একাই মেয়েদের সাহসী করেছেন তসলিমা নাসরিন

প্রকাশ | ২৫ আগস্ট ২০১৭, ১২:৫০

(১) 
তসলিমা নাসরিনের জন্মদিন আজকে? তসলিমা আপনি যদি এই পোস্টটি দেখেন তাইলে আমার অভিনন্দন গ্রহণ করুন। শুভ জন্মদিন। আমি যে কেবল নিজে শুভ জন্মদিন জানাচ্ছি সেটা নয়- আমি আপনাকে শুভ জন্মদিন জানাচ্ছি আমার দুই কন্যার পক্ষ থেকে, আমার প্রিয়তমা স্ত্রীর পক্ষ থেকে, এবং আমার হতভাগী জননীর পক্ষ থেকে। হতভাগী জননী কেন বলছি? কারণ তিনি যখন জন্মেছেন তখন নারীর অবস্থা আরও ভয়াবহ ছিল। এমনিতে দৃশ্যমান কোন অত্যাচার তাঁকে হয়তো সহ্য করতে হয়নি। আমার মা ওঁর পাঁচ বোনের মধ্যে বড় বোন আর এদের কোন ভাই নাই। আমি সেই শৈশব থেকেই দেখেছি আমার নানা যখন জীবিত ছিলেন- পুত্র সন্তান নেই বলে তার সে কি কষ্ট! আর সেই কষ্ট তার কন্যাদের উপর যে প্রতিক্রিয়া করেছে সেটা কম নির্যাতন নয়। যে ওদের একটা ভাই না থাকা ওদেরই অপরাধ।

আর শুধু নারীদের কথা কেন বলি। আপনার প্রতি আমাদের সকলেরই তো ভালোবাসা থাকার কথা। আমরা মানে বাংলাদেশে যারা আমরা মানুষের মুক্তি আর লিবার্টির কথা বলি, নারীকে মানুষ বিবেচনা করি, আমরা সকলেই। আমাদের সকলের পক্ষ থেকে শুভ জন্মদিন আপনাকে তসলিমা। অভিনন্দন। শুভেচ্ছা। আপনি বেচে থাকুন আরও শ খানেক বছর। সুস্থ্য থাকুন। শক্ত থাকুন। সারা দুনিয়ার মৌলবাদী আর পুরুষবাদী ষণ্ডগুলির চোখে জ্বালা ধরিয়ে স্বাধীনভাবে বিচরণ করতে থাকুন পৃথিবীর এই কোন থেকে আরেক কোনে। লিখতে থাকুন- যেগুলি ওরা পড়বে না না বটে, আপনার লেখার কথা লোকমুখে শুনে শুনেই ওদের মুখ চোখ আর ঐসব ঝালে জ্বলে যাক। আপনার জয় হোক।

(২) 
তসলিমা নাসরিন তো জন্মেছেন বেশ কয়েক বছর আগেই আরকি। এতো বছর তাঁকে কোনদিন শুভ জন্মদিন বললাম না, এইবছর কেন এইরকম ঘটা করে স্তুতিবাক্যের মতো লিখতে বসেছি সকাল বেলাতেই? তিনি যে তসলিমা হয়েছেন সেও তো অনেক বছর হয়ে গেল। তিনি যে দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়েছে তারও তো সময় কম হলোনা। আজকে এই বছর কেন মনে হলো এই লেখককে শুভ জন্মদিন বলি। কারণ আছে।

এই বছর তসলিমা নাসরিনের প্রাসঙ্গিকতা অনুভব করেছি নানাভাবে। আপনার তো লক্ষ্য করেইছেন যে আমাদের দেশে এইসবময় বেশ কিছু ঘটনা প্রবাদ ঘটেছে যেগুলি থেকে নারীর অধিকার, নারীবাদ, নারী আন্দোলন, নারীরই লেখালেখি এইসব কথা দেশের পড়ালেখা করা মানুষদের মধ্যে খুব আলোচনা হচ্ছে। আর গালাগালি। মেয়েরা যারা টুকটাক লিখছেন, উইম্যান চ্যাপ্টারে বা অন্যত্র, যারা প্রথা মানতে চাইছেন না- ওদেরকে গালাগালি করছেন আমাদের বীরপুরুষেরা। স্যুডো লিবারেলদের মুখোস খুলে যাচ্ছে। এরা কিছুদিন পরপর একেকজন নারী এক্টিভিস্ট বা নারী লেখককে ধরে তাঁর চৌদ্দ গুষ্টি উদ্ধার করে ফেলতে চাইছে। এইরকম একটা সময়ে তসলিমা নাসরিনের কথা মনে হবে না তো কার কথা মনে হবে?

আরেকটা কারণে তসলিমাকে খুব মনে পড়ছে গত কয়েকদিন ধরে। ইনটলারেন্স। কারো সাথে কোন একটা ইস্যুতে মতপার্থক্য দেখা দিল তো ব্যাস। হায়রে প্রতিক্রিয়া। মানুষের নীচতা আর নিষ্ঠুরতা আর সঙ্কীর্ণতা যে কতপ্রকার হতে পারে, সেসব দেখতে পাচ্ছি আজকাল। যাদেরকে ভাবতাম লিবারেল সেক্যুলার বন্ধু, ওরা এখন দেখছি চীফ জাস্টিসের সাপ্রদায়িক পরিচয় এথনিক পরিচয় এইসব ধরে গালাগালি করছে। যে দলের এমপিরা ১৯৭৯ পার্লামেন্টে পঞ্চম সংশোধনীর সময় কন্সটিটিউশনে বিসমিল্লা ঢুকানোর বিরোধিতা করেছেন, সেই তোলের এমপিরা এখন বিসমিল্লাহকে ডিফেন্ড করে ভয়াবহ সব ধমক দিচ্ছে চীফ জাস্টিসকে।

এইসব কথা সাথে তসলিমা নাসরিনের সম্পর্ক কি? তসলিমা নাসরিন বলেছেন। বিভিন্ন সময় বলেছেন স্পষ্ট করে। যে না, আমাদের এই লোকগুলি দেখতে ভালো মনে হলেও আসলে ভাল না। এদের টলারেন্স নাই, এদের গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ নাই, এদের ভদ্রতা জ্ঞান না, এরা চূড়ান্ত সাম্প্রদায়িক। তখন ভেবেছি না, এতোটা ইয়ে না, তসলিমা নিজে ভুগেছেন বলে হয়তো রাগে বেশী বলছেন।

এখন তো দেখছি যে না, তসলিমার কথাই ঠিক। চারপাশে মানুষ খুঁজে পাই না। শুধু শিশ্ন উঁচানো পুরুষ আর টুপি মাথায় মুসলমান আর এদের অনুগত কিছু দাসী। মানুষ কই?

(৩) 
আর ঐ যে বললাম তসলিমা নিজে ভুগেছেন- তাঁর প্রতি অত্যাচারের ভয়াবহতা আগে বুঝতে পারিনি। অন্যায় হচ্ছে, ভিন্নমতের জন্যে তাঁর প্রতি অন্যায় আচরণ করছে রাষ্ট্র, সমাজ ও সকল প্রথা প্রতিষ্ঠান। সেটা তো ঠিক আছে। কিন্তু এই অন্যায়ের মাত্রাটা বুঝতে পারতাম না।

এখন চিন্তা করি, কতোই বা বয়স তখন তসলিমার! আজ থেকে বছর বিশেক আগের কথা। কম বয়সী একটা লেখক মেয়ে, ঢাকা শহরে একা একা বাস করে। একদিকে ওঁর চাকরিটা চলে গেল, আরেকদিকে ওকে হত্যা করার জন্যে ঘোষণা দিয়ে ঘাতক লেলিয়ে দিয়েছে মোল্লারা, আরেকদিকে পুলিশ ওকে খুঁজে বেড়াচ্ছে গ্রেফতার করবে বলে। ভাবতে পারেন! কতোই বা বয়স তখন তসলিমার? রাটায় বেড় হতে পারছেন না, কে কখন মারতে আসে। এই বুঝি কেউ গুলি করলো, এই বুঝি কেউ ঝাঁপিয়ে পড়লো চাপাতি হাতে। এই সবকিছুই সেই কমবয়সী মেয়েটি একা একাই মোকাবেলা করেছেন।

একা একাই তো। সেসময় তিনি দেখেছেন যাদেরকে তিনি বন্ধু ভেবেছেন ওরা সরে যাচ্ছে। যাদেরকে ভেবেছেন সেক্যুলার সাহসী লিবারেল- দেখা গেলো ওদের আসল চেহারা হচ্ছে লোভী পুরুষবাদি আপোষকারী ভীরু কাপুরুষ। সকলেই ত্যাগ করছে তসলিমাকে। প্রায় একা- সেই ভয়াবহ পরিস্থিতেও তিনি এই ঢাকা শহরে ছিলেন, আপোষ করেননি। মাথা নিচু করেননি। পালিয়ে যেতে চাননি। না, দেশ ত্যাগ তাঁকে করতে হয়েছে- কিন্তু সেটা তিনি ইচ্ছা করে করেননি। তাঁকে একরকম জোর করেই দেশ থেকে বের করে দিয়েছে। তিনি থাকতে চেয়েছিলেন এই দেশেই- এখানে এই বাংলাদেশে।

সম্প্রতি আমার বিরুদ্ধে একটা মামলা হয়েছে- ৫৭ ধারায়। মামলার পরপর জামিন না নেওয়া পর্যন্ত দেখেছি, আমার চারপাশের অনেকেই ভয় পেয়েছেন। আমাকে বলছেন, এইসব বন্ধ কর, কি দরকার ইত্যাদি। কিন্তু উল্টাদিকে আবার অনেক বন্ধুরা, দেশে ও বিদেশে, অকপটে সংহতি জানিয়েছেন। খোদ খাগড়াছড়িতে প্রশাসনের মধ্যে থেকেও কেউ কেউ গোপনে বলেছেন, চিন্তা করবেন না, আমরা আছি। আমি সেসময় খুব আবেগে আক্রান্ত থাকতাম- এতো মানুষ আমার প্রতি ভালোবাসা জানাচ্ছে, ব্যাপারটা ক্যামন লাগতো। আমি তো লেখক না, রাজনৈতিক নেতা না, অভিনেতা বা খেলোয়াড় না, কিছুই না। শুধু ফেসবুক। মানুষ আমাকে কেন ভালবাসবে!

তখন তসলিমার কথা মনে হতো। আমি একজন স্বচ্ছল বয়স্ক ব্যক্তি, খানিকটা প্রভাব ইত্যাদিও আছে। আমার বিরুদ্ধে কেউ জ্বেহাদও ঘোষণা করেনি, কেউ আমাকে হত্যার হুমকিও দেয়নি এবং, দৃশ্যত, সরকারও যে আমাকে মারতে চাচ্ছে সেটাও মনে হয় না। শুধু একটা মামলা তাইতেই এইরকম? তসলিমার তাইলে তখন কি অবস্থা ছিল! সেই কমবয়সী মেয়েটি কি অবস্থার মধ্যে দিয়ে গেছে সেটা ভেবে আমার গা শিউরে উঠত। শ্রদ্ধায় মাথা নত হয়ে আসতো তাঁর সাহসিকতার কথা ভেবে। আমি একরকম প্রেরণা পেতাম সেই কয়েকটা দিন।

(৪) 
প্রেরণার কথাই যদি বলি, হ্যাঁ, প্রেরণা তো তিনি যুগিয়েছেন। আমাদের মেয়েদের মধ্যে তিনি একাই একরকম একটা সচেতন সাহসিকতা তৈরি করেছেন। তাঁর লেখার কন্টেন্ট নিয়ে, কোন কোন ইস্যুতে অনেকে দ্বিমত করে, সেতো হতেই পারে। কিন্তু তিনি কি আমাদের মেয়েদের মধ্যে সচেতনতা আর সাহসিকতা তৈরি করেন নি? বিদ্রোহের বীজ কি তিনি ছড়িয়ে দেননি দেশের জেনানা মহলে? দিয়েছেন।

একজন তসলিমা নাসরিন আর এক পিস নির্বাচিত কলাম আমাদের বদ্ধ গতিহীন পুতিগন্ধময় পচা সমাজটিকে যতটুকু ঝাঁকুনি দিয়েছে তার ব্যাপ্তি বুঝতে পারেন? পুরোটা এখনো পারবেন না। সেই স্কেল এখনো আমাদের হাতে নেই। কিন্তু সেদিন বেশী দুরে নয়, যেদিন আমরা বুঝতে পারবো বলতে পারবো আমাদেরকে অগ্রসর করে নেওয়ার জন্যে তসলিমার কন্ট্রিবিউশন কতোটুকু। মনেপ্রাণে চাই, তসলিমা বেচে থাকুন, সুস্থ্য থাকুন, আমদের সাথেই থাকুন।

আমার মেয়েরা বা ওদের মেয়েরা যেদিন শেষ মিছিলটা নিয়ে যাবে পুরুষতন্ত্র আর পিতৃত্ববাদের জগদ্দল হঠাবে বলে- সেদিন আপনি থাকুন তসলিমা। থুত্থুরে বুড়ী হয়ে যান, তবু থাকুন। আপনি সম্ভবত জানেন না, আমার মেয়েদের জন্যে আপনি কতো জরুরী।

শুভ জন্মদিন তসলিমা নাসরিন। সেলাম।

লেখক: আইনজীবী