আমি চললাম
প্রকাশ | ০১ নভেম্বর ২০১৭, ২১:২৪ | আপডেট: ২৮ নভেম্বর ২০১৭, ১৮:১৩
জানোই তো, চিঠি লেখার অভ্যাস গেছে। এককালে ছিল, যখন তোমার ডেস্কের ড্রয়ারে চিঠি রেখে আসতাম, আর নিয়েও আসতাম সেখান থেকেই। তাতে থাকতো সেই সম্বোধন, যা আমরা কখনো দুজন দুজনকে করতে পারবো বলে দুরাশা ছিল, "শুনছো?" সেই চিঠিতে আমাদের লাল নীল না-হওয়া স্বপ্নের ঘরের কথা থাকতো, আর থাকতো সাতসকালে আমি তোমার মুখে কেমন করে "আলো" হয়ে এসে পড়ি, তার গল্প। বিয়ের পরে একটা ছোট্ট ফুলের বাগান হবে আমাদের বাড়ির সামনে, আর ঘরের পেইন্ট হবে লাইট ব্লু। "বেশ, তাই হবে"!
বেশ, তাই হবে, এই শব্দবন্ধে চিঠির পাতা ভরে থাকতো তখন। তখন অবশ্য অনেক কিছুই হতো যা এখন হয় না। তখন হিম হিম বিকেলে হাত ধরে হাঁটা ছিল, লুকিয়ে চুরিয়ে, সবার অলক্ষ্যে তাকানো ছিল একপলক আর চোখে চোখ পড়ে গেলে ছিল ঠোঁটের কোণে খেলে যাওয়া হালকা হাসি। যে সোফা কখনো কেনা হয় নি, যে বুকশেলফ, তার ডিজাইন নিয়ে তর্ক ছিল। শাড়ির পাড় আর আঁচলের কল্কার ধরণ নজরে পড়তো তোমার, টিপটা কপালে একটু বেঁকে বসেছে কিনা তাও। তখন অকারণে এগিয়ে দেওয়া ছিল আর একটু। আর একটুখানি।
এখন বাড়িতে খাট বিছানা, আলমারি, ফুলের টব, বুক শেলফ, সোফা, সবকিছু নিয়মমাফিক সাজানো থাকে। একটু একটু করে সাজানো সংসার। নীল মুখোশটা বালি থেকে কেনা, আর ওই যে কাংড়া পেইন্টিং, ওটা দিল্লি থেকে। ফুলের টবে গোলাপ আর চন্দ্রমল্লিকা ফোটে নিয়ম করে। আর আমিও নিয়ম করে অফিস যাই, বাড়ি আসি, খাই, রাঁধি, ঘুমোই। নতুন শাড়ি কিনি, যদিও তুমি তার রঙ জানো না। রীতুর মেয়ের বিয়েতে বহুদিন বাদে বিয়ের বেনারসী পরেছিলাম বের করে, তুমি চিনতে তো পারলেই না, উল্টে বললে, এত ভারী শাড়ি আজকাল ফ্যাশন নাকি? না, ফ্যাশন না। আমি লোকটাই বা কোন হাল ফ্যাশনের? তাই তো তোমার হাল ফ্যাশনের নতুন নতুন প্রেমিকা হয়, মানুষ পুরোনো কিছুই বেশিদিন সইতে পারে না বোধহয়। তা হোক, আমার তাতে বিশেষ আপত্তি ছিল না। আমার তো কিং সাইজ বেড ছিল, পরিপাটি গোছানো, টবের চন্দ্রমল্লিকা ছিল, বারান্দায় ঝোলানো দেশ বিদেশের চাইমস্ ছিল, আর ছিল রূপু। এসব ফেলে কোথায় যাবো?
তারপর একদিন তুমি রূপুকে বললে, আর যাই করিস, এইসব লিবারেটেড মেয়ে ফেয়ে বিয়ে করিস না। জীবনটা শালা হেল হয়ে যাবে। রূপু তখন খুবই ছোট এসব বোঝার পক্ষে। সে বোকার মত হাসলো। আমি আমাদের এইট সিটার সোফায় মুখ নিচু করে বসে রইলাম। আরেকটু বড় হতে একদিন বললে, সেদিন আমাদের ঝগড়া হয়েছিল কী যেন নিয়ে, মেয়েছেলেরা আসলে কিছুতেই খুশি হয় না বুঝলি। যতই চেষ্টা কর, মন পাবি না। রূপু মন দিয়ে শুনলো। আমিও শুনলাম বোন চায়নার ক্রকারিতে চামচ দিয়ে ঠুংঠাং আওয়াজ করতে করতে।
এইভাবেই হয়তো চলে যেতো জীবন। তুমি গালে পাঁচ আঙুলের দাগ বসিয়ে দিলে রূপু ছুটে এসে ছাড়িয়ে দিতো। আর আমি ফুল পাখি, সোফা আর ডেকরের কাছে সুখী দাম্পত্য খুঁজতাম। কিন্তু যেদিন রূপুর প্রথম ব্রেক আপ হল, ও বাড়ি এসে বললো, বুঝলে মা, ভালোই হয়েছে। এইসব লিবারেটেড মেয়েদের সাথে আর না। এদের শালা যতই করো, মন পাবে না। বলে জিভ কেটে সরে গেল। তোমাদের সংস্কৃতিবান বাড়িতে মায়ের সামনে শালা বলার নিয়ম নেই। সেদিন বোধহয় আমি প্রথম আর শেষবারের মত বুঝলাম, এ বাড়িতে থাকা উচিত হয় না আমার। বুঝলাম, খাট বিছানা আর দামী পর্দার বাইরে আরো কিছু দামী ছিল আমার কাছে, নিজের হাতে তাকে নষ্ট হয়ে যেতে দিয়েছি।
রূপু আসবে কিনা জানা নেই। বড় হয়েছে, ওর নিজস্ব ইচ্ছা অনিচ্ছা আছে। কিন্তু আমি চললাম। নিজের চোখে ওকে যা চাই না তা হতে দেখতে পারবো না। হয়ত ও আসবে, হয়ত আসবে না, তোমরা ওকে বুঝিয়ে দেবে যে ওর মা অতি খারাপ মহিলা ছিল। সন্তান ছেড়ে কি আর কোন মা যেতে পারে? হয়তো রূপু আমায় ঘেন্না করেই বড় হবে। কিন্তু এখানে থেকেই বা কী করবো আমি? আমার তো আর কোন কাজ নেই এখানে, ঘরের আসবাব ঝাড়াপোঁছা করা ছাড়া।
যদি আসে রূপু, যদি আসে, যদি, তবে নতুন করে মা ব্যাটায় সেই লাল নীল সংসার শুরু করা যাবে, যার টানে এতগুলো বছর এখানে থেকে গেছিলাম। ভালোবাসা শ্রদ্ধা বিশ্বাস। না হলে খাট সোফা এসির সংসার আর নয়।
এগিয়ে দেওয়ার অভ্যাস আমাদের বহুকাল নেই। তবু ভাবলাম, জানিয়ে যাই। জিনিসপত্র সব রইলো, শাড়ি গয়না, গানের খাতা, বইপত্তর। বাড়ির আর আলমারির চাবি। ফুলের টব। রূপুও রইলো।
আমি চললাম।
দেবশ্রী মিত্রের ফেসবুক থেকে