সেলাম মুম্বই
প্রকাশ | ২৬ নভেম্বর ২০১৭, ১৮:৪৫ | আপডেট: ২৮ নভেম্বর ২০১৭, ১৮:১২
আমি গল্প শোনাতে ভালোবাসি এবং বেশিরভাগ সময়েই গল্পই শোনাই। তার বেশি আমার ক্ষমতাও নেই, যোগ্যতাও না। আসুন আজ গল্প শুনি এমন কিছু মানুষজনের যারা আমাদের আশেপাশেই আছেন, থাকেন। সকালে হাতে টিফিন বক্স আর ব্যাগ নিয়ে অফিস যান, সন্ধে হলে ঘড়ির দিকে তাকান কতক্ষণে ছ’টা বাজবে, বাজার করে নিয়ে বাড়ি যাবেন। ছেলেপুলের জন্য রাঁধবেন, বা একসাথে বসে খাবেন। ছুটির দিনে স্বপরিবারে ঘুরতে যান চিড়িয়াখানা, বা কখনো সখনো সিনেমা। বৎসারান্তে ছুটিতে দেশের বাড়ি রত্নগিরি। ছেলেপুলেরা পড়েলিখে চাকরি নেয়, এক কামরার ফ্ল্যাটবাড়িতে চলে যায় আলাদা হয়ে। বুড়োবুড়ি চৌলের একরুম কিচেনের ঘরে রাঁধেবাড়ে, ভাজি কিনতে যায় বিকেলে, গণপতিতে এ ওর হাত ধরে লালবাগচা রাজার দর্শন করতে যায়। রাজার দর্শনমাত্রে সব দুখ দূর হয়।
এই হচ্ছে মধ্যবিত্ত মুম্বইকরের জীবন। বিষ্ণু জেন্দে তার কিছু ব্যতিক্রম নয়। রেলের সরকারি চাকরি, ভিটিতে পোস্টিং। আর কী চাই জীবনে? শিফ্ট ডিউটি করতে হয় বটে, কিন্তু তা ছাড়া অন্য কোন অসুবিধা নেই জীবনে। বাইকো শান্তশিষ্ট মেয়ে, বাবা আই বউ ছেলে নিয়ে সুখের সংসার। বিষ্ণু ভিটি স্টেশনে ঘোষকের কাজ করে। সকাল সন্ধ্যা দেশের অন্যতম ব্যস্ত স্টেশনের কত নম্বর প্ল্যাটফর্মে কী ট্রেন আসবে আর ছাড়বে, তা লোককে জানানোই তার কাজ। প্রশিক্ষণের সময় বলা হয়েছিল কীভাবে কোন শব্দের ওপর জোর দিয়ে বলতে হবে, সেসব খুব মন দিয়ে শিখেছিল সে। খুবই ভালো ঘোষণা দেয় বিষ্ণু। সেদিন সন্ধেবেলা, ব্যস্ত স্টেশনে যথারীতি ‘ঘোষণা দিতে’ ব্যস্ত সে, এমন সময় স্টেশনের গেটের দিক থেকে হঠাৎই শোনা যায় বোমার আওয়াজ। হতভম্ব বিষ্ণু খানিকক্ষণ কী করবে বুঝতে না পারলেও, বাপ্পা বুদ্ধি ফিরিয়ে দেন তার শিগগিরি। সে ক্রমাগত ঘোষণা করতে থাকে সিআরপিএফ এবং জিআরপিকে স্টেশনের মূল গেটের দিকে পৌঁছতে। সঙ্গে সঙ্গে বলতে থাকেন, যে সমস্ত ট্রেন এসে পৌঁছচ্ছে, তাদের যাত্রীরা কেউ সামনের গেটের দিকে যাবেন না। পিছনের গেটের দিক দিয়ে বেরিয়ে যান। ক্রমাগত। তাঁর এই ঘোষণা সেদিন শতাধিক যাত্রীর প্রাণ বাঁচায়। দুই টেররিস্ট শ’দেড়েক লোককে ঘায়েল করার এবং জনা পঞ্চাশ লোককে মেরে ফেলার পর যখন বুঝতে পারে যে এদিকে আর লোকজন আসছে না, তাদের স্বাভাবিক ভাবেই খটকা লাগে। তারা বুঝতে পারে ঘোষণা করা হচ্ছে এদিকে কারোকে না আসার জন্য। তারা ঘোষণাকক্ষ খুঁজতে থাকে। দূর থেকে একে 47 নিয়ে তাদের এদিকে আসতে দেখে বিষ্ণু দরজা বন্ধ করেন, আলো নিভিয়ে দেন এবং আলমারির পিছনে লুকোন। তারা এসে গুলি করে কাঁচের জানালা ভাঙে, এবং কারোকে দেখতে না পেয়ে ফিরে যায়। তারা ফিরে যাওয়ার পর বেরিয়ে এসে আবার ঘোষণা করা চালু করেন বিষ্ণু। এবং যতক্ষণ না পুলিশ এসে সমস্ত চত্বরের দখল নেয়, তিনি ঘোষণা চালু রাখেন।
রীতা, কামা হাসপাতালের সিস্টার। সেই ভয়ংকর রাতে ডিউটি ছিল তাঁর। বাইরে হঠাৎ হ্যান্ড গ্রেনেডের আওয়াজ পেয়ে দৌড়ে আসেন এবং দেখতে পান লোকজন দৌড়তে দৌড়তে ভিতরে ঢুকছে। যতজনকে সম্ভব ভিতরে ঢুকিয়ে নেন তিনি। মেইন গেট বন্ধ করেন এবং সিকিউরিটি এবং জমাদারদের সাহায্যে আলমারি, কোল্যাপসিবল সিঁড়ি এবং বেঞ্চ দিয়ে ব্যারিকেড বানান দুই গেটেই। ছেলেদের বাথরুমের দিকে এবং মেয়েদের মিল্ক রুমের দিকে আলাদা করে বসিয়ে রেখে একতলার সমস্ত আলো নিভিয়ে দেন। একজন প্রসূতি আসন্নপ্রসবা, তাঁকে টর্চের আলোয় প্রসব করান টেবিলে এবং সন্তান যাতে না কাঁদে, তাই নিজের কোলের কাছে মাকে নিয়ে বসিয়ে তাঁর সন্তানকে দুধ দিতে বলেন। কামা হাসপাতালের বাইরে যথেচ্ছ তাণ্ডব চালালেও এবং হাসপাতালের দরজায় গুলি চালালেও সন্ত্রাসবাদীরা ভেতরে ঢুকতে পারে নি। বলাই বাহুল্য, শতাধিক মানুষের প্রাণ বাঁচে তার প্রত্যুৎপন্নমতিত্বে।
সন্ত্রাসবাদীরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করেছিল তাজের। তাজের আতিথ্য এবং তার কর্মীদের ব্যবহার বিশ্ববন্দিত। এই তাজের কর্মীরা নিজেদের প্রাণ তুচ্ছ করে অতিথিদের প্রাণ বাঁচান। সাত মিনিটের মধ্যে সমস্ত ইমারজেন্সি এক্সিট খুলে দেওয়া হয়। কর্মীরা কয়েক ফুট দূরত্বে দাঁড়িয়ে থেকে চেইন ফর্ম করেন এবং অতিথিদের বাইরে নিয়ে যাওয়ার দায়িত্ব নেন। এক ইমারজেন্সি এক্সিটে সন্ত্রাসবাদীরা পৌঁছে গিয়ে একজন বা দুজনকে ঘায়েল করলে অবিশ্বাস্য দ্রুততায় পথ পাল্টানো হতে থাকে, সহকর্মীর মৃতদেহকে পাশে সরিয়ে রেখে, এবং যে দেড় দিন প্রায় অভিযান চলে, কোন তাজ কর্মচারী হোটেল ছেড়ে যান নি। এমনকি ম্যানেজারও না, যদিও তাঁর স্ত্রী সহ দুই সন্তান হোটেলেরই এক ঘরে গ্রেনেডের ধোঁয়ায় শ্বাসরুদ্ধ হয়ে মারা যায়। তাজের কর্মীদের এই অসম্ভব কর্তব্যনিষ্ঠাকে পৃথিবীর বহু দেশ সম্মান জানিয়েছে। সমস্ত বড় চেইন অফ হোটেলস্ প্রশিক্ষণের সময় তাজের এই ঘটনার উদাহরণ দেওয়া হয়।
এনারা কেউ আর্মি বা পুলিশের অংশ ছিলেন না কোনদিন। কোন ট্রেনিং ছিল না এঁদের সন্ত্রাসবাদীরা আক্রমণ করলে কী করতে হয়, তার ওপর। এমনকি সেদিনের ঘটনার পর যারা বেঁচে রইলেন, তাঁরা সেই মধ্যবিত্ত সাধারণ জীবনে ফিরে গেছেন। এঁদের নাম, বা বীরগাথা মনেও রাখবে না হয়ত কেউ কোনদিন। শুধু হাজারখানেক মানুষ আর শ’খানেক পরিবারের প্রাণের ঋণ রয়ে গেল এনাদের কাছে। কোন কোন মানুষ এমনি করেই হয়ত ঈশ্বর হন।
আজ ছাব্বিশে নভেম্বর। এই শহরের কান্নার দিন, শোকের দিন। আবার গর্বেরও দিন।
সেলাম মুম্বই।।