নারীমুক্তির ব্যাপারটা দাসত্ব থেকে মুক্তির মতোই
প্রকাশ | ৩১ জুলাই ২০১৭, ১৬:২১ | আপডেট: ৩১ জুলাই ২০১৭, ২২:১৬
নাহ, এই কয়েক ঘণ্টার জন্যে প্রোফাইল পিকচারে কালো রঙ ব্যাপারটা তো কাজ করেছে মনে হচ্ছে। অন্তত একটা মূর্খ প্রকৃতির মেল শভিনিস্টকে তো দেখলাম এইটা বেশ ভালই আঘাত করেছে। বাচাল প্রকৃতির এই লোকটা এই প্রতীকী প্রতিবাদটি নিয়ে বেশ রঙ্গ করার স্টাইলে সেই পুরনো অর্থহীন বাকোয়াস কথাগুলি উপদেশের মতো শুনিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছে- নারীবাদ মানে পুরুষকে শত্রু ভাবা নয়, নারীরাও মন্দ হয় ইত্যাদি। এইগুলি দেখলে এখন আর কৌতুক বোধ করি না। কেননা এইপ্রকার কথা যারা বলে, ওদের মধ্যে কে যে মূর্খতা থেকে বলছে আর কে নারীবিদ্বেষ থেকে বলছে বুঝা কঠিন হয়ে যায়।
এইগুলি হচ্ছে নারীকে ঊনমানুষ হিসাবে দেখার যে অভ্যাস সেগুলি থেকে জন্ম নেয়া প্রতিক্রিয়া। নারীকে আমরা আমাদের সমান মানুষ হিসাবে বিবেচনা করি না। পুরুষের মধ্যে এই বোধটা হাজার বছর ধরে আমাদের রক্তের সাথে মিশে আছে। এতো গভীরভাবে মিশে আছে যে এটা আমাদের ডান হাতে ভাল খাওয়ার মতো স্বাভাবিক প্রবণতা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এবং এই প্রবণতা থেকে নারীও মুক্ত নয়- নারীদের মধ্যেও আপনি দেখবেন গভীরভাবে প্রোথিত থাকে পুরুষবাদী চেতনা। কেননা নারীদেরকেও আমরা ঐভাবেই শেখাই, পুরুষই উত্তম, পুরুষই সম্পূর্ণ মানুষ।
দেখবেন যেসব নারীরা আমাদের সমাজে সফল বিবেচিত হন, রাষ্ট্রে ও সমাজে গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত থাকেন, বিভিন্ন ক্ষেত্রে খ্যাতিলাভ করেন, তারা প্রায় সকলেই পুরুষবাদী চেতনারই একেকটা প্রতিভূ। শারীরিকভাবে এরা নারী হলেও চেতনার দিক দিয়ে এরা যে কোন সাধারণ পুরুষের চেয়েও অধিক পুরুষ। না, এদের সাফল্যকে ছোট করে দেখার কিছু নাই, বা মানুষ হিসাবে এরা যে মন্দ সেকথাও সবক্ষেত্রে বলা যাবে না। কিন্তু একটু যদি খেয়াল করেন, দেখবেন যে নারীকে এরাও পুরোপুরি মানুষ বিবেচনা করেন না। নারীর জন্যে ওরা যখন ভাবেন, বা একটা কিছু করতে চান, তখন এরা নারীর কল্যাণের কথা ভাবেন, নারীকে রক্ষার কথা ভাবেন। যেন অনেকটা প্রতিবন্ধীদের কল্যাণে কাজ করা বা বয়স্ক ও অশক্ত মানুষের কল্যাণে একটা কিছু করছেন এইরকম। এইসব কল্যাণের চিন্তায়ও সুপ্ত থাকে নারীকে পুরুষের তুলনায় ঊন বা অসম্পূর্ণ বা ছোট করে দেখার দৃষ্টিভঙ্গি।
নারীবাদ তো ভাই কল্যাণের ব্যাপার না- নারীবাদ হচ্ছে মুক্তির ব্যাপার, মানুষে মানুষে সাম্যের ব্যাপার। নারীও মানুষ- পুরুষের মতোই সমান এবং ষোল আনা একজন মানুষ- এই কথাটা প্রতিষ্ঠা করাই হচ্ছে নারী মুক্তির লড়াই। আপনি একে নারীবাদ বলেন আর যাই বলেন- কথাটা হচ্ছে মুক্তি, কল্যাণ নয়।
আর আপনি যখন মুক্তির কথা বলবেন, তখন তো শৃঙ্খলটাও চিহ্নিত করতে হয়। নারীকে এই শৃঙ্খল পরিয়েছে কে? ঈশ্বর? জি না জনাব। এই আমরা, পুরুষরাই এই শয়তানিটা করেছি। কোন একজন পুরুষ কোন এককালে শয়তানি বুদ্ধি করে যে এই কাজটা করেছে সেটা তো আর না- এটা বিবর্তনের সাথে সাথেই হয়েছে, ব্যাক্তিগত সম্পদের বিকাশের সাথে সাথেই হয়েছে। ক্রমান্বয়ে আমরা পুরুষরা সমাজের ক্ষমতাটা দখল করেছি আর নারীকে করেছি বাঁদি।
তাহলে শৃঙ্খল যদি পুরুষরাই পরিয়ে থাকে, নারীমুক্তির শত্রু হিসাবে আপনি কাকে চিহ্নিত করবেন? এই জায়গাটায় আপনাকে স্পষ্টভাবে, কোনপ্রকার দ্বিধা না রেখে মুখ ফুটে বলতেই হবে নারীমুক্তির পথে শত্রু হচ্ছে পুরুষ এবং পুরুষবাদ। এই পুরুষবাদ ব্যাপারটা আমাদের সংস্কৃতির সকল পর্যায়ে সবখানে মিশে থাকে- হোক সেটা আইন কানুন, ধর্ম, সঙ্গীত কবিতা সিনেমা পেইন্টিং সবকিছু। পুরুষবাদটা কি? নারী ও পুরুষ সমান না, পুরুষ উত্তম, নারী অধম- এই কথাটাই হচ্ছে পুরুষবাদের ভিত্তি, বাকিগুলি হচ্ছে এর শাখা প্রশাখা।
নারীই নারীর শত্রু বা সকল পুরুষ এক না এইসব কথা যে কিছু লোকে বলে, এগুলি কথা কেন বলে? কারণ এরা নারীমুক্তির ব্যাপারটা বুঝতে পারেন না। এরা মনে করেন যে কল্যাণই মুক্তি। আর এরা শৃঙ্খলটা দেখতে পান না। একজন নারী যখন নির্যাতনের শিকার হন, তখন এরা সেখানে মেল শভিনিজমের অস্তিত দেখেন না, এরা দেখেন অবলা নারীর প্রতি কয়েকটা লোকের অন্যায় মাত্র। এরা নারী মুক্তির জন্যে শৃঙ্খল ভাঙার প্রয়োজনীয়তা মানেন না। ব্যক্তি পর্যায়ে নারীদের আরাম আয়েশ নিশ্চিত করা আর নিরাপত্তা নিশ্চিত করাকেই এরা মনে করেন নারীর প্রতি চূড়ান্ত কর্তব্য।
না, আর্থিক নিশ্চয়তা, আরাম আয়েশ, নিরাপত্তা এগুলি তো গুরুত্বপূর্ণ বটে। কিন্তু এইগুলি হচ্ছে উপসর্গের চিকিৎসা মাত্র- সমাজের মূল বৈকল্য রেখে এইসব উপসর্গের চিকিৎসা চূড়ান্ত বিচারে করাও যায় না। তারপরেও উপসর্গের চিকিৎসাও কোর্টে হয়। কবে বিপ্লব হবে সেই কথা ভেবে আজকের সমস্যার আশু সমাধান ভাববো না সেটা তো হয় না। দুইটাই করতে হবে। সেটা ঠিক আছে।
আর এই যে নারীই নারীর বড় শত্রু- এই জাতীয় কথা এইরকম ব্যাক্তি পর্যায়ে কল্যাণের চিন্তা থেকেই বলে ওরা। নারীকে ভিলেন দেখে, নারীকে অত্যাচারী দেখে। বুঝতে পারে না যে এক নারী যখন অপর নারীরই প্রতি নিষ্ঠুর হয় তার একাধিক কারণ থাকে তার মধ্যে দুইজনের নারী হওয়াটা কোন গুরুত্বপূর্ণ কারণ না। যে দাসটি মালিকের হয়ে অন্য দাসদের উপর চাবুক চালাতো, সে দাস হলেও মালিকের প্রতিভূ। আর দাসদের মধ্যে প্রভুর নৈকট্য লাভের প্রতিযোগিতা থেকেও দাসের প্রতি দাস নিষ্ঠুরতা করতো। আর ব্যক্তিগত ভালো লাগা মন্দ লাগা সেইসব তো আছেই।
নারীমুক্তির ব্যাপারটা দাসত্ব থেকে মুক্তির মতোই ব্যাপার। দাসত্ব বজায় রেখে চাবুক মারা বন্ধ করার লড়াই নারীবাদীরা করেন না। সে লড়াই কল্যাণকামীরা করছেন, করুক। নারীবাদীরা দাসত্ব থেকে মুক্তির লড়াইটা করছেন। যে মূর্খটি মেয়েদের কালো রঙ প্রোফাইল ফটো নিয়ে রঙ্গ করতে গিয়ে নারীবাদীদের নসিহত দেওয়ার চেষ্টা করেছে, কল্যাণ আর মুক্তির এই পার্থক্যটি ওর উইগঢাকা মোটা মাথায় হয়তো ঢুকবে না। কিন্তু নারীরা এবং নারীবাদীরা ঠিকই পার্থক্যটা জানেন এবং লড়াইয়ের লক্ষ্যও তাদের স্থির।
এইসব পুরুষবাদী বাকসর্বস্ব হমবড়াদের কথায় বিভ্রান্ত হবেন না। ইগনোর করেন। যেতে হবে আরও অনেক অনেক দুর, পথে এইরকম উটকো ইয়ের তো দেখা মিলবেই।