্তিম আঁধার থেকে।

জাগরণীয়ার ইমেইল থেকে

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত