মানব মানবীর সম্পর্ক ও সম্পর্কের দায়

প্রকাশ : ২৭ জানুয়ারি ২০১৮, ২২:২৪

শামীম আরা নীপা

একটা সম্পর্ক দুইজন মানুষের ভেতর যখন ঘটে তার জন্য তারা দুইজনই দায়বদ্ধ থাকে। অনেকে জানতে চায়, কে আগে বলেছে/প্রপোজ করছে। আচ্ছা কে আগে বলেছে – এই কথাটা কি গুরুত্বপূর্ণ? এই প্রশ্নটা কেন করে কেউ? এই প্রশ্নগুলো করেই তো আগ্রহ না বরং কুট ক্যাচালের জন্ম দেয় তৃতীয় পক্ষগুলো। যে মানুষটা প্রপোজাল গ্রহণ করে সে সুপিরিয়র আর যে দেয় সে কি ইনফেরিয়র? সম্পর্কগুলো তো একমুখী হতে পারে না বরং যেকোনো অবস্থায় সম্পর্ক হয় উভয়মুখী। সেই ক্ষেত্রে কে আগে বললো আর কে পরে বললো তা খুবই অবান্তর। 

একটা মেয়ের একটা ছেলেকে ভালো লাগে কিংবা একটা ছেলের একটা মেয়েকে ভালো লাগে কিংবা ছেলে মেয়ে উভয়েরই পরস্পরকে ভালো লাগে – এখন তার পরের স্তরই তো তারা পরস্পরকে বলবে এবং সম্পর্ক এগুবে। কাউকে না কাউকে তো প্রথমে এই বলার পদক্ষেপটা নিতে হবে নইলে তো সব টাই টাই ফিশ হয়ে যাবে। এখন যদি মেয়েটা বলে ফেলে আগে তো সর্বনাশ! তার মানে ঐ মেয়ে বেশ্যা পর্যায়ের, ঐ মেয়ে ঐ ছেলেকে দিয়ে জোর করে প্রেম করিয়েছে, ঐ মেয়ে ছেলেকে ট্র্যাপ করে বিয়ে করেছে, ঐ মেয়ে ছেলের সাথে শুয়েছে – পুরাই বেশ্যা ছিনাল মেয়ে লোক – এমন যে আরো কত ব্যাটা লোকের সাথে শুয়েছে এবং শুবে তার কোন হিসাব আছে? – ছ্যা ছ্যা ছ্যা...

নারীদের কাছে জানতে মন চায় আপনারা প্রেম/বিয়ে করার আগে কয়বার এটা ভেবেছেন যে- ছেলেটা কয়বার কয়টা মেয়ের সাথে শুয়ে আসছে? আর পুরুষদের কাছেও জানতে মন চায় যে- আপনারা কয়বার প্রেম বিয়ের আগে এটা ভেবেছেন যে মেয়েটা কয়টা ছেলের সাথে শুয়েছে, চুমু খেয়েছে? একটা সময় মেয়েদের এমন ভাবার কোন অপশনই ছিলো না কিন্তু এখন হয়তো মেয়েরা এভাবে ভাবতে শিখেছে, বিচার করতে শিখেছে তাও রেশিওটা কমই হবে। অথচ এমন ভাবনা পুরুষকে অহরহই ভাবতে দেখে ক্লান্ত লেগেছে, উদ্ভট লেগেছে, ঘেন্না করুণাও লেগেছে! 

যোনীচ্ছেদ কত বড় ঘটনা তা এমন সমাজে বাস না করলে জানা যায় না। নারীর যোনীচ্ছেদ কতবার ঘটেছে এটা গুরুত্বপূর্ণ এই তথাকথিত আধুনিক সমাজেও, অথচ নারীর যোনীচ্ছেদ কতবার ঘটানো হয়েছে তা আড়ালে চলে যায় সমাজ ভূপতিদের প্রভাবে! আমার তো মনে হয়, মানুষ কেউই পশু না যে তার কোন বাছ বিচার বিবেক বোধ থাকবে না, ন্যায় বিচার থাকবে না। নৈতিক প্রশ্ন আসেই মানব তথা এই জীব সমাজকে সুন্দর ভাবে বাঁচিয়ে রাখার জন্য, ভারসাম্য রক্ষা করার জন্য, বিপর্যয় রোধ করার জন্য। মুক্ত চিন্তা মানে নিশ্চয়ই ঔদ্ধত্য অন্যায্য বোধ ও আচরণ না, কোন অসৌন্দর্য অমঙ্গলের আধার না।

দুইজন মানুষ যখন একটা পারস্পরিক সম্পর্কে জড়ায় তখন তাদের ভেতরের প্রতিটা আন্তরিক/জিঘাংসাপূর্ণ/রূঢ় আচরনের দায় সমানভাবে তাদের দুইজনের। এখানে কম বেশি বলে কোন কথা থাকতে পারে না। ছেলেটা যদি বলে- মেয়েটার প্ররোচনায় সে মেয়েটাকে চুমু খেয়েছে, প্রেমিকার সাথে লাভ মেইক করেছে তবে সে নিশ্চিন্তে ভণ্ড এবং মেয়েটাও যদি অমন সব কথা বলে থাকে তবে মেয়েটাও ভণ্ড।

এখন প্রেম ভালোবাসা যদি পরস্পরকে ইউজ করার নাম হয় তবে আমার কথাগুলো বলার আগেই খারিজ হয়ে যায়। প্রতারণার জন্যই যদি কেউ সম্পর্ক গড়ে তো সেই ক্ষেত্রে এক পক্ষ নিশ্চিত ভিকটিম কিংবা কেউই ভিকটিম না বরং ঐটা তাদের পারস্পরিক লেনদেন হতে পারে। মানুষ প্রেম করে বিয়ে করে তারপর হুট হাট করেই তাদের মতিভ্রম ঘটে কারণে বা অকারণে। তারা কেউ আর দায় বোধ করে না সম্পর্কের প্রতি, মানুষের প্রতি! মানুষ তো– হতেই পারে মতিভ্রম– এখানে গুরুত্বপূর্ণ হলো মতিভ্রমের বশবর্তী হয়ে কে কতটা ভনিতা করে। মন উঠে যায় তারপরও মানুষ অভিনয় করে। সমস্যাটা এখানেই। মন উঠে যায়, সত্য বলে সম্পর্ক থেকে নিজেকে উইথড্র করে নেয়া যায়– ঐটা অনেক ভালো সমাধান, এই সমাধানের ভেতরও সৌন্দর্য থাকে। কিন্তু মিথ্যাচার করা, অপমান অপদস্ত করাটা মানুষের মানবিক ও সামাজিক অবক্ষয়।

এ যাবতকাল শুনে আসলাম, এই সমাজের নারীরাই (তারা নিঃসন্দেহে বেশ্যা ছিনাল) ট্র্যাপ করে পুরুষকে বিয়ে করে নইলে সম্পর্ক করে। যেমন আদমের কোন দোষ ছিল না, হাওয়া জোর করে উনাকে গন্ধম ফল খাইয়ে দিলো! তার মানে সমাজে পুরুষ কতটা ঈদের চাঁদ সমতুল্য এবং কতটা সহজ সরল নির্দোষ তা না বুঝার কোন কারণ নাই। একজন নারীর ক্ষেত্রেও শুনলাম না যে পুরুষ তাকে ট্র্যাপ করে বিয়ে করেছে! নারী সেইরূপ সহজ সরল ঈদের চাঁদ সমতুল্য হতে পারেনি এখনো। এখন ধর্ষণের পর যে ছেলে মেয়েকে বিয়ে দিয়ে দেয়া হয় তা নিয়ে কেউ ত্যানা প্যাচাইয়েন না, এমন কথা মনে হলেই ঘেন্নায় শরীর গুলিয়ে বমি পায় আমার। প্রেমে ধরা খেয়ে অনেকের বিয়ে করতে হয়– সেটা নিয়েও কেউ ত্যানা প্যাচাইয়েন না। আপনি কতটা সাধু তা নিয়েও ত্যানা প্যাচাইয়েন না। আমি কেবল বাস্তবতার কথা বলছি, আমার চারপাশে দেখা এবং নিজের জীবন লব্ধ অভিজ্ঞতা থেকে কথা লিখছি।

প্রেম আর প্রতারণা এক বিষয় না। প্রেমের বিচ্ছেদ এবং প্রতারণাও এক বিষয় না। প্রেম কিংবা সম্পর্কের বিচ্ছেদে মানুষ কষ্ট পায় এবং পাবে। কখনো একজন মানুষই কষ্ট পায়, কখনো উভয়ই কষ্ট পায় আবার কখনো কখনো কেউই কষ্ট পায় না। সম্পর্কগুলো মানুষ জীবন দিয়ে যাপন করে, সময়গুলো যাপন করে তাই তা কখনোই ফেলনা নয়। যে কোনকিছু না ভেবে কেবল সময় কাটিয়ে যায় কোন কমিটমেন্ট ছাড়া তার কথা ভিন্ন। কিন্তু মানুষ নামের যোগ্য প্রাণীগুলো অবশ্যই পারস্পরিক সম্পর্ককে যাপন করে, দায় বোধ করে, দায়িত্ব নিয়ে জীবন যাপন করে। প্রেমের বিচ্ছেদ যতটা ব্যাক্তিগত, ঠিক ততোটাই উন্মুক্ত সার্বজনীন হলো প্রেমের প্রতারণা। কোন কারণে কিভাবে সম্পর্কে বিচ্ছেদ ঘটে তার উপর নির্ভর করে কিছু বাস্তব এনটিটি। প্রতারিত বোধ করা এবং সত্যিকার অর্থে প্রতারিত হওয়ার ভেতরও ব্যাবধান আছে। সম্পর্ক ছেদের মুহুর্তে আমরা প্রতারিত বোধ করতে পারি কিন্তু সময়ের সাথে বুঝতে পারি আদৌ সেটা প্রতারণা ছিলো নাকি ছিলো সময়ের দাবীতে এক নিছক বিচ্ছেদ মাত্র! অতি আবেগী হয়ে না ভেবে যদি সম্পর্কের প্রতি সৎ হয়ে ভাবা যায়, বিচার বিশ্লেষণ করা যায় তবে মানুষগুলো নিঃসন্দেহে বিচ্ছেদ আর প্রতারণার ফারাক করতে পারে। সৎ ব্যাক্তি সত্য স্বীকার করে এবং অসৎ ব্যাক্তি কুৎসা রটায়। প্রতারণা যদি সম্পর্কে হয়ে থাকে, ইনটেনশনালি যদি কেউ কাউকে ইউজ করে ধরা খায় তবে সেই পশুমানবের চরিত্র উন্মুক্ত করার ভেতর কোন পাপ কিংবা দ্বিধা নাই। প্রতারককে উন্মুক্ত করে সমাজ রক্ষা তো হয় বটেই, নিজে মরেও যে অন্যকে বাঁচাতে চায় সে আমার বিবেচনায় নমস্য।

কোন নির্দিষ্ট কিছু লিখতে বসিনি, সম্পর্কগুলো নিয়ে ভাবছিলাম- কতকিছুই তো লেখা যায়। একটা লেখা একবার ছেড়ে দিলে আর এগোয় না, সম্পর্কগুলোও কি সেইরকম? মনে হয় না। সম্পর্কের শেকড় তো অনেক গভীরে প্রোথিত, ছেড়ে যাওয়ার পরও ছেড়ে যায় না!

শামীম আরা নীপার ফেসবুক থেকে

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত