গল্প নয়, সত্যি
প্রকাশ | ২৯ জুলাই ২০১৭, ২১:২৯
[ঘটনাগুলো আপনার আমার চারপাশের। নিবিড়ভাবে ভাবুন। আপনার পরিবারের সদস্যও হতে পারে।]
শিউলীর থেমে যাওয়া আর আমার ছুটে চলা।
আমার বান্ধবী শিউলী, নবম দশম আমরা একসঙ্গে পড়েছিলাম। প্রতিদিন ওর ভাই নিয়ে আসতো, স্কুলে কখনো কোনো খেলাধুলায় অংশ নেয়নি। চুপচাপ, টুপটাপ। ছাত্রীও আমরা প্রায় একই রকম। তখনকার দিনে বেস্ট ছাত্রের সংজ্ঞায় তার স্টার মার্কস আসেনি বটে, কাছাকাছি ছিলো। কিন্তু দুজনই ভর্তি হয়েছিলাম সরকারী মহিলা কলেজে। তখনকার দিনে ভর্তির জন্য মৌখিক পরিক্ষা নিতো। তিন চারজন টিচার বসে নানান বিষয় জানতে চাইতো। আমার আগে শিউলী। তাকে প্রশ্ন করা হয়েছিলো ইমরান খান একজন খেলোয়াড়, বলতে হবে সে কি খেলে আর কোন দেশের প্লেয়ার। শিউলী বলতে পারেনি। এটা তার দোষ নয়। কারণ তাকে প্রতি শুক্রবারে সিনেমা ছাড়া অন্য কিছু দেখতে দেয়নি। কখনো খবরের কাগজ পড়েনি। তাই ইমরান খানকে জানে নাই। একই প্রশ্ন আমার জন্যও ছিলো। আমি বলতে পেরে খুব আবেগে হাসছিলাম। ঠিক সে সময় অন্য এক নারী টিচার প্রশ্ন করলেন আমাকে, এক কেজি চালের পায়েসে ক' চামচ হলুদ দিতে হয় জানো? দু'চামচ, উত্তর দেয়ার সাথে সাথে আমার ভর্তি অনিশ্চিত হয়ে পড়েছিল।
তারপর থেকে সে ম্যাডামকে দেখলেই মনে মনে বলতাম, সে কি কখনো পায়েস খায়নি? পায়েসে কখনো হলুদ দিতে হয় না তাও জানে না?
এভাবেই শিউলীর দ্বাদশ শ্রেণীতে উঠেই প্রবাসী পাত্রের সাথে বিয়ে হয়। মাঝে মাঝে আসতো কুচকুচে কালো বোরকায় আবৃত শিউলী। সুযোগ পেলেই বিবাহিত জীবনের গল্প করতো। অন্যদিকে, কলেজে ভর্তি হয়েই আমি তখন এক নতুন জীবনে বিভোর। আমার গেম টিচার কাকলী সাহা দেখালো নতুন নতুন স্বপ্ন। সারাদিন খেলতাম। বিকেল মানেই ব্যাডমিন্টন, বর্শা নিক্ষেপ, দৌড়, কবিতা আবৃত্তি, নাটক, বিএনসিসি, ক্রিয়েটিভ রাইটিং কম্পিটিশন আরো কতো কি! বিএনসিসি করতে গিয়ে একবার আর্মিদের সাথে ক্যাম্পে সাতদিন ছিলাম। ক্রলিং করেছি, দড়ি বেয়ে চারতলা উঠেছি, সত্যি সত্যি গুলি করে নিশানায় লাগিয়েছিলাম। পাঁচটার মধ্যে তিনটাই সাকসেস ছিলো। তাঁবু করে থাকতাম।
এভাবেই সহশিক্ষা, একাডেমিক শিক্ষার সাথেই চলছিলো। হোস্টেলে একটা মেয়ে ডায়রিয়া হয়ে মারা গিয়েছিলো, তা নিয়ে প্রথম প্রতিবাদ আমিই করেছিলাম। তাই হল সুপার তিনদিন টিভি দেখতে দেয়নি। খুব সাঁতরাতাম। আমার রাগ উঠলেও, মন ভালো থাকলেও। মহিলা কলেজের পুকুরটা তখন অতো নোংরা ছিলো না। আমরা যে হোস্টেলে ছিলাম তা ছিলো টিনের চালার। অসংখ্য ফুটো। পরে এক অনুষ্ঠানে এসেছিলেন তৎকালীন জনপ্রিয় নেতা আব্দুল হামিদ। বর্তমানে মহামান্য রাষ্ট্রপতি। প্রোগ্রাম উপস্থাপনে ছিলাম আমি। কায়দা করে স্ক্রিপ্টের বাইরে হোস্টেলের সমস্যার কথা বলেছিলাম। তিনি আমার কথায় এতো আবেগপ্রবণ হয়েছিলেন যে, এক সেকেন্ডও আমার হাত ছাড়েননি। বলেছিলেন মেয়েদের ঘরে টিনের চাল দিয়ে পানি পড়ে, এটা অমানবিক। এবং সেবছরেই দালান হয়েছিলো। উনার সাথের ছবিগুলো দিচ্ছি না। এখন দেখলে মনে হবে তা খুবই রোমান্টিক।
এভাবেই আমার কলেজ জীবনের দারুণ দিনগুলো গিয়েছিলো। হোস্টেলে থাকার সময় প্রথম শিখলাম নিজের কাপড়, বইপত্র, রুম কি করে গুছিয়ে রাখতে হয়। পড়া তৈরি করতে হয়। মুড়ির টিন, বিস্কিটের টিন, টাকা কসমেটিক কিভাবে লুকিয়ে সাবধানী হতে হয়। খেলতে গিয়ে ব্যাথা পেলে চিকিৎসাও করতে হয়। নির্দিষ্ট সময়ে খাওয়া আর ঘুমাতে হয়। বিপদে পড়লে কিভাবে উদ্ধার হবার কৌশল শিখতে হয়।
সেদিন বাসে হঠাত শিউলীর সাথে দেখা, আমি ওকে চিনতে পারিনি। কিছুক্ষণ আমতা আমতা করে সেই বললো, তুমি জোনাকী না?
ওর হাসিটা দেখে জড়িয়ে ধরলাম। ভাঙ্গা চোয়াল, না মাজা দাঁত আর রুক্ষ চুলের আমার শিউলী!! কটিয়াদি পর্যন্ত একই সাথে আসলাম। অনেক কথা হলো। চারটি সন্তান আছে, বড়টা টেনে পড়ে। আমার পারুর ছবি দেখালাম, ওর বাবার। খুব উচ্ছসিত হয়নি। ঝরা শিউলীর মতো, নেতিয়ে যাওয়া শিউলীর মতো, চুপসে রইলো। আমি সে নেমে যাবার সময় কার্ডটা দিয়ে বললাম। ফোন দিও।
ওর নেমে যাওয়া দেখলাম। বুকটা সেই থেকে হু হু করছে। নিরাপত্তার নামে একটা সম্ভাবনাকে পরিবার মেরে ফেলতে পারে। শিউলীরও সম্ভাবনা ছিলো।
আমাদের মেয়েদেরও আমরা আসলে নিরাপত্তার নামে সঠিকভাবে বেড়ে উঠা কেড়ে নিচ্ছি। যেখানেই যায় সাথে গার্ডিয়ান, খেলার জায়গা নেই, গানের স্কুল নেই, স্কুলে কি পড়ায় জানি না। তারচে' বেশি সময় টিচারের বাসায়!! বিনোদন বলতে গেমস, মুভি দেখা, পাস্তা বাস্তা খাওয়া!!!
নারীর জন্য পরিবেশ যতটা না বদলেছে তার চে' বেশি শৃংখলও গড়ে উঠেছে। ভাঙ্গতে হবে, নারীকে মানুষ গড়ার জন্য।
খুজিস্থা বেগম জোনাকীর ফেসবুক থেকে