অলক্ষ্মীর ব্রতকথা
প্রকাশ | ০৬ অক্টোবর ২০১৭, ০০:৪৪ | আপডেট: ২৮ নভেম্বর ২০১৭, ১৮:১৩
আমাদেরও কখনো লক্ষ্মীপূজো ছিল। ঠাম্মা বা জেম্মার নরমসরম লালপাড় তসর জড়িয়ে পূজোয় বসা ছিল হাঁটু মুড়ে। ঠাকুরমশাই শান্তির জল ছিটোলে আমরা পায়ে আঁচল চাপা দিতাম, আমরা জানতাম শান্তির জল পায়ে পড়তে নেই। শান্তির জলের অপমান হয়, আর পাপ হয় আমাদের। আমাদের পাপ হলে সংসারে শান্তি থাকে না। সংসারের শান্তি কামনায় মায়েরা আমাদের পুণ্যিপুকুর ব্রত করতে শেখাতো, বৈশাখ মাসভর শিবপূজো করাতো রজঃস্বলা হওয়ার আগেই। রজঃস্বলা হয়ে পড়লে আর মাসভর পূজো করা যাবে না, তাই। তাই রজঃস্বলা হওয়ার আগেই বর চাইয়ে নিত যেন আমরা বড় হয়ে লক্ষ্মী বউ হই। আমরাও সেসব করতাম ভক্তি ভরে। ভক্তিভরে বসে আলপনা দিতাম, ফল কুটতাম। লক্ষ্মীর থালা সাজাতাম। মায় ভাই-দাদারা অলক্ষ্মীকে কুলো বাজিয়ে বিদেয় করতে যেত, আমরা বড়দের মত গায়ে আঁচল জড়িয়ে থাম ধরে চৌকাঠের এপারে দাঁড়িয়ে বলতাম, অলক্ষ্মী দূর হ, মা লক্ষ্মী ঘরে আয়। চৌকাঠের এপারে কারণ লক্ষ্মী মেয়েরা চৌকাঠের ওপারে যায় না।
তারপর আমরা বড় হলাম। আমরা বুঝতে শিখলাম স্লিভলেস টপ আর জিনস পরলে বাড়ির লোকের মাথা কাটা যায়। আমরা শিখলাম যাকে ভালোবেসেছিলাম, সে আমার ভাইটাল স্ট্যাটিসটিক্স নিয়ে বন্ধুদের সাথে ভারী রসালো আলোচনা করতে পারে। আমরা জানলাম, ভালোবাসলেই এক সাথে থাকা যায় না, কারণ 'প্রেম করতে' বাপ মায়ের সম্মতি লাগে না, কিন্তু একসাথে থাকতে লাগে। আমরা জানলাম ভালোবাসার জনও রেপ করতে পারে। আমরা দেখলাম, পরীক্ষায় বা চাকরিতে ছেলেদের টপকে গেলে আমরা জামার প্রথম বোতাম খুলে অ্যাচিভার। আমরা শিখলাম প্রেমিক বা বরের থেকে বেশি সফল হলে সে প্রেম টেকে না। আমরা জানলাম ম্যারিটাল রেপ বলে কিছু হয় না জগতে। আমরা জানলাম গালে পাঁচ আঙুলের দাগ ঢাকার আলাদা মেকআপ হয়। আমরা জানলাম, সেই দাগ না ঢেকে একান্ত কাছের জনের কাছে গেলেও তারা যেন দেখতে পায় নি এমন ভান করতে পারে। আমরা বুঝতে শিখলাম বিবাহবিচ্ছিন্না মানেই চরিত্রহীনা।
আমাদের মধ্যে বেশিরভাগই এসব জেনেশুনেও চৌকাঠের ওপারে থাম ধরে দাঁড়িয়ে রইলো। বাকিরা গুটিগুটি পায়ে কেউ বা মজা পুকুর পাড়ে, কেউ বা আস্তাকুঁড়ে বিদেয় হল। কেউ বা পড়লো নর্দমার ধারটিতে। গিয়ে দেখে, সেখানে পুতুলের সারি। সারি সারি ট্যারা ব্যাঁকা গোবরের তাল। মুখুজ্জ্যে বাড়ির অলক্ষ্মী পুতুল দাঁড়ালো দত্তদের পুতুলের পাশে।
- হ্যাঁ রে, পায়ে অমন লাগলো কী করে?
- পতিদেবতা মেরেছিল। চাকরি করতে দেবে না বলে।
- হাত ধর, চল একসাথে যাই। এ হাতটা ধরিস না যেন, ব্যথা এখনো। প্রেমিক মুচড়ে ভেঙে দিয়েছিল কিনা। নাইট ডিউটি যেতে হত বলে।
গেরস্তরা খুবই দয়ালু। অলক্ষ্মীদের সাথেও একটা করে প্রদীপ দিয়ে যায়। ওরা অলক্ষ্মী কিনা, সেইসব প্রদীপের আলোয় ওদের দিব্যি চলে যায়। এ ওর হাত ধরে, ও তাকে রাস্তা দেখায়। বুড়ি অলক্ষ্মীরা আলো জ্বালিয়ে রাখবে বলে সলতে পাকায় আর গল্প বলে।
আবছা আলোয় অলক্ষ্মীদের নরক-গুলজারি সংসার জমে ওঠে।
দেবশ্রী মিত্রের ফেসবুক থেকে