দরজায় খোদাই করা দুটি শব্দ- ‘ধর্মেই মুক্তি’!
প্রকাশ | ১২ সেপ্টেম্বর ২০১৭, ২২:১৯
ইউরোপে আমার প্রথম আসা ২০১৫ সালে। আসার পর প্রথমবার যখন ছুটি পেলাম, দুই বন্ধুকে নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। তিনজনই ইতিহাস, রাজনীতি নিয়ে পড়াশোনা করতে ভালোবাসি। তাই স্বভাবতই আমাদের গন্তব্য হলো আধুনিক ইতিহাস, রাষ্ট্র চিন্তার পীঠস্থান- গ্রীস। ফেরার পথে জার্মানির কিছু শহরও ঘুরে দেখার ইচ্ছা। প্রাচীন জ্ঞানচর্চা থেকে গণতন্ত্রের উৎসস্থল গ্রীস মনপ্রাণ ভরে দেখে নেওয়ার পর আমরা চললাম জার্মানির দিকে।
দক্ষিণ জার্মানির ব্যস্ততম শহর মিউনিখ। সেখান থেকে ট্রেনে একঘন্টায় নির্জন, প্রাণহীন, ধূসর ডাখাউ। ডাখাউ কনসেনট্রেশান ক্যাম্প। ট্রেন থেকে নেমে ক্যাম্প এলাকায় ঢুকতেই চোখে পড়লো বিশালকার লোহার গেইট। পাশের ফলকের লেখা পড়ে জানালাম, এমন গেইট নাৎসি আমলের সব ক্যাম্পেই ছিল। গেইটের চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ তার গায়ে খোদাই করা তিনটি শব্দ- ‘আরবাইট মাখট ফ্রাই’, মানে শ্রমেই মুক্তি।
আপাতদৃষ্টিতে নিরীহ এই শ্লোগানকে অপব্যবহার করে হিটলারের নাৎসিবাহিনী অমানবিক অত্যাচার করেছিল মানুষের ওপর, একথা আমরা সবাই জানি। জানি কীভাবে শ্রম ও তার সাথে সংযুক্ত মুক্তির মিথ্যে মোড়কে হাতে ধরিয়ে দিয়েছিল ঘৃণ্য শোষণের সর্বোচ্চ নিদর্শন। বর্তমান দক্ষিণ এশিয়ায় একই রকমের মোড়ক নিয়ে সবার মনে-মাথায় বাসা বাঁধছে ধর্ম। বাঁধছে বললে এখন ভুলই হবে, আসলে বেশ কয়েক দশক ধরে সাততলা বাড়ি তুলছে নির্বিঘ্নে।
প্রসঙ্গত, সম্প্রতি বাড়ি ফেরার সময় বেঙ্গালুরু নিবাসী প্রখ্যাত সাংবাদিক-এক্টিভিস্ট গৌরী লঙ্কেশ নিহত হলেন। হিন্দুত্ববাদের বিরুদ্ধে তার ধারালো লেখার কথা কে না শুনেছে আগে! কন্নড় ভাষার সাংবাদিক গৌরী ভারতবর্ষে বাড়তে থাকা উগ্র হিন্দুবাদের বিরুদ্ধে এক লড়াকু সেনানী ছিলেন। তার ধারালো লেখনী তাকে এনে দিয়েছিল হাজতবাসসহ আরো নানা রকমের হেনস্থা। যার শেষ হল বুক-মাথা ঝাঁঝরা করে দেওয়া সাতটি বুলেটে এসে। ঠিক এভাবেই এর আগে মারা গেছেন গোবিন্দ পানসারে, কালবুর্গির মত মানুষেরা। যাদের নিয়ে পৃথিবীর বৃহত্তম গণতন্ত্রের গর্ব করার কথা ছিল, ক্ষমতাসীন আদর্শের হাতে নিহত হলেন তারা। তবে এটা এখন আর শুধু ভারতবর্ষের একার চিত্র নয়।
বিভিন্ন সংবাদপত্রে ছাপা হওয়া গৌরীর নিথর দেহের ছবি দেখতে দেখতে মনে পড়ে যাচ্ছিল ২০১৫’র অভিজিৎ রায়ের লাশের কথা। মনে পড়ছিল পাকিস্তানের সুফি গায়ক আমজাদ সাবরির কথা। জন্মমূহুর্ত থেকে যে দেশগুলো ক্রমাগতভাবে ধর্মভিত্তিক হিংসায় জর্জরিত, সেই দেশের মাটিতে শান্তি, যুক্তি, বহুত্বের বাণী নিয়ে আসা মানুষেরা লাশ হয়ে পড়ে থাকেন। খবরের কাগজে, ফেসবুকে, টুইটারে, টিভি চ্যানেলে মৃত শরীর দেখতে পাই আমরা। হিংসায় অভ্যস্থ আমাদের চোখ শুধু লাশ দেখতে পায় আর শারীরিক মৃত্যুর জন্য বরাদ্দ শোক পালন করেই ক্ষান্ত হয়। বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা সয়লাব হয়ে ওঠে গৌরী ‘নারী’ হিসেবে কেমন ছিলেন, অভিজিৎ রায় কতজনের কাছে অভিজিৎ’দা ছিলেন এবং সাবরির গলায় সুর কত স্বচ্ছন্দ্যে ধরা দিত-এসব আলোচনায়। অথচ মরে যেতে থাকা সত্যের জন্য, যুক্তির জন্য, সভ্যতার জন্য কেউ একফোঁটা চোখের জল ফেলে না। এত মৃত্যু, রক্তপাত যে আসলে একটি মৌলিক, সামগ্রিক সমস্যার দিকে রক্তাক্ত আঙুল তুলে দেখাচ্ছে, তা আমরা দেখেও দেখি না। এছাড়াও আরেকটা জিনিস দেখা যায় সেই লাশগুলির গায়ে…।
গৌরী লঙ্কেশকে হত্যা করা হয় তার বাড়ির দরজার সামনে। সেদিন তাকে গুলি না করা হলে, হয়ত তিনি তার ব্যাগ খুলতেন, ব্যাগ থেকে বাড়ির চাবি বের করে দরজা খুলতেন। ভেতরে ঢুকে দরজার ছিটকিনি আটকে দিলে হয়ত তার মনে হত, তিনি নিরাপদ। অথচ সেদিন এসবের কিছুই হয়নি, হতে দেওয়া হয়নি। গৌরীর বাড়ির গেইট আদতে কেমন জানি না, তবে ভারত-বাংলাদেশ-পাকিস্তানের দরজায় স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি ডাখাউয়ের আদলে খোদাই করা দুটি শব্দ- ‘ধর্মেই মুক্তি’!
নাৎসিবাহিনী জার্মানদের বুঝিয়েছিল তারা উচ্চবংশী, এবং অ-জার্মান সকল ব্যক্তি, শিশু, মহিলা বা অন্যান্য দুর্বল মানুষেরা সবাই নিম্নমানের প্রাণীসমূহ, তাদের প্রাণের কোন দাম নেই, সুতরাং তাদের শোষণ অবধারিত। দক্ষিণ এশিয়ার বর্তমানও ঘৃণার, মিথ্যার গল্প বলে। যুক্তির বিপরীতে অন্ধত্ব কায়েম করতে চাওয়া ভণ্ড ধর্ম ব্যবসায়ীদের সাথে সেদিনের যুদ্ধাপরাধীদের কোন তফাৎ নেই।
ডাখাউ কনসেনট্রেশান ক্যাম্পের একটা বিশাল বড় ঘর আছে, যার দেয়ালজুড়ে শুধু গান, কবিতা লেখা। সে সময় বন্দিদের গান গাওয়ার বা কবিতা লেখার অনুমতি ছিল না। তবুও নিজেদের দৈনন্দিন বাস্তবতার যত প্রশ্ন, দুঃখ, রাগ সবকিছু উজাড় করে দিতেন তারা লুকিয়ে লেখা কবিতায়-গানে। ধরা পড়লে নির্ঘাত মৃত্যু জেনেও বন্দীরা উগরে দিতেন প্রতিবাদ কবিতারূপে। কখনো পরনের কাপড়ে, থালা-বাসনে বা নিজেদের শরীরের চামড়ায়। বিষাক্ত গ্যাস-চেম্বার থেকে সেই বন্দীদের লাশ বেরিয়ে আসলেও কবিতাগুলি বেঁচে থাকত, ঠিক যেমন এখনও আছে।
লাশ হয়ে যাওয়াতে কোন যুদ্ধের শেষ হয় না। অথচ মৃত্যুর পরেও জ্বলন্ত প্রতিবাদ, উদ্ধত প্রশ্ন রেখে দিয়ে যেতে পারাটাই বুঝিয়ে দেয় আসলে কার হাতে রয়েছে ভবিষ্যতের চাবি। ‘শ্রমেই মুক্তি’ শ্লোগান এখন কেবলমাত্র মিউজিয়ামে বন্দী। যে শ্লোগানকে সম্বল করে বিশ্বজয় করতে নেমেছিল নাৎসিবাহিনী, এখন রাস্তাঘাটে তা আওড়ালে কড়া শাস্তি বাঁধা। ‘ধর্মেই মুক্তি’-র ভবিষ্যৎ কী?
প্রথম প্রকাশ: দেশদর্পণ