একটুর জন্য গ্যাং রেপড হওয়া থেকে বেঁচে গেছি
প্রকাশ | ২৭ আগস্ট ২০১৭, ১৪:৪৮
২৩ আগস্ট সন্ধ্যায় আমি একটুর জন্য গ্যাং রেপড হওয়া থেকে বেঁচে গেছি। এর জন্য কৃতজ্ঞতা জানাই বনানী থানার পুলিশদের। উনারা এসে আমাকে না বাঁচালে আমাকে কমপক্ষে ৫০ জন মিলে রেপ করতো। যদিও তারা রেপ এর কাছাকাছি মজাই পাইছে।
ঘটনাটা একটু বিস্তারিত বলি। আমি প্রতিদিন মিরপুর ১০ থেকে বনানীতে টিউশনি করতে যাই। ট্রাস্ট এর আর্মি ওয়েলফেয়ার বাসে করে কাকলীতে নামি, কিন্তু বেশিরভাগ দিনই কাকলী পর্যন্ত বাস যায় না, তার আগে সৈনিক ক্লাব এ নামায়ে দেয়। কাকলীতে গেলে নাকি বাসটাকে মহাখালী ফ্লাইওভার হয়ে ঘুরে আসতে আসতে অনেক সময় লেগে যায়। যাই হোক, সেদিন সন্ধ্যাতেও আমাকে সৈনিক ক্লাব এ নামায়ে দিলো। আমি রাগে গজগজ করতে করতে রাস্তা পার হচ্ছিলাম। তখনই একলো এসে পিছন থেকে আমার পাছায় খুব জোড়ে থাপ্পর দিয়ে জোড়ে হাঁটা শুরু করলো। আমি সাথে সাথে লোকটার পিছনে দৌড়ানো আরম্ভ করলাম। সে যখন দেখলো আমি তার পিছনে দৌড়াচ্ছি সে দৌড়ায়ে রাস্তা পার হয়ে সৈনিক ক্লাব ওভার ব্রিজ এর কাছে চলে গেলো। আমি তখন তার পিছনে পাগলের মতন দৌড়াচ্ছি। এই দৌড়াদৌড়িতে রাস্তার মানুষ মনে করছে ঐ লোক মনে হয় আমার মোবাইল নিয়ে দৌড় দিছে। ওভারব্রিজ এর উপরে তারা ৬-৮ জন মিলে লোকটাকে ধরলো। আমি ততক্ষণে ওভারব্রিজ পর্যন্ত চলে গেছি, আর চিৎকার করতেছি, ওরে ধরে রাখেন, আমি আসতেছি। ৮-১০ জন মিলে দুইপাশ থেকে ছিনতাইকারী সন্দেহে ধরে ছিলো, তারপর আমি যখন ওই লোকের সামনে গিয়ে বললাম যে, সে আমার গায়ে হাত দিছে, তখন তারা বললো, "ওহ, হায়ে হাত দিছে? মোবাইল নেয় নাই? আমরা তো ভাবছি মোবাইল টান দিছে তাই ধরছি"। যেন গায়ে হাত দেওয়া কোনও ঘটনাই না, একটা মেয়ে রাস্তায় বের হলে একটু আধটু গায়ে হাত দেওয়াই যায়।
তার পরের ঘটনা শুনেন, আমি তখনই বুঝতে পারছিলাম এরা এই লোককে ছেড়ে দিবে, আমি কিছুই করতে পারবো না। আমার পিপার স্প্রে আমার হাতেই ছিলো, আমি লোকটার চোখে মরিচের গুড়া স্প্রে করে দিলাম। যেহেতু আশে পাশে মানুষ ছিলো, তাদের গায়েও কিছুটা স্প্রে লাগছিলো।
এতক্ষণ আমি ছিলাম ভিকটিম, ওই লোক ছিলো ছিনতাইকারী। এইবার ওই লোক হয়ে গেলো ভিকটিম, আর আমি হয়ে গেলাম মলম পার্টি! কারণ, এই ক্ষ্যাত, অশিক্ষিত বাঙ্গালি পিপার স্প্রে কী জিনিষ তা জানেই না। এইবার তারা বুঝলো যে আমি মলম পার্টি হই, আর যাই হই আমাকে ইচ্ছামতন রেপ করা যাবে, আমার টাকা-পয়সা, মোবাইল সব কেড়ে নেওয়া যাবে। ২০-৩০ জন আমাকে চারপাশ থেকে ঘিরে ধরলো, আমাকে বেশ্যা, খানকি, প্রস্টিটিউট বলে গালি দিলো, আমার ব্যাগ টান দেওয়ার চেষ্টা করলো, আমার ওড়না ধরে টান দিলো, আমাকে বেশ কয়েকটা থাপ্পড় দিলো, আমার বুকে, গায়ে, পাছায় ইচ্ছামতন হাতড়ালো, চুলের মুঠি ধরে এক দোকানের শাটারের সাথে মাথা ঠুকে দিলো, লাথি দিয়ে রাস্তায় ফেলে দিলো, রাস্তায় ফেলে আরো ২-৩টা লাথি দিলো, তারপর বললো, “তুই আজকে শেষ, আজকে তোকে ইচ্ছামতন চু**, তারপর তোর গলা টিপে মেরে তোরে ড্রেইনে ফেলে দিবো।”, এরমধ্যে তো মারধোর, আর বুকে-গায়ে-পাছায় হাতানো চলছেই। পুরা ঘটনাটা তারা আবার অনেকে মোবাইলে ভিডিও-ও করছিলো।
তখনই বনানী থানার থেকে পুলিশ এসে সবাইকে লাঠিচার্জ করে আমাকে সেই রেপিস্টদের ভিতর থেকে উদ্ধার করলো, টানতে টানতে পুলিশের জীপে নিয়ে গেলো, ধাক্কা দিয়ে জীপের ভিতরে ফেলে দিলো, এর জন্য পুলিশদের প্রতি আমার বিন্দুমাত্র অভিযোগও নাই, তারা মলমপার্টির গ্যাংদেরকে এভাবেই ধরে। এমনকী তারা পুলিশের জীপে উঠানোর পর আমাকে হ্যান্ডকাফও পরায় নাই, গায়েও হাত দেয় নাই, পানি খেতে চাইছি, পানিও খেতে দিছে।
তারপর বনানী থানায় নিয়ে গিয়ে আমাকে প্রথমে ওসির সামনে নিয়ে গেলো, ওসি আমাকে জিজ্ঞেস করলো, “এই ব্যবসা কতদিন ধরে করিস?” আমি বললাম, “আমি কোন মলমপার্টি না, আমি এখানে পড়াতে আসছি, আমাকে শুধু একটা ফোন করতে দেন আমার বাসায়, ওরা এসে সব বুঝায়ে দিবে।” তারা তখনও বিশ্বাস করে না, কারণ বাংলাদেশের পুলিশ আজ পর্যন্ত পিপার স্প্রে এর নামই শুনে নাই, চোখে দেখা তো দূরের কথা। আত্মরক্ষার জন্যও যে কেউ নিজের সাথে এই জিনিস রাখতে পারে তা তাদের মাথায়ও আসে নাই। আসবে কী করে? পিপার স্প্রে কী জিনিস তারা কী জানে নাকী? তাদেরকে কি এই বিষয়ে কোন ধারণা দেওয়া হয়েছে? তারা কী জানে যে, প্রথম বিশ্বের প্রতিটা মেয়ে তো বটেই, এমনকী, পুলিশরাও অনেক সময় পিপার স্প্রে ব্যবহার করে।
তারপরে তারা আমার সমস্ত জিনিসপত্র, ব্যাগ, মোবাইল, এমনকী পানির বোতল কেড়ে নিয়ে আমাকে লক-আপে ঢুকালো, বাংলাদেশের সংবিধান অনুসারে যেকোন ব্যক্তিকে অ্যারেস্ট করলে সে একটা টেলিফোন কল করার অধিকার রাখে, কিন্তু আমাকে একটা ফোনও কেউ করতে দেয় নাই। আমার “আম্মা, আম্মা” বলে কান্নাকাটিতে এক কনস্টেবল খুব দয়াপরবশ হয়ে আমার বোনের ফোন নাম্বার নিয়েছিলো, উনিই পরে আমার দিপ্তী আপুকে কল দেয়, আপু আম্মুকে কল দেয়, আম্মু তখন আমার খালা-খালুকে নিয়ে বনানী থানায় রওনা দিছে। এরমধ্যে তদন্ত অফিসার আমাকে জিজ্ঞাসাবাদ এর জন্য ডাকলো, যেহেতু তারা আমার ব্যাগ চেক করে সন্দেহজনক কিছু পায় নাই, সেহেতু তাদের মনে হইছে আমি মলম পার্টি নাও হতে পারি। আমাকে জিজ্ঞেস করলো, বাসা কই, বনানীতে কেন আসছি, কোন বাসায় পড়াই, তারপর আমার ছাত্রর মায়ের সাথে কথা বলে নিশ্চিত হলো যে আমি আসলেই টিউশনি করতেই যাচ্ছিলাম, এরমধ্যে আম্মু আসলো, আমার বান্ধবীর বড়বোনের হাসব্যান্ড ইত্তেফাক পত্রিকার ফিচার এডিটার বনানী থানায় ফোন দিলেন, আমার বান্ধবী আর বান্ধবীর হাসব্যান্ড আসলো, তারপর সবার সাক্ষী রেখে আমার কাছ থেকে মুচলেকা নিয়ে আমাকে জামিন দেওয়া হলো। সব শেষ করে রাত ২টার সময় আমি বাসায় পৌছালাম।
আমি জানি এখন আপনাদের একেকজনের মনে একেক ধরণের প্রশ্ন আসবে। প্রতিনিয়ত ঘটা অসংখ্য ইভ টিজিং এবং ধর্ষণ এর বিবরণ দেখে আমি নিজ থেকেই এই প্রশ্নগুলো আন্দাজ করতে পারি। এবং উত্তর সাথে করেই দিয়ে দিচ্ছি।
১) আমার বাইরে যাওয়ার দরকার কী ছিলো?
: আমাকে বাইরে যেতে হয় কারণ আমার বাবার টাকা নাই। ইনফ্যাক্ট আমার বাপই নাই। সে ১৪ বছর আগে এক মধ্যরাতে স্ট্রোক করে মারা গেছে, এবং সে যেহেতু ঘুষখোর সরকারী চাকরি করতো না, ধান্দাবাজি করতো না, সৎভাবে ব্যবসা করতো, ফুটবল আর হকিখেলা নিয়ে পড়ে থাকতো (Goal-keeper, Bangladesh National team) সেহেতু সে খুব বেশি টাকা-পয়সা আমার জন্য রেখে যেতে পারে নাই। এই নিয়ে আমার মনে আমার বাপের প্রতি বিন্দুমাত্র রাগ নাই, কারণ আমি নিজের পরিশ্রমে, নিজের পায়ে দাঁড়াতে চাই। আর যেহেতু আমি অংক করা, পাঠ্যবই পড়া এবং হাজার হাজার গল্পের বই পড়া ছাড়া আর কিছু পারি না, সুতরাং আমাকে টিউশনি আর আউটসোর্সিং করেই নিজের খরচ চালাতে হয়। এখন আমি বাইরে না গেলে আমার এই টাকা কী আপনি দিবেন? দিলে বলেন, আমার ব্যাংক একাউন্ট নাম্বার পাঠায়ে দিচ্ছি।
২) আমার কী পোশাক পড়া ছিলো?
: আমার পোশাকের যে বিবরণ আমি দিবো, তা অনেকের কাছে খুব বাজে পোশাক আবার অনেক কাছে খুবই সাধারণ পোশাক। আমি একটা হাফ স্লিভ এর সাদা টপস, একটা মোটা লেগিংস আর একটা ওড়না পরা ছিলাম। চাইলে প্রত্যেকটার ছবি আলাদা করে আপলোড করতে পারি।
কিন্তু আমাকে এই প্রশ্ন করার আগে আপনি আমাকে উত্তর দেন, তনু কেন সালোয়ার-কামিজ আর হিজাব পরেও রেপড হইলো? ৫ বছরের পূজার পোশাকের কী দোষ ছিলো? স্কুলের মেয়েরা ইউনিফর্ম পড়েও ইভটিজিং এর শিকার হয় কেন? আমার মা বোরখা পরে বাইরে বের হলেও কেন তার ছেলের বয়সী ‘পুরুষ’ আমার মায়ের বুকে হাত দেয়?
৩) এত রাতে (সন্ধ্যা সাড়ে ৭টা) পড়াতে যাওয়ার কী দরকার?
: সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় পড়াতে যাওয়ার কারণ হলো, আমার ছাত্রের স্কুল ছুটিই হয় দুপুর ৩:২০ এ, ঢাকা শহরের জ্যামের কল্যাণে সে বাসায় পৌছায় সাড়ে ৪টায়। তারপর গোসল-খাওয়া-ঘুম শেষ করতে তাকে কমপক্ষে ২ ঘন্টা সময় না দিলে তার পড়ায় মন দিতে পাড়ার কথা না। এদিকে, আমার বহুদিনের কমপ্লেইন যেটা ছিলো, কচুক্ষেত দিয়ে ক্যান্টনমেন্ট এ প্রবেশ এর সময় এবং আর্মি ওয়েলফেয়ার ট্রাস্ট এর বাসের স্বেচ্ছাচারিতায় আমার ৩০ মিনিটের রাস্তা যেতে লাগে দেড় ঘন্টা। সুতরাং, আমি সন্ধ্যা ৬টায় রওনা দিলে সাড়ে ৭টাতেই পৌছানোর কথা।
এবার আপনি আমার প্রশ্নের উত্তর দেন, ঢাকা শহরে কী দিনের বেলায় রাস্তাঘাটে মেয়েদের ইভটিজিং এর শিকার হতে হয় না? বাসে্র ভিড়ে মেয়েদের গায়ে হাত দেওয়া হয় না? দিনের বেলার কোন রেপ হয় না? পরিমল জয়ধর ভিকারুন্নেসার যে ছাত্রীকে রেপ করছিলো, তা-কি রাতেরবেলা করছিলো?
৪) গায়ে হাত দিছে, সহ্য করলেই হতো, পিছন পিছন দৌড়ানোর কী দরকার ছিলো?
: যদি বলেন যে গায়ে হাত দিছিলো চুপচাপ মাথা নিচু করে চলে আসলেন না কেন? তাহলে আমি খুব মনেপ্রাণে দোয়া করবো আপনার যেন ভবিষ্যতে একটা কন্যাসন্তান অথবা নাতনী হয়। সে কাজে যাওয়ার সময় যখন কোনও এক পটেনশিয়াল রেপিস্ট তার কানে কানে বলবে, “তোকে চু*তে পারলে খুব মজা লাগতো”, অথবা তার ওড়না ধরে টান দিবে, অথবা তার বুকে হাত দিবে, অথবা তার পাছায় বাড়ি দিবে, এবং আপনার মেয়ে যখন কাঁদোকাঁদো মুখে বাসায় ফিরবে কিন্তু লজ্জায় বলতেও পারবে না, বাথরুমে গিয়ে ঝরনার নিচে দাঁড়ায়ে ফুঁপাতে ফুঁপাতে সারাগায়ে সাবান ঘষবে, তারপরেও যখন তার মনে হবে যে সে এখনও অপবিত্র এবং সে নিজেকে ঘিন্না করা শুরু করবে, একসময় মেয়ে হয়ে জন্মানোর জন্য নিজেকে, নিজের ভাগ্যকে অভিশাপ দিবে, প্রতিনিয়ত হয় নোংরা দৃষ্টি, নাহয় নোংরা মন্তব্য, নাহয় অপরিচিত হাতের নোংরা থাবা সহ্য করতে করতে যখন এই পৃথিবীতে মেয়ে হয়ে জন্মানোটাই ভুল এই ভেবে ডিপ্রেশনে চলে যাবে, এবং এক পর্যায়ে ফ্যানের সাথে শাড়ি পেঁচায়ে ঝুলে পড়বে, তখন আপনি বুঝবেন কেন আমি চুপচাপ মাথা নিচু করে চলে আসি নাই। আমি ইভ-টিজিং এর শিকার হইছি এটা ঠিক, কিন্তু আমি মাথা নিচু করে চলে আসি নাই, আমি ওই ইভটিজারের পিছন পিছনে দৌড়াইছি, তার চোখে মরিচের গুড়া স্প্রে করে তাকে হাসপাতালে পাঠাইছি, কাকলী এলাকার পটেনসিয়াল রেপিস্টরা আমাকে ইচ্ছামতন মোলেস্ট করছে, মারছে, গালি দিছে এটা ঠিক, কিন্তু ওই লোক এরপর আর কোন মেয়ের গায়ে হাত দেওয়ার আগে ২বার ভাববে। আমি বনানী থানার লক-আপে ২ঘন্টা ছিলাম এটা নিয়ে আমার কোন আফসোস নাই, অনেক অভিজ্ঞতাই তো হইছে জীবনে, একটু মলমপার্টি সন্দেহে হাজতে থাকার অভিজ্ঞতাও হলো।
একটু চিন্তা করে দেখেন তো, আমার কী ঠ্যাকা পড়ছিলো, ওই লোকের পিছনে দৌড়ানোর? আমি প্রায়ই ফেসবুকে কমপ্লেইনিং পোস্ট দেই, এইজন্য আমি অনেকের খুব অপ্রিয়, কিন্তু আমার কী ঠ্যাকা পড়ছে এভাবে করে মানুষকে শুধু নেগেটিভ কথা শুনায়ে সবার অপ্রিয় ঝগড়াটে হিসাবে পরিচিত হওয়ার? নাকি লাইক আর ফলোয়ার বাড়ায়ে সেলিব্রিটি হওয়ার জন্য? এই ফেম পেয়ে আমার কী হবে? আমার মরা বাপ জিন্দা হবে? আমার মায়ের ওষুধ এর খরচ আসবে? আমার ব্যাংক একাউন্ট এর ব্যালেন্স বাড়বে??
আমি এত কমপ্লেইন করি আপনার ভবিষ্যৎ সন্তান এবং তাদের সন্তানদের জন্য। চিৎকার করে, আপনাদের কান ঝালাপালা করে, রাস্তায় মারামারি করে, সেটা নিয়ে ফেসবুকে বিশাল পোস্ট দিয়ে আমি আপনাকে সচেতন করতে চাই। একটা সুন্দর, বাসযোগ্য সমাজ পাওয়ার জন্য ২-৪ টা তানজিম কোরবানি হয়ে গেলেও কিছু আসে যায় না। কিন্তু দয়া করে আমার এই অপমান, এই গ্লানিকে নিজের রাগ আর শক্তি বানান। আপনার বাচ্চাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করুন। আপনার বাচ্চারা কোথাও নিরাপদ না, কোত্থাও না। একটু সচেতন হন, তাদের মার্শাল আর্ট শেখান, পিপার স্প্রে এর লাইসেন্স করায়ে বাংলাদেশে মেয়েদের জন্য বৈধ করেন, আর শুধু ছেলেদেরকে বলছি, কাউকে মলমপার্টি সন্দেহ হলেই যে তাকে এভাবে শারীরিকভাবে মোলেস্ট করতে হবে বা গণপিটুনি দিতে হবে এমন কোনও কথা নাই। দেশে আইন নাই? আপনি কে মারার, গায়ে হাত দেওয়ার? আপনার মনে হচ্ছে এই মেয়েটা বেশ্যা, আপনি তাকে বেঁধে রেখে পুলিশে দেন। আপনাকে কে বলছে বিচার করতে????
*(চুপিচুপি একটা সত্যি কথা বলি? লক-আপের মধ্যে আমার একটুও ভয় লাগে নাই, কারণ আমি জানতাম যে এরা আমার কোন ক্ষতি করবে না, ক্ষতি করতে চাইলে পুলিশ এর জীপে উঠায়েই করতে পারতো। আমি লক-আপে বসে কাঁদতেছিলাম, একটু আগে আমার সাথে হয়ে যাওয়া নারকীয় ঘটনার কথা মনে করে। ঠিক সময়ে পুলিশ এসে লাঠিচার্জ করে ওই সবগুলা লোককে না সরালে, ওই ৫০ জন মিলে আমাকে ওখানেই রেপ করে, ছিঁড়ে-খুঁড়ে খেয়ে ফেলতো।)
৫) সবাই যখন ওই লোককে ধরেই ফেলছিলো, আমি আমি আবার চোখে পিপার স্প্রে করতে গেলাম কেন?
: সবাই ওই লোককে ধরে ফেলার পরেও আমি কেন স্প্রে করলাম? কারণ, ওই ৮-১০ জন লোকটাকে ধরছিলো ছিনতাইকারি সন্দেহে, পরে যখন তারা শুনলো যে এইলোক ছিনতাইকারী না, আমার গায়ে হাত দিছে, তখন তারা আদর করে তাকে ছেড়ে দিচ্ছিলো। যেন মোবাইল ছিনতাই অনেক বড় অপরাদ, কিন্তু একটা মেয়েকে শারীরিকভাবে অপমান করা কোনও ঘটনাই না। রাস্তাঘাটে যেসব মেয়ে বের হয়, তারা তো রাস্তার পুরুষদের বাপের সম্পত্তি। তাদেরকে পাছায় থাপ্পড় দেওয়া যায়, বুক চেপে ধরা যায়, ইচ্ছা করলে রেপও করা যায় (তাদের এই প্রমাণ তো একটু পরেই পেলাম)। এইসব আমাদের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর ভাষায় ছেলেপিলের দুষ্টুমী, এই সামান্য দুষ্টুমী করার জন্য কি আর তাকে আটকে রাখা যায়? মোবাইল নিলে বরং একটা কথা ছিলো, ইভটিজিং একটা বিষয় হলো? তখন আমি সেই ইভটিজারের চোখে মরিচের গুড়া স্প্রে করে দিলাম, এবং সাথে সাথে হয়ে গেলাম মলমপার্টি।
আমি জানি এখন আমাকে আপনারা সবাই মিলে কিছু সান্ত্বনা দিবেন, কিছু উপদেশ দিবেন, কিছু বকা দিবেন, কেউ মনে মনে খুশি হবেন ভেবে যে “যাক, ঝগড়াটে মেয়েটার একটা শিক্ষা হইছে।”, আবার কেউ আমার এই মুহূর্তের ট্রমাকে কিছুটা হলেও অনুভব করতে পেরে ভীষণ হতাশায় ডুবে যাবেন। কিন্তু একটা অনুরোধ, কেউ আমাকে কল দিবেন না, আমি এই মুহুর্তে অসম্ভব শারীরিক এবং মানসিক ট্রমায় আছি, আমার কথা বলার অবস্থা নাই। আমার সারা গায়ে ব্যাথা, মাথার একসাইড ফুলে ব্যাথায় টনটন করছে, হাতের কবজি মনে হচ্ছে খুলে যাবে, পায়ের ব্যাথায় দাঁড়াতে পারছি না, অনেক কষ্টে এই লেখাটা লিখেছি।
আর একটা অনুরোধ, যদি কেউ “মলমপার্টির মহিলাকে হাতে-নাতে ধরলো জনতা” এই শিরোনামে কোনও ভিডিও দেখেন তাহলে দয়া করে ওই ভিডিওটার লিংক আমার কাছে পাঠিয়ে, ভিডিওটা রিপোর্ট করবেন। তাহলে হয়তবা আমি ওই পটেনশিয়াল রেপিস্টদের নাম-পরিচয় পুলিশের কাছে দিতে পারবো।
শেষে একটা পরামর্শ চাচ্ছি। এই অভিজ্ঞতার পর, আমার কী এখন থেকে কাজকর্ম বন্ধ করে দিয়ে বাসায় বসে থাকা উচিত? নাকি বোরকা-হিজাব পড়ে মাটির দিকে চোখ নামায়ে বাইরে বের হওয়া উচিত? নাকি, টিউশনি বাদ দিয়ে, নিজের সারাজীবনে যা পড়াশোনা করছি, সব বৃথা যেতে দিয়ে কোন এক মুদির দোকানদারকে বিয়ে করে সংসারী হয়ে বাইরের জগৎ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া উচিত? নাকি রাস্তাঘাটে কেউ কোন বাজে মন্তব্য করলে, না শোনার ভান করে চুপচাপ চলে আসা উচিত? নাকি, এই পৃথিবীটা এরকমই, এখানে আমার মতন ভুল সময়ে-ভুল জায়গায় জন্মানো মেয়েদের জন্য কোনও নিরাপত্তা নাই, এটা ভেবে গলায় ফাঁস নেওয়া উচিত? অন্যের দ্বারা গ্যাং রেপড এবং খুন হওয়ার থেকে নিজেই নিজেকে মেরে ফেলা ভালো না?
তানজিম নাঈমাহ এর ফেসবুক থেকে