ঘুরে দাঁড়াতে জানে বাংলাদেশ

প্রকাশ | ১৪ জুলাই ২০১৬, ১৪:২৪

লীনা পারভীন

গত কয়দিন ধরেই বাংলাদেশের মানুষ যে বিষয়টি নিয়ে সবচেয়ে বেশী উদ্বিগ্ন, যে বিষয়টি সবচেয়ে বেশী আবাল-বৃদ্ধা-বনিতার মুখে মুখে ঘুরে বেড়াচ্ছে তা হচ্ছে বাংলাদেশে জঙ্গি হামলা। গুলশান ঘটনা যেন আমাদের সবাইকে আবার নতুন করে ভাবতে শিখাচ্ছে। চলছে নানা বিশ্লেষণ। এ যেন গোছানো একটি বাগানে হঠাৎ টর্নেডোর ধাক্কা।

কিন্তু আসোলেই কি তাই? এর কি কোনপ্রকার পূর্বাভাস ছিল না? এই যে জঙ্গি শব্দটি এ কি আমরা গুলশান থেকেই শিখলাম? যদি তাই হয় তবে উদীচী থেকে শুরু করে যেসব বাংলা ভাই, ইংরেজী ভাইদের উত্থান এবং পতন সেগুলি কি ছিল? এই যে প্রায় প্রতিদিন কোন না কোন এলাকায় একজন করে জবাই করে, গুলি করে হত্যা করা হচ্ছে সেগুলি কি? এগুলির কোন ডেফিনিশান কি আমরা দাঁড় করিয়েছিলাম?

আইসিস, আল-কায়দা, আহলে হাদিস, হিজবুত তাহরীর এই যে দেশী-বিদেশী নাম, সেগুলির ব্যাপারে কি আমরা কোন ব্যাখ্যা খোঁজার চেষ্টা করেছি?

গুলশান ট্র্যাজেডির পর আমরা সবাই মিলে ভাবছি, এই যে সুন্দর টগবগে তরুণ যারা বেশীরভাগই এসেছে বিত্তবান পরিবার থেকে, কি কারণ থাকতে পারে তাদের এই অসুস্থ পথে যাবার? কারণ এতদিন আমরা খুব সাদামাটা ভাবে জেনে এসেছি যে মাদ্রাসাগুলো হচ্ছে মৌলবাদী গ্রুপের আস্তানা। সেখানে সমাজের দরিদ্র এবং পিছিয়ে পড়া শ্রেণীর সন্তানরা যায় এবং মৌলবাদী শক্তি খুব সহজেই তাদের প্রলোভিত করতে পারে।

সব হিসাব নিকাশ জাস্ট উল্টে গেল এবং আমরা আচমকাই দেখতে পেলাম নিব্রাসরা কেউ দরিদ্র ঘরের না বরং সমাজের একটি বিশেষ শ্রেণীর প্রতিনিধি যারা পড়াশুনা করেছে টাকার অংকে সবচেয়ে দামী স্কুলে, মোনাশ বা নর্থসাউথের মতো নামী দামী বিশ্ববিদ্যালয়ে। এদের আউটফিট মোটেও জঙ্গিদের নয় বা তথাকথিত মোল্লাদের মত নয়। দেখতে আকর্ষণীয় এবং আধুনিক।

বাংলাদেশের এই মুহূর্তে সবচেয়ে বড় শক্তি তার যুবসমাজ। এই নিব্রাসরাই হতে পারতো পরিবর্তিত এগিয়ে চলা বাংলাদেশের চালক। কিন্তু তা ঘটেনি। শোনা যাচ্ছে প্রায় ২০০ তরুণ এখনো নিঁখোজ। এর ব্যাখ্যা কি? আমাদের বাহিনীর কাছে কি আছে কোন প্রতিকার? এর পিছনে আমরা অনেকেই ভাবছি হয়তো ছেলেগুলি পারিবারিক বন্ধন থেকে মুক্ত ছিল, হয়তো তাদের বাবা-মা তাদের প্রতি অতটা কেয়ারফুল ছিল না। যার সুযোগে তারা এই আশক্তিতে জড়িয়ে পড়েছে।

আসলে হিসাবটা কি এত সোজা? মোটেই না। বাংলাদেশ ভৌগলিক দিক দিয়ে এখন সারা বিশ্বের সাথে যুক্ত। এই দেশের প্রাকৃতিক সম্পদ অনেক দেশের কাছে হিংসার বিষয়। বাংলাদেশের নেতৃত্ব এখন বিশ্বজুড়ে স্বীকৃত। দেশটি এখন পরনির্ভরশীলতার শৃঙ্খল থেকে মুক্ত হবার চেষ্টায় বাজেটের একটি বড় অংশ হিসাব করে অভ্যন্তরীণ আয়ের উৎস থেকে। তাই আন্তর্জাতিক যে কোন ইস্যু বাংলাদেশকে ছুঁয়ে যাবে সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু সে তুলনায় আমাদের প্রস্তুতি কি?

আমাদের দেশে বেশ কয়েক বছর ধরেই চলছে বিরাজনীতিকরণের একটি সূক্ষ্ম প্রক্রিয়া। খুব সচেতনভাবেই সমাজের ক্রিয়াশীল অঙ্গগুলোকে নিষ্ক্রিয় করে দেয়া হয়েছে। তরুণ সমাজের মাঝে রাজনৈতিক সচেতনতা থাকলেও নেই রাজনীতির চর্চা বা আদর্শ। কোন সমাজ বা রাষ্ট্রে যখন রাজনীতির চর্চা থাকে না তখন আপনা থেকেই বাকীসব বন্ধ হয়ে আসে। রাজনৈতিক আদর্শ নির্ধারণ করে আপনি কোন সংস্কৃতিকে ধারণ করবেন।

রাজনৈতিক সংগ্রাম না থাকলে সমাজে রক্তপ্রবাহ জমে থাকা পঁচা বদ্ধ পানির মত হয়ে যায়। আর এই সুযোগেই জন্ম নেয় বিভিন্ন ব্যাকটেরিয়ায়। সেই ব্যাকটেরিয়ায় হতে পারে আপনার শরীরেই জন্মাচ্ছে বা ভিনদেশ থেকে প্রবেশ করছে। আপনি নিজেই হয়তো জানেন না যে আপনি কোন ব্যাকটেরিয়ায় আক্রান্ত। কারণ আপনার সেই ডিটেক্টিভ চোখ নাই।

সারাবিশ্ব এখন তোলপাড় আইসিস আতঙ্কে, তার থেকে বাংলাদেশ আলাদা থাকবে সেটা ভাবার কোন যৌক্তিক কারণ নাই। আইসিস বলি আর আইএস বলি; তারা এখন এমন শক্তিতে বলীয়ান যে চাইলেই যে কোন দেশকে কাঁপিয়ে দিতে সামর্থ রাখে।

তবে বাংলাদেশ আর বাকী দেশগুলি থেকে সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং রাজনৈতিক চেতনার দিক থেকে অনেক আলাদা বৈশিষ্ট্যের। আর সেটাই আমাদের মূল ভরসার জায়গা। এটা কি পরিবারের দায়? নাকি সমাজের দায়? না রাষ্ট্রের?

কোনভাবেই বিষয়টাকে বিচ্ছিন্নভাবে কোন একটা কাঠামোর দায় বলে দেখার উপায় নাই। প্রথমত দেখতে হবে দেশের রাজনীতি কোন লাইনে হাঁটছে? বিভক্তির না ঐক্যের। এখানে সাংস্কৃতিক চর্চার ক্ষেত্রগুলো খোলা কিনা? তরুণ সমাজ আজ কি নিয়ে ভাবছে? তাদের ভাবনাকে পরিচালিত করার জন্য আমাদের সামনে কোন নেতৃত্ব আছে কিনা?

সাধারণ দৃষ্টিতে আমাদের সমাজে আজ কোন অনুকরণীয় চরিত্র নেই। আমাদের ছেলেমেয়েরা আজ কোন মহামানবের বা ক্যারিশমেটিক কোন চরিত্রকে খুঁজে পায় না। তারুণ্য সবসময় অ্যাডভেঞ্চার পছন্দ করে। তারা সবসময় চায় নিজেকে কোন না কোন সৃষ্টিশীল কাজ নিয়ে ব্যস্ত রাখতে। কিন্তু আমরা কি দিতে পারছি সেই সুবিধা?

আমরা ব্যক্তিক হতে হতে আজ বিচ্ছিন্ন। কেউ কারো খোঁজ নেবার সময় নাই। সমাজের সর্বত্র কেবল ঘৃণার আবহ। কিছু হলেই আমরা হয়ে যাচ্ছি নির্দয়। এই যে নিষ্ঠুরতা, তা তো একদিনে তৈরী হয়নি। আমি পরিবারে দেখেছি হিংসা, বন্ধু মহলে দেখেছি হিংসা, রাজনীতিতে দেখেছি হিংসা। আমি শিখবো কার থেকে যে হিংসা নয়, ভালোবাসা দিয়ে জয় করতে হয় নিজের ইচ্ছা!

অনেকেই বলছেন পরিবারের দায় একক, কিন্তু একবার ভেবেছেন কি যে পরিবার আমাকে শিক্ষা দিবে সেই পরিবারের কর্তাব্যক্তিরা কোন আদর্শে বিশ্বাস করে? যে পরিবারে মা-বাবাই জানেনা যে তাদের জন্য কোন জীবনধারাটি আদর্শ, সে কিভাবে তার সন্তানকে শিখাবে?

ছোট একটি ঘটনা বলি, আমার সন্তানের স্কুলে রোযার মাসে কেন ক্লাশ করানো হয়, সেটি নিয়ে অভিভাবকরা অভিযোগ করেছেন। রোযার মাসে কিসের স্কুল? কিন্তু আমি আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে বলি, আমরা কিন্তু ছোটবেলায় রোযায় সারা মাস স্কুল বন্ধ হতে দেখিনি। কারণ তখন পড়াশুনাটা ছিল মুখ্য। আর আজ সরকারীভাবেই সেটা নিয়মে পরিণত করা হচ্ছে। 

আরেকটা ঘটনা, এক ছাত্র স্কুলে পড়া তৈরী করে আসেনি, কারণ জিজ্ঞেস করাতে সে উত্তর দিলো তার বাবা ওই চ্যাপ্টারটি তাকে পড়তে না করেছে। কারণ কি? কারণ ওখানে হিন্দুরা কিভাবে পূজা করে, খৃষ্টানদের জীবনাচরণ ইত্যাদি সম্পর্কে লেখা ছিল। বাচ্চার বাবার জিজ্ঞাসা ছিলো, সে মুসলমান, সে কেনো বিধর্মীদের জীবন সম্পর্কে পড়বে!! এইতো বাংলাদেশ!!।

তবে আমি আশাবাদী, বাংলাদেশের মাটি লড়াই করে জিতে আসার ঐতিহ্য নিয়ে সমৃদ্ধ। আমাদের মধ্যে যতই বিভক্তি থাকুক, প্রয়োজনে আমরা এক হতে জানি। যত আঘাতই আসুক আমরা আবার ঘুরে দাঁড়াবো পূর্ণ শক্তিতে। ’৫২, ’৬৯, ’৭১ এবং সর্বশেষ ২০১৩ আমাকে এই আশাবাদ দিয়েছে। গুলশান বুঝিয়েছে নিজেদের মধ্যে ঐক্য ছাড়া আজ কোন বিকল্প সমাধান নেই।

প্রথম প্রকাশ: চ্যানেল আই অনলাইন