বঙ্গবন্ধুর অনুপ্রেরণা ছিলেন বঙ্গমাতা ফজিলাতুন্নেছা
প্রকাশ | ১১ আগস্ট ২০১৭, ২১:২৭ | আপডেট: ০৮ আগস্ট ২০২০, ১২:২৭
স্বাধীন বাংলাদেশের রূপকার জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দেশ ও স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনে অসামান্য অবদানের জন্য যে নারীর ত্যাগ, অবদান ও প্রেরণার কাছে ঋণী তিনি হলেন তারই স্ত্রী ফজিলাতুন্নেছা। বঙ্গবন্ধু তার জীবন ও যৌবনের বেশিরভাগ সময় ব্যয় করেছেন জনগণের সেবায়, দেশের কল্যাণে। এই সময়কালে বেশিরভাগ সময় বঙ্গবন্ধুকে কাটাতে হয়েছে জেলে। আর সেই সময়গুলোতে কান্ডারির মতো হাল ধরেছিলেন বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব।
৮ আগস্ট ছিল এই মহীয়সী নারীর জন্মদিন। ১৯৩০ সালের এই দিনে টুঙ্গিপাড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ফুলের মতো গায়ের রঙ দেখে মা হোসনে আরা বেগম ডাকতেন রেণু বলে। সেই নামেই সবার কাছে তার পরিচিতি হয়ে গেল। রেণুর বয়স যখন মাত্র তিন বছর, হঠাৎ করেই তার বাবা শেখ জহুরুল হক মারা গেলেন। তখন দাদা শেখ আবুল কাশেম রেণুর চাচাতো ভাই শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে রেণুর বিয়ে দেন। রেণুর বয়স যখন মাত্র পাঁচ বছর তখন তার মা মারা গেলেন। কিন্তু শেখ মুজিবের মা সায়েরা খাতুন রেণুর চোখের পানি মুছিয়ে কোলে তুলে নিলেন। গভীর মমতায় নিয়ে এলেন নিজের ঘরে। তখন থেকে বেগম ফজিলাতুন্নেছাকে শাশুড়ি (বঙ্গবন্ধুর মা) সাহেরা খাতুন নিজের সন্তানদের সঙ্গে মাতৃস্নেহে লালন-পালন করেন। গোপালগঞ্জ মিশন স্কুলে তিনি প্রাথমিক শিক্ষাগ্রহণ করেন। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সহধর্মিণী শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব বাংলাদেশের রাজনীতিতে এক নেপথ্যচারিণী ও প্রেরণাদায়িনী মহীয়সী।
ওই সময় মুসলিম ঘরের মেয়েরা ঘরের বাইরে স্কুলে লেখাপড়া করত না বলে তিনি ঘরে বসে লেখাপড়া শিখেছেন। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা না থাকলেও তিনি ছিলেন জ্ঞানী, বুদ্ধিদীপ্ত, দায়িত্ববান ও ধৈর্যশীল। বঙ্গবন্ধুর জীবনে তার প্রভাব অপরিসীম। বঙ্গবন্ধুর নিজের কথা থেকেই তা জানা যায়। বঙ্গবন্ধুর আত্মজীবনী লেখার পেছনেও মূল প্রেরণা ও উৎসাহ ছিল বেগম ফজিলাতুন্নেছার। এ সম্বন্ধে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘আমার সহধর্মিণী একদিন জেলগেটে বসে বলল, ‘বসেই তো আছো, লেখো তোমার জীবনের কাহিনি।’ বললাম, ‘লিখতে যে পারি না; আর এমন কী করেছি যা লেখা যায়! আমার জীবনের ঘটনাগুলো জেনে জনসাধারণের কি কোনো কাজে লাগবে? কিছুই তো করতে পারলাম না। শুধু এটুকু বলতে পারি, নীতি ও আদর্শের জন্য সামান্য একটু ত্যাগ স্বীকার করতে চেষ্টা করেছি।’
‘...আমার স্ত্রী যার ডাকনাম রেণু আমাকে কয়েকটা খাতাও কিনে জেলগেটে জমা দিয়ে গিয়েছিল। জেল কর্তৃপক্ষ যথারীতি পরীক্ষা করে খাতা কটা আমাকে দিয়েছিল। রেণু আরও একদিন জেলগেটে বসে আমাকে অনুরোধ করেছিল। তাই আজ লিখতে শুরু করলাম।’ (আত্মজীবনী, পৃষ্ঠা-১)
বেগম ফজিলাতুন্নেছা একদিকে যেমন শক্ত হাতে সংসার ও সন্তানদের সামলিয়েছেন, তেমনি নিজের ব্যক্তিগত চাওয়া-পাওয়াকে অতিক্রম করে স্বামীর সংগ্রামের সহযোদ্ধা হিসেবে ছায়াসঙ্গীর মতো জুগিয়েছেন সাহস ও উদ্দীপনা। ১৯৫৮ সালে জেনারেল আইয়ুব খান পাকিস্তানে সামরিক শাসন জারি করে, সংসদ ভেঙে দিয়ে রাজনীতি নিষিদ্ধ করে। কারাবন্দি করা হয় বঙ্গবন্ধুকে। সামরিক কর্তৃপক্ষ প্রায় দেড় বছর তাকে আটক করে রাখল। যেহেতু স্বামী কারাবন্দি, সে জন্য রেণুকে কেউ বাড়িভাড়া দিতে চাইত না। তিন দিনের নোটিশে বাড়ি থেকে বের করে দেওয়া হয়। তার মনের জোর ছিল প্রবল। দুঃসময়েও সব দিক লক্ষ রেখে শান্ত মনে নিজেই সামলাতে পারতেন সবকিছু। ছেলেমেয়ে নিয়ে বহু কষ্ট আর অভাব-অনটনের মধ্যেও তিনি সংসার চালিয়ে যেতে সমর্থ হন। নিজেই সন্তানদের কাপড় সেলাই করতেন। তাদের লেখাপড়ার দিকে লক্ষ রাখতেন। পিতার অভাবটা নিজের স্নেহ-ভালোবাসায় ভরিয়ে দিতেন। আবার তাকে মামলার খোঁজখবর নিতে আইনজীবীদের দ্বারে দ্বারে ঘুরতে হয়েছে। কারাবন্দি স্বামীর সঙ্গে নিয়মিত দেখা করতে হয়েছে। স্ত্রীর এই ত্যাগের কথা স্মরণ করে বঙ্গবন্ধু একটি ঘটনা প্রসঙ্গে তার অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে লিখেছেন, ‘রেণু খুব কষ্ট করত, কিন্তু কিছুই বলত না। নিজে কষ্ট করে আমার জন্য টাকা-পয়সা জোগাড় করে রাখত যাতে আমার কষ্ট না হয়।’ (পৃষ্ঠা-১২৬)
১৯৬৮ সালের ৩ জানুয়ারি শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা দায়ের করে তার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগ আনা হয়, যার শাস্তি ছিল মৃত্যুদ-। শেখ মুজিবসহ সব রাজবন্দির মুক্তি ও আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহারের দাবিতে ঊনসত্তরের গণ-আন্দোলন গড়ে ওঠে। দীর্ঘ সময় পর ক্যান্টনমেন্টে বন্দি শেখ মুজিবের সঙ্গে ফজিলাতুন্নেছাকে সাক্ষাৎ করতে দেওয়া হয়। এ সময় শেখ মুজিবের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে অনেক গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শ ছাত্রনেতাদের কাছে পৌঁছে দিতেন ফজিলাতুন্নেছা। তার পর ১৯৬৯ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি শেখ মুজিবসহ সব রাজবন্দি মুক্তি পান। পরের দিন সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে শেখ মুজিবুর রহমানকে ছাত্র-জনতা ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে সংবর্ধনা জানিয়ে বাঙালির একক নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে।
১৯৭১ সালের ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণের নেপথ্যে প্রেরণাদাত্রী হিসেবে ফজিলাতুন্নেছার অনন্য ভূমিকা রয়েছে। ঘটনাটি ছিল এ রকম এই ভাষণ দিতে যাওয়ার আগে শেখ মুজিব কী বলবেন সে বিষয়ে অনেকে তাকে পরামর্শ, উপদেশ, চিরকুট পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু ফজিলাতুন্নেছা তাকে সভায় যাওয়ার আগে ঘরে বিশ্রাম নেওয়ার জন্য কিছুটা সময় একাকী থাকতে দেন। সে সময় তিনি তাকে বলেছিলেন, ‘মনে রেখো, তোমার সামনে আছে জনতা এবং পেছনে বুলেট। তোমার মন যা চাইছে তুমি শুধু সেটাই আজ করবে।’ সেই শৈশব-কৈশোর থেকে তিনি শেখ মুজিবের স্বপ্ন, আকাক্সক্ষা, রাজনৈতিক চিন্তা-ভাবনা ও কর্মকা-ের সঙ্গে পরিচিত। শেখ মুজিবের স্ত্রী ও সহযাত্রী হিসেবে বাংলার স্বাধীনতা ও বাঙালির প্রতিষ্ঠা ছিল তারও লক্ষ্য। তাই ৭ মার্চের ভাষণে শেখ মুজিব জনতাকে কী বলবেন, তা রেণুকেও আলোড়িত করেছিল।
শেখ মুজিবের রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে গড়ে ওঠার পেছনে ফজিলাতুন্নেছার একটা দৃঢ়চেতা অথচ দরদি মন ছিল এবং ছিল আন্তরিক সহযোগিতা। বাঙালির অধিকার আদায় ছাড়া শেখ মুজিবের কাছে প্রধানমন্ত্রিত্ব বা ক্ষমতার কোনো আকর্ষণ ছিল না। ফজিলাতুন্নেছাও সেই আদর্শে নিজেকে গড়ে তোলেন। সন্তানদের তৈরি করেন।
বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব সাধারণ জীবনযাপনে অভ্যস্ত ছিলেন বলেই বত্রিশ নম্বর বাড়ি ছেড়ে প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনে কখনো থাকতে রাজি হননি। বাড়িতে কার্পেট, দামি আসবাবপত্র, এয়ারকন্ডিশন ব্যবহার করেননি। নিজের হাতে স্বামীর প্রিয় খাবার রান্না করে টিফিন ক্যারিয়ারে প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরে পাঠিয়ে দিতেন অথবা কখনো নিজে নিয়ে যেতেন। একজন আদর্শ নারীর প্রতীক যেন তিনি। তার মধ্যে আমরা খুঁজে পাই একজন মমতাময়ী মায়ের প্রতিকৃতি।
শহীদ পরিবার ও মুক্তিযোদ্ধাদের রেণু ব্যক্তিগতভাবে অর্থ দিয়ে সাহায্য করেছেন। অনেক বীরাঙ্গনাকে নিজে দাঁড়িয়ে থেকে বিয়ে দিয়ে পুনর্বাসিত করেন। এসব কাজ তিনি নিজ উদ্যোগে করতেন। কখনো সরকারিভাবে কিছু চাইতেন না। নিভৃতচারী, ত্যাগী এ নারীকে জনগণ ‘বঙ্গমাতা’ হিসেবে সম্মানিত করেছে। বঙ্গবন্ধুর আজন্ম জীবনসঙ্গী বেগম ফজিলাতুন্নেছা ১৯৭৫-র ১৫ আগস্ট ঘাতকের বুলেটে মারা যান।
এই মহীয়সী নারীর কথা ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে থাকবে। অথচ তার জন্মদিন শুধু দলীয়ভাবে ছোট পরিসরে কিছু কর্মসূচির মধ্য দিয়ে পালিত হয়; কিন্তু তিনি বাংলা ও বাঙালির ইতিহাসের পরতে পরতে জড়িয়ে আছেন। তাই বঙ্গমাতার জন্মদিন জাতীয়ভাবে পালিত হওয়া উচিত বলে মনে করি।
লেখক: কৃষি ও সমবায় সম্পাদক, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ এবং সাবেক সংসদ সদস্য
প্রথম প্রকাশ: আমাদের সময়