উপার্জন নয়, জ্ঞানের সীমানাও প্রসারিত করতে হবে
প্রকাশ | ২০ জুলাই ২০১৬, ০৩:৪৬ | আপডেট: ০২ অক্টোবর ২০১৬, ১৬:২৭
শিক্ষা ও সংস্কৃতি পরস্পর সম্পর্কিত৷ শিক্ষা ও শিক্ষার বিভিন্ন অনুসঙ্গ সংস্কৃতিরই অংশ৷ শিক্ষা সংস্কৃতিকে পরিশীলিত করে, আবার সংস্কৃতি শিক্ষার মাধ্যমেই গতিশীল হয়৷ যেমন- গ্রামের কোনো এক খালের ওপর গ্রামীণ মানুষের বানানো একটি বাঁশের সাঁকো গ্রামের মানুষ তাদের প্রয়োজনেই তৈরি করে যা তাদের বস্তুগত সংস্কৃতিরই অংশ৷ কিন্তু একজন প্রকৌশলী যখন সেখানে নকশা অনুযায়ী ব্রীজ নির্মাণ করে তখন সেটাও সংস্কৃতির অংশ হয় তবে সেটি অনেক বেশি পরিকল্পিত, মজবুত ও আধুনিক হয়৷ এভাবেই সংস্কৃতি শিক্ষার মাধ্যমে পরিশীলিত ও পরিপুষ্ট হয়৷ আবার এই সাঁকো ও ব্রীজ নির্মাণ মানুষ শিক্ষার মাধ্যমেই রপ্ত করে বা শেখে এবং পরবর্তী প্রজন্মকে শেখায়৷
কিংবা আমাদের তাঁতি যে শাড়ি বা গামছা বুনছে সেটা যখন কোনো ফ্যাশন ডিজাইনার তার জ্ঞান ও শিক্ষাকে কাজে লাগিয়ে সেটা দিয়ে নানা কিছু তৈরি করছে যেটি বুটিক হাউজে স্থান করে নিচ্ছে সেটি অনেক বেশি পরিশীলিত হচ্ছে৷ আবার সাধারণ মানুষ গ্রামীণ কিংবা শহরের জীবনে বিয়ের অনুষ্ঠানে অনেক আচার-অনুষ্ঠান পালন করে৷ সেগুলি নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক পর্যায়ে পড়ানো হয়, গবেষণা করে তত্ত্ব প্রতিষ্ঠা করা হয়, সেগুলি আবার পরবর্তী প্রজন্মকে শিক্ষা দেয়া হয় ইত্যাদি৷ কাজেই দেখা যাচ্ছে শিক্ষা ও সংস্কৃতি সম্পৃক্ত৷ তাহলে সমস্যাটি কোথায়? শিক্ষিত মানুষের তো উন্নত জ্ঞানের হওয়ার কথা, নমনীয় হওয়ার কথা ছিল তবে কেন তারা উল্টো পথে হাঁটছে? কেন তারা হিংস্র ও জঙ্গিবাদের পথে হাঁটছে? মাদ্রাসা, ইংলিশ মিডিয়াম, বাংলা মিডিয়াম, প্রাইভেট ও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় কেউই তো বাদ যাচ্ছে না৷
একজন সমাজবিজ্ঞানের ছাত্র হিসেবে আমার বিশ্লেষণটি হচ্ছে এমন যে, আমাদের সমাজ কাঠামোর পরিবর্তনের পাশাপাশি আমাদের শিক্ষা কাঠামোতেও পরিবর্তন এসেছে৷ প্রযুক্তিগত ও বস্তুগত উন্নয়ন যত বেশি হয়েছে তার তুলনায় জ্ঞান ও ধ্যান-ধারণা-বিশ্বাস পিছিয়েছে৷ অথবা ততটা দ্রুত অগ্রসর হয়নি৷ ফলে দুটির ব্যবধানে নানা সামাজিক সমস্যা সৃষ্টি হচ্ছে৷ এর মধ্যে জঙ্গিবাদ একটি৷ বর্তমানে একাডেমিক শিক্ষাব্যবস্থা শিক্ষার্থীদের শুধু ইনফরমেশন দেয়, জবমার্কেটমুখী করে৷ বিশেষ করে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলো৷ একপেশে শিক্ষায় ভারাক্রান্ত তারা৷ দর্শন ও জ্ঞানের চর্চার অভাব রয়েছে এসব শিক্ষায় যা শিক্ষার্থীদের রোবট বানায় যারা শিক্ষা বলতে বোঝে শুধুই অর্থ উপার্জন৷ ফলে এসব রোবটদের মাথায় যে প্রোগ্রামিং ঢুকানো হয় তারা সেটা নিয়েই চলে৷ প্রকৃতি বিচ্ছিন্ন, সংস্কৃতি বিচ্ছিন্ন, পরিবর্তিত সমাজ কাঠামোতে অনেকটা পরিবার বিচ্ছিন্ন এসব কোমলমতী রোবট শিক্ষার্থীরা পথহারা৷ শিক্ষাব্যবস্থায় তাই ভারসাম্য আনা অতি জরুরি৷
শুধু উপার্জন নয়, জ্ঞানের সীমানাও প্রসারিত করতে হবে৷ বিভিন্ন দর্শনের চর্চা করতে হবে৷ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে সাজাতে হবে বিষয়ের বিচিত্রতায় যাতে জ্ঞানের ভারসাম্য বজায়ে থাকে৷ রোবট নয় মানুষ বিকাশের পথ খুঁজতে হবে৷ যে মানুষের মধ্যে স্বর্গের হাতছানির চাইতে যাতে পার্থিব জীবনের দুঃখী মানুষের কল্যাণ করার অনুপ্রেরণাই বেশি কাজ করে৷ শুধু নিজের অর্থ উপার্জন নয়, সমাজের মানুষের মঙ্গল কামনা যাতে প্রধান উপজীব্য হয় এমন শিক্ষাই আমাদের দরকার৷ সংস্কৃতি সংলগ্ন শিক্ষা আমাদের দরকার৷ শিকড়বিহীন পরগাছা শিক্ষায় শিক্ষিত মানুষ অন্যকে আশ্রয় করে বাঁচতে চায় নতুবা মৃত্যুবরণ করে৷ তবে যদি সংস্কৃতি আশ্রয়ী শিক্ষার ভারসাম্য ফিরিয়ে আনা যায় সমাজে তবে জঙ্গীবাদ, সন্ত্রাসবাদ দুর্বল হয়ে যাবে আপনাআপনিই৷ কারণ তখন রোবট নয় মানুষ তৈরি হবে, যারা ভালো-মন্দের পার্থক্য করতে পারবে৷ ন্যায়-অন্যায়ের তফাত বুঝতে পারবে৷
ফাহমিদা হক কলি'র ফেসবুক থেকে