কী বিরাট ক্ষতিকর মানুষ হয়ে দাঁড়িয়েছি!
প্রকাশ | ১৯ ডিসেম্বর ২০১৭, ১৮:০৭ | আপডেট: ১৯ ডিসেম্বর ২০১৭, ১৮:১৩
সকালে অফিসে যাওয়ার পথটা বেশ ফুরফুরে মুডে থাকি আমি। পথটা হাঁটা আর রিক্সায় মেলানো। বেশির ভাগ সময়ই গান গাইতে গাইতে এগোই। মাঝে মাঝে গলা ছেড়ে গাই, মাঝে মাঝে গুনগুন। আজকে ভুপেন হাজারিকার 'প্রতিধ্বনি শুনি' গানটা গলা ছেড়ে গাইতে গাইতে হাঁটছিলাম। গলা ছাড়লেও আমার কণ্ঠ জোরালো নয়, কান পেতে শোনা লাগে এমন। তাই অন্যদের বিরক্তি তৈরী হতে পারে এমন মাথাব্যথা রাখি না। কিন্তু আজ দুইজন খুব বিরক্ত হলো।
'নতুন দিনের যেন পদধ্বনি শুনি' লাইনটা গেয়ে শেষ করতেই পুরুষ কন্ঠের উক্তি কানে এলো- "সুন্দর গান গাইতে গাইতে যাইতেসে, এইজন্যই তো স্বাধীনতা আনছে। বুঝো না??" একজন কেউ অন্য একজনকে বলছে। খোঁচা মারা টোন। কয়েকজনের পায়ের শব্দ টের পেলাম। মনে হলো, বাহ! ব্যাপারটা পছন্দ না করলেও ভাই তো ঠিক বুঝেছেন, আমি স্বাধীন মানুষ। দেশের স্বাধীনতা, ব্যক্তিস্বাধীনতা, আর নারীর স্বাধীনতার যে যোগসূত্র কোথাও না কোথাও আছে সেও ঠিক ঠাহর করতে পেরেছেন। ওদের এড়ানোর জন্য হাঁটার গতি বাড়ালাম না, কোনো প্রতিক্রিয়া দেখালাম না। যেমন বিন্দাস হাঁটছিলাম তেমনি হাঁটতে লাগলাম, গান গাইতে গাইতেই। তারা ভাবলো আমি শুনতে পাইনি, পেছন পেছন আসতে আসতে একই কথা আরো দুইবার বললো। আমার কোনো পরিবর্তন নেই দেখে একটু বোধহয় গায়ে জ্বালা ধরলো, একটা মেয়েকে এইভাবে বুঝানো হবে তার এইভাবে গায়ে হাওয়া লাগায়ে ঘুরার কোনো অধিকার নাই, শিক্ষিত মেয়ে বুঝবে না এইটা? আরে মেয়ে তুই রেগে মেগে লাল হ, নাইলে তুই পালায়ে বাঁচ! কিংবা জড়সড় হয়ে হাঁট। গান থামা। তা না তুই দিব্যি নিজের চালে হাঁটস! তুই তারপরেও গান গাস! (এইগুলি বলেনাই তারা, আমি কানও পাতি নাই। গানের মাঝখানের প্রয়োজনীয় বিরতিতে পরের ডায়লগ শুনে বুঝছি।)
যা হোক, এরপর শুনলাম "এইজন্যই আমার মা আর মহিলা কাজের লোক রাখে না, মহিলা মানেই সমস্যা। খালি ভেজাল করে, কথা কোনোটাই শুনে না।" বাহ বাহ! আরো একটা ভালো কথা, 'মহিলা দাসী' আর রাখেন না তারা। পুরুষ রাখেন কি?? বেশ বেশ। স্বরটা আরো এক ধাপ চড়িয়ে আবার গাইলাম, "নতুন দিনের যেন পদধ্বনি শুনি!"
অফিসে যখন প্রায় চলে এসেছি ততক্ষণে তারা আমার সমান্তরালে হাঁটছে। গেইট দিয়ে ঢুকার সময় স্পষ্ট তাকালাম একমুহূর্ত দাঁড়িয়ে, যে ঘুরে তাকিয়েছিলো আমার দিকে তার দিকে। সে মুখ ঘুরিয়ে নিলে পরে আমিও ঢুকে গেলাম। হাসতে হাসতে লিফটের সামনে সহকর্মীকে জানালাম আমার নির্বিবাদ হাঁটা আর গান বেচারা ভাইদের জন্য কতো অসহনীয় ঠেকলো যে দেশের স্বাধীনতার উপরই রাগ ধরে গেলো তাদের!
কী বিরাট ক্ষতিকর মানুষ হয়ে দাঁড়িয়েছি- নিজেকে ঘের দিয়ে পেঁচায়ে রাখি না, জড়সড় আলতো পায়ে হাঁটি না, বার বার এইদিক ঐদিক জামা-ওড়না টানি না, আশপাশে পুরুষ পথচারী আছে জেনেও জায়গা ছেড়ে/'সাইড চেপে' হেঁটে যাই না, আবার গানও গাই দুলকি চালে রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে। এ হেন প্রাণী সহ্য করা মুশকিল বটে!
জিনাত হাসিবা স্বর্ণার ফেসবুক থেকে