ধর্মের খাঁচায় কাছের মানুষটিকে নাই বা ঢোকালেন
প্রকাশ | ১০ ডিসেম্বর ২০১৭, ২৩:৩৪ | আপডেট: ১১ ডিসেম্বর ২০১৭, ০০:২৩
এক পার্সি মেয়ে বিয়ে করলো হিন্দু ছেলেকে। গুলরুখ গুপ্তা তার নাম। লভ জিহাদ? হবেও বা। লভ তো চিরকালই জিহাদ।
সে যাই হোক, নারীর ওপর অবদমনে কোন ধর্মই তো কম যায় না, তাই পার্সিদেরও এক অদ্ভুত নিয়ম আছে। ঘরের মেয়ে পরকে বিয়ে করলে সে স্ব-সম্প্রদায়ের ধর্মীয় অনুষ্ঠানে অংশ নেবার অধিকার হারাবে। যেমন, হিন্দু মেয়েরা মুসলমানকে বিয়ে করলে আর পুজোআচ্চা নয়, বা মুসলিম মেয়ের হিন্দু স্বামী কি তাকে নামাজ পড়ার অধিকার দেয় !
তো গুলরুখও তেমনি একরোখা। সোজা কোর্টের দরজা নেড়ে দিল জোরসে- আমি কেন টাওয়ার অব সাইলেন্সে প্রবেশ করতে পারব না, কেন আমার বাপমায়ের শেষকাজে অংশ নিতে পারব না !
তিনদিন আগে সুপ্রিম কোর্টের রায়- পাত্র পাত্রীর ধর্ম ভিন্ন হলে বিয়ের পর স্বামীর ধর্মই স্ত্রীর ধর্ম হয়ে যাবে একথা এদেশের আইনে কোত্থাও লেখা নেই। যদিদং হৃদয়ং তব- ইত্যাদি তো স্বামী স্ত্রী দুজনের ক্ষেত্রেই খাটে, নাকি ?
১৯৫৪ র Special Marriage Act এ ধর্মমতের তোয়াক্কা না করে বিয়ে করা যায় ঠিকই, কিন্তু স্বাভাবিকভাবেই সেখানে বিবাহ পরবর্তী ধর্মাচরণের কথা কিছুই বলা নেই।
আইন মেনে চলার বান্দা ভারতবর্ষে খুব কম, তাই বলা যাচ্ছে না এই রায়ের পর সালমা খাতুন শ্বশুরঘরে নমাজ পড়তে পারবে কিনা, বা পার্বতী মকবুলকে বিয়ের পর নিশ্চিন্তে লক্ষ্মীর পাঁচালি পড়তে পারবে কিনা।
পেল কি পেল না, তা নিয়ে ব্যক্তিগত ভাবে কিছু না এলে গেলেও এই বিশাল দেশের গ্রামে মফস্বলে অনেকে নারীরই অনেক যায় আসে। ছোট্ট থেকে যাদের হাত ধরে হাঁটতে শেখা সেই বাবামায়ের শেষ সময়ে ধর্মের দোহাই দিয়ে বিবাহিত মেয়েকে আটকে দেওয়া হবে এটা ভাবলেই আমারও পায়ের রক্ত মাথায় উঠে যায়।
অথচ এ দেশে অনেক আগেই এই দাম্পত্য স্বাধীনতার চর্চা করে গেছেন একজন। তিনি সম্রাট আকবর। রাজপুতানার আমেরের রাজকন্যা রাজা ১ম পৃথ্বী সিংহের নাতনি হিরা কুয়াঁরিকে বিয়ে করেছিলেন তিনি, টড সাহেবের ভুলে যিনি পরবর্তীতে যোধাবাঈ নামেই প্রসিদ্ধি পান।
সম্রাট জাহাঙ্গীরের জন্মদাত্রী এই হিন্দু রাজকুমারীর শ্বশুরকুলে নাম হয়েছিল মারিয়াম উজ জামানি (mary of the age), কিন্তু না, নিজের ধর্মাচরণ থেকে তাকে বঞ্চিত করেননি আকবর। বরং ফতেহপুর সিক্রিতে কৃষ্ণ জন্মকথা দেওয়ালে খোদাই করে একটি বিশাল মন্দির বানিয়ে দিয়েছিলেন। কথিত আছে সম্রাট নিজেও সেখানে পূজা আচ্চায় অংশ নিতেন। মৃত্যুর পর মরিয়ামের নিজের ইচ্ছে মেনে তাকে স্বামীর কাছাকাছি সমাধিস্থ করা হয়।
মনের মানুষকে ভালবেসে প্রাপ্য স্বাধীনতা দিলে কি হয় তা ইতিহাস জানে। আকবরের পরধর্ম সহিষ্ণুতা, দীন ইলাহি ইত্যাদির পেছনে মরিয়ামের অবদান প্রচুর বলেই ঐতিহাসিকরা মনে করেন। রাজনৈতিক তাৎপর্য ছিলো, তবে এই বিবাহ আকবরকে হিন্দু মুসলমান নির্বিশেষে গোটা হিন্দুস্থানের হৃদয়েশ্বর হবার পথে অনেক এগিয়ে দিয়েছিল, এটা ঘটনা।
স্বধর্ম-অন্ধরা কি শুনছেন ? ধর্মের খাঁচায় একান্ত কাছের মানুষটিকে নাই বা ঢোকালেন। বিবাহবন্ধন, যদি তা ভালবেসে হয়, গায়ের জোর ফলাবার জায়গা নয় মোটেই।
গুরুচণ্ডালী ওয়েবজিনে প্রকাশিত