‘মি টু’: দিন বদলের পূর্বাভাস

প্রকাশ : ২৫ জানুয়ারি ২০১৮, ২০:৫৯

মালবী গুপ্ত

কখনো কখনো উচ্চারিত কিছু শব্দবন্ধ দেশ-কাল-সময়-এর গণ্ডী পেরিয়ে পৃথিবীর নানা প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ে। যে শব্দের অভিঘাত খুব সুদূরপ্রসারী হয়। যে শব্দের ব্যঞ্জনা অনেক সময় জীবনের অনেক গোপন সত্য উদঘাটনেও আমাদের সাহসী করে তোলে।

আমার মনে হয় ‘মি টু’ নিঃসন্দেহে তেমনই দুটি শব্দ। আসলে সেই ১৯৯৭ সালে সমাজকর্মী টারানা বার্ক যখন ১৩ বছরের এক কিশোরীর মুখে তার উপর যৌন নির্যাতনের অভিজ্ঞতার কথা শুনেছিলেন, তখনই তার বুকের ভিতর জন্ম নিয়েছিল ঐ ‘মি টু’।

পরে যৌন হিংসার বিরুদ্ধে তার প্রচার আন্দোলনের নামও বার্ক রাখেন ‘মি টু’ অর্থাৎ ‘আমিও’ যৌন হেনস্তার শিকার। তবে নিরবধিকাল ধরে মেয়েরা পৃথিবীর সর্বত্র যৌন হিংসার শিকার হলেও কৃষ্ণাঙ্গ বার্ক এর ২০০৬ সালে গড়ে তোলা ঐ আন্দোলনকে বিশিষ্ট শ্বেতাঙ্গ নারীবাদীরা অবশ্য পাত্তা দেননি দীর্ঘদিন। কোন সমর্থনই পায়নি তাদের। শেষ পর্যন্ত গ্ল্যামার ওয়ার্ল্ড হলিউডের বিখ্যাত সিনেমা প্রযোজক হারভে উইনস্টেইন-এর বিরুদ্ধে সম্প্রতি যৌন পীড়নের একাধিক অভিযোগ প্রকাশ্যে উঠে এলে ঐ‘মি টু’ শব্দ দুটি ছড়িয়ে পড়ে আলিসা মিলানোর হাত ধরে।

অভিনেত্রী আলিসা মিলানো যৌন হয়রানির বিরুদ্ধে গত অক্টোবরে #‘মি টু’শব্দ দুটি সোশাল মিডিয়ায় হ্যাশট্যাগ হিসেবে ব্যবহার করলে সঙ্গে সঙ্গে দাবানলের মতো তা ছড়িয়ে পড়তে থাকে। সেই থেকে কাজের জায়গায় যৌন হেনস্তার বিরুদ্ধে প্রচার অভিযান ও সেই প্রতিবাদী প্রচারে সমস্বর হিসেবে পৃথিবীর আনাচ কানাচ থেকে কেবলই বিরামহীন উঠে আসছে ‘মি টু’। 

আসলে চাষাবাদের কাজ হোক, মজুরের কাজ হোক, কিংবা চকচকে অফিস অথবা অন্য যেকোনো কাজের ক্ষেত্রই হোক, ধনী-দরিদ্র, সাদা-কালো নির্বিশেষেই পৃথিবীর সব দেশে সকল সমাজে যৌন পীড়নের ঘটনা নিরবচ্ছিন্নভাবে ঘটে চলেছে এবং সমীক্ষা থেকে উঠে আসছে যে, সেই হেনস্তার ৭৫% ই নথিভুক্ত হয় না। কারণ, কাজ হারানোর ভয় থাকে, প্রতিশোধ বা প্রতিহিংসার শিকার হওয়ারও ভয় থাকে। বলা বাহুল্য যে, নির্যাতিতার সেই ভয়ই নির্যাতনকারীর সাহসও বাড়িয়ে দেয়, তাকে ক্রমশ অদম্য করে তোলে।

তবে আমার মনে হচ্ছে ঐ ‘মি টু’ শব্দবন্ধের ওজন কেবলই ভারী হয়ে উঠছে। এতোটাই যে, তার ঘায়ে বিশেষত পাশ্চাত্যের শিল্প-সংস্কৃতির জগত, সরকারি-বেসরকারি নানা সংস্থা, সংবাদ মাধ্যম- এক কথায় সমাজের সমস্ত স্তরে অসংখ্য পুরুষ যেন আব্রুহীন হয়ে যাচ্ছে।

প্রাচ্যেও তার ঝাপটা এসে লাগছে। শিক্ষকদের বিরুদ্ধে ছাত্রীদের, নিয়োগকারীর বিরুদ্ধে নিযুক্তের অভিযোগের তীর যেন কেবলই ধেয়ে আসছে। কাজের জায়গায় বিশেষ করে পুরুষ নিয়ন্ত্রিত কাজে নিজস্ব ক্ষমতার অপব্যবহার করে,কখনো ভয় দেখিয়ে মেয়েদের প্রতি যারা অন্যায় যৌনাচরণ করছে, হঠাৎই যেন ওই ‘মি টু’আজ সেই সব নামী দামী ব্যক্তিদেরও কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে দিচ্ছে এবং শাস্তির  খড়্গ নেমে আসছে কারো কারো উপর।

মনে হচ্ছে যেন, ঐ ‘মি টু’ শব্দ দুটি অসংখ্য ভুক্তভোগী নারীর জীবনে এতদিনের এক অব্যক্ত যন্ত্রণার নৈশব্দকে ভেঙে আছড়ে ফেলছে পৃথিবীর নানা প্রান্তে। যার অভিঘাতে এখনও পর্যন্ত বোধহয় ৮৫ দেশের লক্ষ লক্ষ নারীর হৃদয়কে উদ্বেলিত করেছে, আন্দোলিত করেছে। নানা ক্ষেত্রে নানা সময়ে যাদের জীবনে যৌন লাঞ্ছনা, যৌন পীড়নের ঘটনা ঘটেছে, তারাই আজ #‘মি টু’র কাঁধে ভর করে, নিজেদের সেই হয়রানির কথা প্রকাশ্যে জানাচ্ছেন। নিজেরা একাত্মও বোধ করছেন পৃথিবীর কোটি কোটি সেই নির্যাতিতা মেয়েদের সঙ্গে।

তবে ইতিমধ্যেই কিছু নারীর অন্য স্বরও শোনা যাচ্ছে। হয়তো অনেকে মনে করছেন  ‘সেক্সুয়াল ফ্রিডম’বা যৌন স্বাধীনতায় ‘মি টু’ একটা অদৃশ্য হুমকি হয়ে উঠতে পারে। হয়তো অনেকে ভাবছেন, তাহলে তো পুরুষের সঙ্গে স্বাভাবিক মেলামেশাও বন্ধ হয়ে যাবে।

ফরাসি অভিনেত্রী ক্যাথরিন দ্যুনভ তো বলেছেনই, পুরুষরা ফ্লার্ট করলেও তো তাহলে তাকে শাস্তি দেওয়া হবে। ধর্ষণ অপরাধ, কিন্তু কেউ যদি নারীর মন জয়ের চেষ্টা করে সেটা তো তার অপরাধ নয়।- নিশ্চয়ই নয়। তবে মন জয়ের চেষ্টা এবং ধর্ষণ নিশ্চয়ই সমার্থক নয়। কারণ ধর্ষণে যে বলপ্রয়োগ, যে নিষ্ঠুরতা থাকে, নির্দোষ মন জয়ের চেষ্টায় তা থাকে না। তাছাড়া আমার তো মনে হয় মেয়েরা ঠিকই বোঝেন কোন স্পর্শ মন জয়ের, আর কোনটা পীড়নের।

একথা সত্য যে বিভিন্ন দেশে লক্ষ লক্ষ প্রান্তিক নারী কাজের জায়গায় যৌন লাঞ্ছনা ও পীড়নের শিকার হলেও আইনি সহায়তার নাগাল তারা বেশিরভাগই পান না। আমার মনে হয় যে, তাদের অনেকেই হয়তো বর্তমানে তীব্র আলোড়নকারী ঐ ‘মি টু’র স্বরে নিজেদের কণ্ঠস্বরও মিলিয়ে দেওয়ার সুযোগ পাবেন না।

তবুও সমাজের বিখ্যাত সব নারীদের জীবনে যে কোনো না কোনো সময়ে সেই অসম্মান ও নিগ্রহ ঘটেছে, কোনো না কোনো পরিস্থিতিতে অবাঞ্ছিত যৌনতার আগুনে তারা পুড়েছেন- ঐ ‘মি টু’ সেই সত্যের হঠাৎ উন্মোচন ঘটিয়েছে। যেন জীবনের অবরুদ্ধ গোপন লজ্জা, অপমান ও যন্ত্রণার জ্বালামুখটি নিজেদের হাতেই তারা হঠাৎই খুলে দিচ্ছেন।

আমার এও মনে হচ্ছে, আজ পাশ্চাত্যের গ্ল্যামার ওয়ার্ল্ড ও বিখ্যাত সব ব্যক্তিত্বের নাম সম্প্রতি বিষয়টির সঙ্গে জড়িয়ে যাওয়ায় বহু উপেক্ষিত দীর্ঘদিনের বিশ্বজনীন এই গভীর সমস্যাটির উপর এবার হয়তো অনেকটা আলো এসে পড়বে। যে আলো সমস্যা নিরসনে কোনো না কোনো পথের সন্ধান দেবে। আজ তাই দিগন্তে একটা নতুন দিনের সূচনা হচ্ছে।

সম্প্রতি গোল্ডেন গ্লোব অ্যাওয়ার্ড অনুষ্ঠানে জনপ্রিয় মার্কিন টিভি উপস্থাপিকা অপরাহ উইনফ্রের বক্তব্যটি যেন একটা বিশ্বাস জাগাচ্ছে। মনে হচ্ছে সত্যি কি তবে কাজের জায়গায় মেয়েদের জীবনে যৌন লাঞ্ছনা, যৌন নির্যাতনের ধারাবাহিকতার অবসানের একটা সম্ভাবনা এবার দেখা দেবে? পূর্ব দিগন্তে একটা দিন বদলের পূর্বাভাস কি তবে সত্যিই উঁকি দিচ্ছে?

লেখক: সাংবাদিক, কলকাতা।
সূত্র: বিবিসি

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত