মনুষ্য সন্তানের আর কতো প্রাণ প্রয়োজন?
প্রকাশ | ১৯ জুলাই ২০১৬, ২১:৫৬ | আপডেট: ১৯ জুলাই ২০১৬, ২৩:৫৪
ভোরবেলা কাল কুশান আর আমি দৌড় দিলাম প্রেক্ষাগৃহের উদ্দেশ্যে। সিনেমায় ‘দ্য জাঙ্গল বুক’ দেখবার এই শেষ সুযোগ। কিপলিং এর জাদুলেখনীর মায়ায় ভরে আছে মুভিটা-খুব সুন্দর করে বানানো-যদিও এই মুভি শিশুদের জন্যে নয় বলেই মনে হলো (প্রায় সারাটা সময় কুশান ছোট-বাঁদরের মতো আমার কাঁখে ঝুলে রইলো আর প্রায়ই চোখমুখ গুঁজলো আমার কাঁধে)।
‘শের খান’ নামের রয়্যাল বেঙ্গল টাইগারটা এখানে ভিলেন, নাক পুড়ে যাওয়া আর একটা চোখ নষ্ট হয়ে যাওয়া রুদ্রমূর্তি বাঘ- মানুষ তাকে ঠুঁটো করে দিয়েছে বলে মানুষের ছা’র ওপর তার রাগের অবধি নেই, মানুষখেকো হয়ে গেছে সে।
আমি বারবার কুশানকে আশ্বস্ত করলাম- 'সত্যিকারের বাঘ এমন দুষ্টু না রে কুশান'। আমার গলার আওয়াজে হালিমা খাতুনের ‘সোনামনিদের পড়া’র সেই “সিংহ হিংসা ভুলে মাংস আনলো”র মতো অস্বাভাবিক কিছু থেকে থাকবে, কুশান মিনমিনিয়ে বললো, “সত্যিকারের বাঘ তাহলে এমন হিংস্র না? আদর করে আর পোষ মানে?”
-না। আদর করে না, পোষও ঠিক মানে না, কিন্তু নিজের মতন করে থাকে। জীবন কাটায়।” আমায় থাকতে দে না আপনমনে।
ওর বয়েসে ইস্কুলে যখন ড্রয়িং খাতায় আঠা দিয়ে তাতে মুগডাল আর কালো সর্ষে বা কালোজিরা ছড়িয়ে আমরা রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার বানাতাম, তখন আমারও ভাবতে ভাল লাগতো, বাঘ বড় আদুরে। এখন জানি, বাঘ আদুরে না হলেও বাঘ বড় আদরের। বাঘ আর বাঘেদের সুন্দরবন ‘আইলা’র মতো বিপর্যয়কে কমিয়ে লক্ষ লক্ষ মানুষকে বাঁচিয়েছে, মায়ের মতন সুন্দরবন কোটি কোটি মানুষের সরাসরি জীবিকার সাথে জড়িয়ে থেকেছে। সুন্দরবনের গল্প করতে গিয়ে আমার বাপ কাঁদতো। সুন্দরবনের কারণে ঘূর্ণিঝড় থেকে তার মেয়ে বেঁচে গেছিল বলে আমার মঞ্জুবুয়া কাঁদতো। সেসব কথা থাক।
‘শের খান’ যখন হুংকার দিয়ে প্রশ্ন করলো মুভিটায়, “How many lives is a man cub worth?”, তখন আমি কাঁদছি, স্রেফ মুখ হাঁ করে চোখ কুঁচকে পূর্ণবয়স্ক মানুষের বিশ্রী কান্না। এই প্রশ্ন যদি সমস্ত সুন্দরবন আজ করে, আমাদেরকে উদ্দেশ্য করে প্রশ্ন করে, আমাদের জবাব কি?
আমরা এতই ইতর, এতই মূর্খ যে আমরা সুন্দরবনের এবং তার আশপাশের অঞ্চলের মানুষদের ঐকবাক্য এবং প্রতিবাদকে স্রেফ আমলেই নিলাম না?
মানুষের জন্য বিদ্যুত দরকার, সত্যি।
বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে সুন্দরবনের এই অমূল্য ভূখন্ড লাগবে, মিথ্যা।
আমাদের কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রই লাগবে বিদ্যুৎ উৎপাদনকল্পে, মিথ্যা।
কয়লার পারদ-সালফার-কার্বন সুন্দরবনের ভূপ্রাকৃতিক বৈচিত্র্যকে চিরতরে শেষ করে দেবে, সত্যি।
আমাদের প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যমতে কয়লা দিয়ে পানি ফিল্টার করে বলে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মিত হলে পরিবেশ দূষিত হবে না, সর্বৈব মিথ্যা।
আইনতঃ ভারত তার কোনো বনভূমির ২৫ কিলোমিটারের ভিতরে কয়লাভিত্তিক এ ধরণের বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করতে পারে না, সত্যি।
কিন্তু ভারত বাংলাদেশের অংশের সুন্দরবনের প্রাণভোমরার কৌটোয় এসে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করার স্বপ্ন দেখাতে পারে এবং তা বাস্তবায়নও করতে পারে, সত্যি।
(“ফুলের বনে কে ঢুকেছে/ সোনার জহুরি/ নিকষে ঘষয়ে কমল/ আ মরি আ মরি”- সৈয়দ মুজতবা আলী থেকে সংগৃহীত)
আমার সত্য-মিথ্যা সকলি ভুলায়ে দেওয়ার আগে আমার সূচ্যগ্র বনভূমি কাউকে এইভাবে চিরতরে নষ্ট করতে দেব না। আমি যেখানে দাঁড়িয়ে আছি, যেখানে আছি সেখান থেকে এই আমার filibuster, এখান থেকেই অনবরত আমি বলতে থাকবো, দেশে বলবো, বিদেশে বলবো, বলতেই থাকবো।
বন্ধুরা যোগ দাও। হাত বাড়িয়ে দাও।
সাগুফতা শারমীন তানিয়া'র ফেসবুক থেকে